( 22 মে, 1772 - 27 সেপ্টেম্বর, 1833)
একজন ভারতীয় ধর্মীয়, সামাজিক এবং শিক্ষা সংস্কারক, যিনি ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং ভারতীয়দের অগ্রগতির রেখা নির্দেশ করে ভারত পথিক হন। ব্রিটিশ শাসনাধীন সমাজে তিনি যথার্থ আধুনিক মানুষ নবজাগরণের পথিকৃৎ তথা ভারতের জনক ।
তিনি ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় ব্রাহ্মণ শ্রেণীর ( বর্ণ ) একটি সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন 22 মে, 1772 সালে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই বোধ করি এদের 'রায়' পদবীর ব্যবহার। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। তার পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানাস্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে বুৎপত্তি, তাঁর বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তাঁর দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন। বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও পারসি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন।
তার প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা সম্পর্কে খুব কমই জানা যায় , তবে তিনি অল্প বয়সেই অপ্রথাগত ধর্মীয় ধারণা গড়ে তুলেছিলেন বলে মনে হয়। যৌবনে, তিনি বাংলার বাইরে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন এবং তার স্থানীয় বাংলা এবং হিন্দি ছাড়াও বিভিন্ন ভাষা - সংস্কৃত , ফারসি , আরবি এবং ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ।
তরুণ বয়সে তিনি কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। ১৭৯৬ সালে রামমোহন অর্থোপার্জন শুরু করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরেজি শিখে নেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তাঁর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি দু'বার ভুটান সীমান্তে যান কোম্পানির হয়ে দৌত্যকার্যে ডিগবির সাহচর্যে তাঁর সমস্ত নতুন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপক্কতা লাভ করে। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়ল বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম 'বেদান্তচন্দ্রিকা'। বেদান্তচন্দ্রিকা'র প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সহিত বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। 'বেদান্ত গ্রন্থ' প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন। সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন।
সতীদাহ ও রামমোহন রায়
বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করবার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ'। প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল 'বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ'। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এই চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন।
ব্রাহ্মসমাজ ও রামমোহন রায়
বেদান্তচন্দ্রিকার প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখান আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নামে নতুন রূপ দেন।
বিলেত যাত্রা
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাঁকে 'রাজা' উপাধি দিয়ে ভার দেন বিলেতে গিয়ে রাজদরবারে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করার। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সেখানে সম্ভ্রান্ত ও বিদ্বৎসমাজে তাঁর প্রচুর সমাদর হয়েছিল। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন।
রায় অর্থঋণ, তার ছোট এস্টেট পরিচালনা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বন্ডে অনুমান করে নিজেকে সমর্থন করেছিলেন । 1805 সালে তিনি জন ডিগবির নিযুক্ত হন, একজন নিম্ন কোম্পানির কর্মকর্তা যিনি তাকে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তী 10 বছর ধরে রায় ডিগবির সহকারী হিসেবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশ এবং বাইরে চলে যান।
সেই সময় জুড়ে রায় তার ধর্মীয় অধ্যয়ন চালিয়ে যান। 1803 সালে তিনি একটি ট্র্যাক্ট রচনা করেন যাকে তিনি ভারতের কুসংস্কার এবং এর ধর্মীয় বিভাজন হিসাবে বিবেচনা করেন, উভয়ই হিন্দুধর্মের মধ্যে এবং হিন্দুধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে। এইসব অসুখের প্রতিকার হিসেবে, তিনি একেশ্বরবাদী হিন্দুধর্মের পরামর্শ দেন যার কারণে অনুগতদেরকে "পরম জন্মদাতা যিনি সকল ধর্মের প্রথম নীতি।" তিনি বেদ (হিন্দুধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ) এবং উপনিষদগুলিতে (অনুমানমূলক দার্শনিক গ্রন্থ) তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য একটি দার্শনিক ভিত্তি চেয়েছিলেন , সেই প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থগুলিকে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন এবং সেগুলির উপর সারসংক্ষেপ ও গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। রায়ের জন্য এই গ্রন্থগুলির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল পরম ঈশ্বরের উপাসনা যিনি মানুষের জ্ঞানের বাইরে এবং যিনি মহাবিশ্বকে সমর্থন করেন। তার অনুবাদের প্রশংসায়, ফরাসি1824 সালে সোসাইটি এশিয়াটিক তাকে সম্মানসূচক সদস্য পদে নির্বাচিত করেন।
1815 সালে রায় তার একেশ্বরবাদী হিন্দু ধর্মের মতবাদ প্রচারের জন্য স্বল্পস্থায়ী আত্মীয়-সভা (বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজ) প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি খ্রিস্টধর্মে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং পুরাতন ( হিব্রু বাইবেল দেখুন ) এবং নিউ টেস্টামেন্ট পড়ার জন্য হিব্রু এবং গ্রীক ভাষা শিখেছিলেন । 1820 সালে তিনি শিরোনামে চারটি গসপেল থেকে উদ্ধৃত খ্রিস্টের নৈতিক শিক্ষা প্রকাশ করেন।যীশুর উপদেশ , শান্তি ও সুখের নির্দেশিকা।
1823 সালে, যখন ব্রিটিশরা কলকাতা (কলকাতা) প্রেসের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল, রায় ভারতের প্রথম দিকের দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক হিসাবে, বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মের স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে যুক্তি দিয়ে একটি প্রতিবাদের আয়োজন করেছিলেন। এই প্রতিবাদটি রায়ের জীবনে একটি বাঁক সূচনা করে, ধর্মীয় বিতর্ক থেকে দূরে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপের দিকে। তার সংবাদপত্র, গ্রন্থ এবং বইগুলিতে, রায় অক্লান্তভাবে সমালোচনা করেছেন যা তিনি ঐতিহ্যগত হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা এবং কুসংস্কার হিসাবে দেখেছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার নিন্দা করেন এবং প্রথাকে আক্রমণ করেনসুত্তি ( বিধবাদের মৃত স্বামীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পুড়িয়ে ফেলার রীতি )। তার লেখাগুলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া গভর্নিং কাউন্সিলকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিল, যার ফলে 1829 সালে সুত্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
1822 সালে রায় প্রতিষ্ঠা করেনঅ্যাংলো-হিন্দু স্কুল এবং চার বছর পরেবেদান্ত কলেজে তার হিন্দু একেশ্বরবাদী মতবাদ শেখানোর জন্য। 1823 সালে যখন বঙ্গ সরকার আরও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃত কলেজের প্রস্তাব দেয়, তখন রায় প্রতিবাদ করেন যে ধ্রুপদী ভারতীয় সাহিত্য বাংলার তরুণদের আধুনিক জীবনের দাবিতে প্রস্তুত করবে না। তিনি পরিবর্তে একটি আধুনিক পশ্চিমা পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব করেন। রায় ভারতে সেকেলে ব্রিটিশ আইনী ও রাজস্ব প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন।
1828 সালের আগস্টে রায় গঠন করেনব্রাহ্ম সমাজ (ব্রাহ্ম সমাজ), একটি হিন্দু সংস্কারবাদী সম্প্রদায় যেটি তার বিশ্বাসে একতাবাদী এবং অন্যান্য উদার খ্রিস্টান উপাদানগুলিকে ব্যবহার করেছিল। ব্রাহ্মসমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, পরবর্তী শতাব্দীতে, সংস্কারের একটি হিন্দু আন্দোলন হিসাবে।
1829 সালে রায় দিল্লির রাজার বেসরকারী প্রতিনিধি হিসাবে ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। দিল্লির রাজা তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন, যদিও এটি ব্রিটিশদের দ্বারা স্বীকৃত ছিল না। রয় ইংল্যান্ডে ভালভাবে সমাদৃত হয়েছিল, বিশেষ করে সেখানে ইউনিটারিয়ানদের দ্বারা এবং রাজা উইলিয়াম চতুর্থ দ্বারা । ব্রিস্টলে ইউনিটেরিয়ান বন্ধুদের যত্ন নেওয়ার সময় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রায় মারা যান, যেখানে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল।
আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসে রায়ের গুরুত্ব আংশিকভাবে তার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃত পরিধি এবং তার চিন্তার আকর্ষণীয় আধুনিকতার উপর নির্ভর করে। তিনি একজন অক্লান্ত সমাজ সংস্কারক ছিলেন, তবুও তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির উপর পশ্চিমা আক্রমণের প্রতিকূল হিসেবে বেদান্ত বিদ্যালয়ের নৈতিক নীতির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তাঁর পাঠ্যপুস্তক এবং গ্রন্থগুলিতে তিনি বাংলা ভাষার জনপ্রিয়করণে অবদান রেখেছিলেন , একই সময়ে তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ফরাসি এবং আমেরিকান বিপ্লবের মৌলিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণাগুলি ভারতীয় পরিবেশে প্রয়োগ করেছিলেন।
বাংলা গ্রন্থাবলী:
বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫): রাজা রামমোহন রায় রচিত প্রথম বাংলা গ্রন্থ। মূল গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। রাজা রামমোহন রায়-প্রণীত গ্রন্থাবলি-র (১৮৮০) সম্পাদক রাজনারায়ণ বসু ও আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ অধ্যায়গুলির নামকরণ করেছিলেন যথাক্রমে সমন্বয়, অবিরোধ, সাধন ও ফল।[৯]
বেদান্ত সার (১৮১৫): রামমোহন রায়ের দ্বিতীয় বাংলা গ্রন্থ। এই বইটির প্রকাশকাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে। বইটির আখ্যাপত্রে প্রকাশকাল মুদ্রিত ছিল না। রামমোহনের জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, এটি প্রকাশিত হয় বেদান্ত গ্রন্থ-এর সঙ্গে অথবা কিছুকাল পরে। কেউ কেউ মনে করেন বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৬ সালে। তবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত রামমোহন-গ্রন্থাবলী-র সম্পাদকেরা এটির প্রকাশকাল ১৮১৫ বলে মতপ্রকাশ করেছেন। ১৮১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত রামমোহনের ট্রান্সলেশনস অফ অ্যান অ্যাব্রাইজমেন্ট অফ দ্য বেদান্ত গ্রন্থে এই গ্রন্থটির নাম পাওয়া যায়। বেদান্ত সার হিন্দুস্তানী ভাষাতেও অনূদিত হয়।
তলবকার উপনিষৎ (জুন, ১৮১৬): বেদান্ত গ্রন্থ ও বেদান্ত সার রচনার পর রামমোহন রায় উপনিষদ্ গ্রন্থাবলি বাংলায় প্রচারের কাজে হাত দেন। তলবকার উপনিষৎ রামমোহন রায় অনূদিত পাঁচটি উপনিষদের মধ্যে প্রথম। এটি কেনোপনিষদের অনুবাদ। গ্রন্থের ভূমিকায় রামমোহন জানিয়েছেন যে, তিনি আদি শঙ্কর রচিত ভাষ্য অবলম্বনে এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন।[১১]
ঈশোপনিষৎ (জুলাই, ১৮১৬): রামমোহন রায় কর্তৃক অনূদিত দ্বিতীয় উপনিষদ্। এই উপনিষদ্ যজুর্বেদের অন্তর্গত এবং এর অপর নাম বাজসনেয় সংহিতোপনিষদ্।
ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (মে, ১৮১৭): কলকাতা সরকারি কলেজের অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রামমোহন রায়ের বেদান্ত গ্রন্থ ও বেদান্ত সার-এর প্রতিবাদে বেদান্ত চন্দ্রিকা নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের প্রত্যুত্তরে রামমোহন বাংলায় ভট্টাচার্যের সহিত বিচার গ্রন্থটির রচনা করেন। এটি উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার গ্রন্থের প্রায় সমসাময়িককালেই রচিত হয়।[১৩]
কঠোপনিষৎ (অগস্ট, ১৮১৭): রামমোহন কর্তৃক অনূদিত তৃতীয় উপনিষদ্। এটিতেও একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা রয়েছে। আদি শঙ্করের ভাষ্য অবলম্বনে রামমোহন যজুর্বেদের অন্তর্গত এই উপনিষদ্ অনুবাদ করেন।
মাণ্ডুক্যোপনিষৎ (অক্টোবর, ১৮১৭): রামমোহন রায় অনূদিত চতুর্থ উপনিষদ্। অথর্ববেদের অন্তর্গত এই উপনিষদের একটি দীর্ঘ ভূমিকাও রামমোহন এই গ্রন্থে সংযোজিত করেছিলেন। এই অংশে ব্রহ্মোপাসনার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে একটি 'শাস্ত্রীয় প্রমাণসম্বলিত বিচার' রয়েছে। তারপর বঙ্গানুবাদ সহ মূল উপনিষদ্ আলোচিত হয়েছে এবং শেষভাগে ভাষ্যে বর্ণিত সিদ্ধান্তগুলির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ১৮১৯ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
গোস্বামীর সহিত বিচার (জুন, ১৮১৮): মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব-মতাবলম্বী জনৈক গোস্বামী রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধে পুস্তক প্রকাশ করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের অনুমান, এই গোস্বামীর নাম সম্ভবত 'রামগোপাল শর্মণঃ'। এই গ্রন্থের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রামমোহন রায় রচনা করেন গোস্বামীর সহিত বিচার। এই গ্রন্থে রামমোহন লিখেছিলেন, "এই গ্রন্থের বিশেষ বিচার্য এই যে, ভাগবত শাস্ত্রই যথার্থ বেদার্থ নির্ণায়ক নহে; বেদার্থ নির্ণয়ে শ্রুতি-স্মৃতিরই প্রাধান্য আছে।
গায়ত্রীর অর্থ (১৮১৮): বইটি "ভূমিকা" ও "গ্রন্থ" - এই দুই অংশে বিভক্ত। ভূমিকা অংশে রামমোহন বলেন, ব্রাহ্মণেরা প্রতিদিন যে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন, তা আসলে পরব্রহ্মেরই উপাসনা। এরপর গ্রন্থ-অংশে গায়ত্রীর অর্থ বাংলায় ব্যাখ্যা করে তিনি সেই কথাটিই প্রতিপন্ন করেছেন।
মুণ্ডকোপনিষৎ (আনুমানিক ফেব্রুয়ারি/মার্চ, ১৮১৯): রামমোহন রায় অনূদিত সর্বশেষ উপনিষদ্ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির প্রকাশকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মূল সংস্করণের আখ্যাপত্রে প্রকাশকাল মুদ্রিত ছিল না। বসু-বেদান্তবাগীশ সংস্করণে এটিকে পূর্বে প্রকাশিত বলে উল্লেখ করা হলেও সমাচার দর্পণ পত্রিকার ২৭ মার্চ ১৮১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে এটিকে "নূতন পুস্তক" বলে উল্লেখ করা হয়। জেমস লং মুদ্রিত বাংলা পুস্তক তালিকাতেও এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৮১৯ বলে উল্লিখিত। এই কারণে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত সংস্করণে এই গ্রন্থটিকে ১৮১৯ সালের রচনা হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও রামমোহন রায় আদি শঙ্কর কৃত টীকা অনুসারে অথর্ববেদের অন্তর্গত এই উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছেন।
সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (নভেম্বর, ১৮১৯): রামমোহন রায় প্রণীত সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ পুস্তকের প্রতিবাদে কলকাতার ঘোষালবাগানের এক চতুষ্পাঠীর পরিচালক কাশীনাথ তর্কবাগীশ ১৮১৯ সালে বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেই পুস্তিকার প্রত্যুত্তরে রামমোহ রায় রচনা করেন সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ। ১৮২০ সালে পুস্তিকাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
আত্মানাত্মবিবেক (১৮১৯): আদি শঙ্কর রচিত একই নামের একটি বেদান্ত-আলোচনা পুস্তকের বঙ্গানুবাদ।
সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (নভেম্বর, ১৮১৯): রামমোহন রায় প্রণীত সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ পুস্তকের প্রতিবাদে কলকাতার ঘোষালবাগানের এক চতুষ্পাঠীর পরিচালক কাশীনাথ তর্কবাগীশ ১৮১৯ সালে বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেই পুস্তিকার প্রত্যুত্তরে রামমোহ রায় রচনা করেন সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ। ১৮২০ সালে পুস্তিকাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
সংস্কৃত গ্রন্থাবলি
উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার (১৮১৬-১৭): ১৮১৬ সালে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়সভার নিকট বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মহামহোপাধ্যায় উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ নিজের প্রশ্নপত্র পাঠান এবং রামমোহন রায় আত্মীয়সভার পক্ষ থেকে তার উত্তর দেন। এই প্রশ্নোত্তর-সম্বলিত চারটি পুস্তিকা শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত রামমোহন-গ্রন্থাবলী-র সম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সংস্কৃত ভাষায় রচিত ও বাংলা হরফে মুদ্রিত সেই পুস্তিকাগুলি উদ্ধার করে গ্রন্থাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইতিপূর্বে এটি রামমোহনের অপর কোনও রচনা-সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। উল্লেখ্য, উৎসবানন্দ প্রথমে রামমোহনের বিচারপদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী হলেও এই বিচারের ফলে রামমোহনের মত গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৮২৮ সালের অগস্ট মাসে রামমোহন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলে তিনি তার অধিবেশনে উপনিষদ্-পাঠের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে
১৯৬৫ সালে বিজয় বোস পরিচালিত ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র রাজা রামমোহন, প্রধান চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী।
১৯৮৮ সালে শ্যাম বেনেগাল প্রযোজিত ও পরিচালিত দূরদর্শন সিরিয়াল ভারত এক খোজ এছাড়াও রাজা রাম মোহন রায়ের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ একটি পর্ব চিত্রিত করে । প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট টিভি অভিনেতা অনঙ্গ দেশাই, উর্মিলা ভাট, টম অল্টার এবং রবি ঝাঁকাল সহ কাস্ট হিসেবে।
১৯৮৪ সালে ভারতের ফিল্ম ডিভিশন পিসি শর্মা পরিচালিত রাজা রামমোহন রায়ের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে।
রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন, তিনি ফ্রান্সও পরিদর্শন করেছিলেন। ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপল্টনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
###############################
No comments:
Post a Comment