Tuesday, 21 May 2024

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।‌ বাংলা ভাষার একজন কবি, প্রথম গীতি-কবি । রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার 'ভোরের পাখি' বলে আখ্যায়িত করেন। যার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্যকবি তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তী। Dt -21.05.2024. Vol -885. The blogger post in literary e magazine

" বিহারীলাল তখনকার ইংরাজী ভাষায় নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধবর্ণনা সঙ্কুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না এবং পুরাতন কবিদিগের ন্যায়  পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না,- তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন। তাঁহার সেই স্বগত উক্তিতে বিশ্বহিত, দেশহিত অথবা সভা-মনোরঞ্জনের কোনো উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এই জন্য তাঁহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।''


        কাব্যগুরুকে ' ভোরের পাখি " আখ্যাদেওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙ্ময় উচ্চারণ।


                  বিহারীলাল চক্রবর্তী 
(২১শে মে, ১৮৩৫ সাল -  ২৪শে মে, ১৮৯৪ সাল)

কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মে (৮ই জৈষ্ঠ, ১২৪২ বঙ্গাব্দ)-তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। পেশায় তিনি ছিলেন পুরোহিত। মাত্র চার বছর বয়সকালে লেখক বিহারীলাল মাতৃহারা হন এবং তখন থেকেই তিনি পিতার স্নেহাধিক্য লাভ করেন। কবি বিহারীলাল আসলে চট্টোপাধ্যায় বংশজাত ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ হালিশহরের এক স্বর্ণকারের দান গ্রহণ করেন বলে সেই সমাজের বিধান অনুযায়ী সমাজচ্যুত হন। লেখক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে’ (দ্বিতীয় খণ্ড)-এ বিহারীলাল সম্পর্কে লিখেছেন-
“ইনি স্বাক্ষর করিতেন ‘বেহারীলাল’। বস্তুত নামটি বেহারীলাল চক্রবর্তী হওয়া উচিত। সাধুভাষার খাতিরে (এবং রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন বলিয়া) আমরা ‘বিহারীলাল’ লিখিয়া আসিতেছি।“ 


লেখক বিহারীলাল চক্রবর্তী সংস্কৃত, ইংরাজি ও বাংলা- এই তিনটি ভাষা সম্পূর্ণ ভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন। যা পরবর্তীকালে কাব্য চর্চায়ও বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। তিনি পরবর্তীতে সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল অধ্যয়ন করেন। ফলে সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর বেশ অন্তরঙ্গতা ছিল, যা পরবর্তীকালে তাঁর কাব্যের মধ্যদিয়ে প্রস্ফূটিত হয়।


বিহারীলাল মাত্র উনিশ বছর বয়সে দশ বছর বয়সী অভয়াদেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু এই বিবাহ খুবই সীমিত পরিসরের ছিল। চার বছর পর অভয়াদেবী মৃত সন্তান প্রসব করে মৃত্যু মুখে পতিত হন। এর দুবছর পরে বিহারীলাল বউবাজারের নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা কাদম্বিনী দেবীকে বিবাহ করেন।


১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘স্বপ্নদর্শন’ নামক গদ্যগ্রন্থ রচনার মধ্যদিয়ে লেখক বিহারীলাল সাহিত্য জীবনে পদার্পণ করেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নকালে ‘পূর্ণিমা’ নামক পত্রিকায় এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা ১৮৫৮ সালে ৩রা আগষ্ট এই গদ্যগ্রন্থের প্রশংসা করে। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ছিল দেশ ও দেশমাতার দুর্ভাগ্যের জন্য গভীর আক্ষেপ।১৮৬২ খিস্টাব্দে লেখক বিহারীলালের রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘সঙ্গীত শতক’-(একশত গানের সমষ্টি) প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ সম্পর্কে কবি অনাথবন্ধু রায়কে লিখেছেন, ""১৫ হইতে ২৫ বৎসর পর্যন্ত আমার মনে যে যে ভাবোদ্গম হইয়াছিল এবং জীবনে যে যে ঘটনা হইয়াছিল, তাহার অধিকাংশ ‘সঙ্গীত শত্কে’ বর্ণিত আছে।'' সুকুমার সেন এই গ্রন্থ সম্বন্ধে লিখেছেন, ""বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বাঙ্গালার বিশুদ্ধ গীতিকবিতার যে ধারাটি নিধুবাবু শ্রীধর কথক রামবসু প্রভৃতি ‘টপ্পায়’ অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রণয়সঙ্গীতে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল তাহাকে বিহারীলাল নূতন করিয়া প্রবাহিত করিলেন সঙ্গীত শতকে .... সুরতালের নির্দেশ থাকিলেও সবগুলি ঠিক গানের ঠাটে বাঁধা নয়। যেগুলি গানের ঠাটে বাঁধা সেগুলিতেও ভাবে-ভক্তিতে প্রায়ই নিধু-শ্রীধর প্রভৃতির রচনার প্রতিবিম্বন আছে।

'' ‘সঙ্গীত শতক’ গ্রন্থের দৃষ্টান্ত-      

আকাশে কেমন ওই
নব ঘন যার,
যেন কত কু-বলয়
শোভে সব গায়!
মধুর গম্ভীর স্বরে
ধীরে ধীরে গান করে,
সুধা ধারা বরষিয়ে
রসায় বসায়। ( গীত সংখ্যা-৫৫ )

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখক বিহারীলালের ‘বঙ্গ সুন্দরী’ কাব্যটি প্রকাশিত হয়। কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত। নামগুলি হলো ‘উপহার’, "নারীবন্দনা’, "সুরবালা’, "চিরপোরাধিনী’, "করুণা সুন্দরী’, "বিশাদিনী’, "প্রিয়সখী’, "বিরহিনী’, "প্রিয়তমা’ এবং ‘অভাগিনী’। প্রত্যেকটি সর্গের প্রারম্ভে একটি করে উদ্ধৃতি রয়েছে। সেগুলি ভবভূতি, কালিদাস, ভারবি ও বায়রণের। তৃতীয় সর্গে প্রাণপ্রাচুর্যময় সুরবালার অভিমানিনী মূর্তির বর্ণনা জীবন্তরূপে ফুটে ওঠে-

মধুর তোমার ললিত আকার,
মধুর তোমার চাঁচর কেশ,
মধুর তোমার পারিজাত হার,
মধুর তোমার মানের বেশ !

১৮৭০ সালেই লেখক বিহারীলাল রচিত ‘বন্ধুবিয়োগ’ কাব্যটি প্রথমে ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কাব্যটিতে চারটি সর্গ রয়েছে। চারটি সর্গেই কবি তাঁর চারবন্ধু পূর্ণচন্দ্র, কৈলাস, বিজয়, রামচন্দ্র এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী অভয়াদেবীর বিয়োগের বিরহ যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করেছেন। চারটি সর্গের নাম- ‘পূর্ণ-বিজয়’, "কৈলাস’, "সরলা”, "রামচন্দ্র’। এই কাব্যটি সম্পর্কে লেখক সুকুমার সেন লিখেন,

""কাব্যটি পয়ার ছন্দে লেখা চার সর্গে গাথা। সর্গগুলির বিষয় যথাক্রমে কবির প্রথম পত্নী ও তিন বাল্যবন্ধুর স্মৃতি বেদনা। রচনারীতি ঈশ্বরগুপ্তীয়। কাব্যটিতে দেশের ও সাহিত্যের প্রতি কবির গভীর অনুরাগের প্রকাশ আছে।''

লেখকবিহারীলাল রচিত ‘নিসর্গ-সন্দর্শন’ কাব্যটিও ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দেই ‘অবোধবন্ধু’ নামক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই কাব্য সাতটি সর্গে বিন্যস্ত। যথাক্রমে- ‘চিন্তা’, "সমুদ্রদর্শন’, "বীরাঙ্গনা’, "নভোমণ্ডল’, "ঝটিকা রজনী’, "ঝটিকা সম্ভোগ’ এবং ‘প্রভাত’। নিসর্গের নাম- চিত্র, সমুদ্রদর্শন, নভোমণ্ডল, ঝটিকা রজনী, ঝটিকা সম্ভোগ প্রভৃতি প্রকৃতির বিবরণ এককথায় অভূতপূর্ব। ‘নিসর্গ-সন্দর্শন’ কাব্যটিতে কবি বিহারীলাল জড় প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেন। প্রাণহীন প্রকৃতিকে একটা পৃথক ব্যক্তিত্ব দিয়ে তার সঙ্গে চেতন কবি-প্রাণের সম্পর্ক স্থাপন যা লীরিক কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার স্বাদ প্রথমেই পাওয়া যায় লেখক বিহারীলালের এই কাব্য সৃষ্টিতে। লেখক সুকুমার সেন সেই কাব্য প্রসঙ্গে লিখেছেন –

“একদা (১৬ই কার্তিক ১২৭৪ সাল) রাত্রিকালে দেশে যে ভীষণ ঝড় বহিয়া গিয়াছিল তাহা কাব্যটির শেষ তিন সর্গের বিষয়। ছন্দ চার ছত্রের পয়ার স্তবক, প্রথম-তৃতীয় ও দ্বিতীয়-চতুর্থ ছত্রে মিল।''

দ্বিতীয় সর্গ ‘সমুদ্র-দর্শনে’ কবি বিহারীলাল সমুদ্রের কূলে দাঁড়িয়ে রামায়ণ কাহিনি স্মরণ করে

 পরাধীনতার বেদনা ব্যক্ত করেছেন-
তোমারি হৃদয়ে রাজে ইংলন্ড দ্বীপ,
হয়েছে জগত – মন যাহার মাধুরী,
শোভে যেন রক্ষ কুল উজ্জ্বল প্রদীপ,
রাবণের মোহিনী কনক-লঙ্কাপুরী।
এদেশেতে রঘুবীর বেঁচে নাই আর,
তাঁর তেজোলক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে তিরোহিতা
কপটে অনাসে এসে রাক্ষস দুর্বার
হরিয়াছে আমাদের স্বাধীনতা-সীতা। ( স্তবক ২৪-২৫ )

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিহারীলালের পাঁচ সর্গে রচিত ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ কাব্যটি ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সর্গগুলো হলো- ‘পতন’, "বিরাগ’, "বিষাদ’, "অন্বেষণ’, "নির্বাণ’। লেখক সুকুমার সেন এই কাব্য সম্বন্ধে অবগত করান,""কাব্যের মর্মকথা, সংসারে আসল প্রেমের মর্যাদা নাই বুঝিয়া কবি যখন হতাশায় নিমগ্ন, তখন অকস্মাৎ তাঁহার চিত্তে দৈবী আনন্দের স্ফুরণ হইয়াছিল। …. প্রেমবাহিনী কবিচিত্তের প্রথম জাগরণের ইতিহাস।'' কাব্যের দৃষ্টান্ত-         

আজি বিশ্ব আলো কার কিরণ নিকরে,
হৃদয় উথলে কার জয়ধ্বনি করে।
ক্রমে ক্রমে নিবিতেছে লোকে কোলাহল,
ললিত বাঁশরী তান উঠিছে কেবল।

১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লেখক বিহারীলাল পাঁচটি সর্গে অন্তরঙ্গ কাব্য ‘সারদামঙ্গল’ রচনা করেন। ‘সারদামঙ্গল’ বর্তমান বাংলা কাব্যসাহিত্যের একটি স্মারক চিহ্ন। কবি-মানসীর এক স্মরণীয় আলেখ্য, যার প্রভাবে পরবর্তীকালে লেখক বিহারীলালের শিষ্যবৃন্দরা এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন। এই কাব্য রচনার জন্য কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী উনিশ শতকের গীতিকবিদের গুরু হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন। পাশ্চাত্য রোমান্টিক ও মীষ্টিক কবিদের সমধর্মী বলে মর্যাদা পেয়েছেন। ‘সারদামঙ্গল’এর প্রারম্ভে আখ্যান কাব্যের ঘটনার বিবৃতি লক্ষ্য করা যায়। রামায়ণে বর্ণিত বাল্মীকি যেমন ক্রৌঞ্চ-মিথুনের শোকের বশে সরস্বতীর কৃপায় শ্লোক রচনা করেছিলেন, তেমন ভাবে কবিও দেবী সরস্বতীর প্রসাদ প্রার্থনা করেছেন- কাব্যের শুরু এইভাবেই হয়েছে। তারপর দেবী সরস্বতীর সঙ্গে কবির মিলন-বিরহের আনন্দ বেদনাময় অশ্রু ভাবাতুর মুহুর্তগুলি এই কাব্যে রোমান্সের ও একই সঙ্গে অতিন্দ্রীয় জগতের অনির্বচনীয় ভাব প্রকাশের ব্যঞ্জনায় সার্থকতম রচনা হয়ে উঠেছে। বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’এর শিল্পসৌন্দর্য সম্বন্ধে মন্তব্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-

“সূর্যাস্তকালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মতো সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয় কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না, অথচ সুদূর সৌন্দর্যস্বর্গ হইতে একটি অপূর্ব রাগিনী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।''
অর্থাৎ তাঁর কল্পনা তাঁর কবিসত্তাকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করেছিল।
বিহারীলালের গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার বিহারীলাল সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন-      
এসেছিলে শুধু গায়িতে প্রভাতী,
না ফুটিতে ঊষা, না পোহাতে রাতি,
আঁধারে আলোকে প্রেমে মোহে গাঁথি,
কুহরিলে ঘীরে ধীরে।।
ঘুমঘোরে প্রাণী ভাবি স্বপ্নবাণী
ঘুমাইল পার্শ্ব ফিরে।।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিহারীলালের ‘সাধের আসন’ কাব্যটি রচিত হয়। কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে বিহারীলালের বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী বিহারীলালের অনুরক্ত পাঠিকা ছিলেন। কবি বিহারীলাল তাঁকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে একটি কার্পেটের আসন তৈরি করে তাতে ‘সারদা মঙ্গল’ কাব্যের দুটি পংক্তি বুনে উপহার দেন। এই দুটি পংক্তিতে একটি প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্নটি এই- ""হে যোগেন্দ্র ! যোগাসনে, ঢুলু ঢুলু দু নয়নে বিভোর বিহ্বল প্রাণে কাঁহারে ধেয়াও ?”- কাদম্বরী দেবী এই প্রশ্নে কবির সারদার ধ্যানমূর্তির স্বরূপ ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। কবিও অন্য একটি কাব্য লিখে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুত ছিলেন। কিন্তু কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলে কবি বিহারীলাল অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং শীঘ্রই ভক্ত পাঠিকার উদ্দেশ্যে ‘সাধের আসন’ নামে কাব্য রচনা করেন। কাদম্বরী দেবীর দেওয়া কার্পেটের আসনই এই কাব্যের উৎস ছিল বলে কবি কাব্যের নামকরণ করেন ‘সাধের আসন’।

এছাড়াও লেখক বিহারীলালের জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় কিছু অপ্রকাশিত রচনা কবির নামে পাওয়া যায়। সেগুলি হলো- ‘মায়াদেবী’, "শরৎকাল’, "ধূমকেতু’, "দেবরাণী’, "বাউল বিংশতি’, "কবিতা ও সংগীত’। বাংলা কাব্যে বিহারীলালের অভিনবত্বের প্রধান কারণ কবির স্বভাব একান্তই গীতিকবিতাময়। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ কবি বিহারীলালকে ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেন।   
লেখক বিহারীলাল ছিলেন আধুনিক রোমান্টিক গীতিকবিতার পথপ্রদর্শক। সুকুমার সেনের মতে, "আধুনিক বাঙ্গালা অন্তরঙ্গ গীতিকাব্যের প্রবর্তক তিনিই।'বিহারীলালের কাব্যধারায় তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বিদ্যমান। তাই মানস মজুমদার লিখেন,""সবচেয়ে বড়ো কথা, গীতিকবিতা হিসেবে মধু-হেম-নবীনের সঙ্গে বিহারীলালের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। মধু-হেম-নবীন এ জাতীয় কবিতায় জীবনকে দেখেছেন বাইরে থেকে, বিহারীলাল জীবনকে দেখেছেন অন্তরের যোগে। মধু-হেম-নবীন যেখানে জীবনের উপরিতলে বিহার করেছেন, বিহারীলাল সেখানে মনোগহনে ডুব দিয়েছেন। বিচিত্র এক ভাবের জগৎ গড়ে তুলেছেন। সে জগৎ সৌন্দর্য ও কল্পনাময়, অনাস্বাদিতপূর্ব জগৎ” (‘পরিচায়িকা অংশ: বিহারীলালের সারদা মঙ্গল: কবি ও কাব্য, দেবেশকুমার আচার্য্য)।   রবীন্দ্রনাথ লেখক বিহারীলালকে ‘বিহারীলাল’ প্রবন্ধে কাব্যগুরু আখ্যা দেন এবং গীতিকবিতার ইতিহাসে তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ অভিধায় ভূষিত করে লিখেন, ""সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের।''কবি বিহারীলালের গীতিকাব্যের প্রধান উপাদান হলো- প্রেম ও প্রকৃতি। এক্ষেত্রে তিনি কালিদাসের সহধর্মী। তবে ‘কালিদাস নৈর্বক্তিক, বিহারীলাল ব্যক্তিনিষ্ঠ’
(জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী, প্রাচীন ভারতীয় বাংলা ও বাঙালির উত্তরাধিকার, দ্বিতীয় খণ্ড )।" ‘সারদা মঙ্গল’ কাব্য বিহারীলালের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এই কাব্যটি রচনার জন্য তিনি বাংলা কাব্য জগতে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রেম, করুণা ও সৌন্দর্যের আদর্শমূর্তি সারদা রূপকের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে এই কাব্যে। অন্তরবাসিনী কাব্যলক্ষ্মীকে অন্তরের বাইরে বিচিত্র কল্পনায় যেভাবে এবং যেরূপে উপলব্ধি করেছিলেন তাকেই রূপ দিয়েছেন ‘সারদা মঙ্গল’কাব্যে।



মৃত্যু
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৯ বছর বয়সে লেখক বিহারীলাল চক্রবর্তীর দেহাবসান ঘটে।  







################₹###₹##₹###₹##@











No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। রুনা লায়লা । খ্যাতনামা বাংলাদেশী কণ্ঠশিল্পী। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সংগীতের জন্য বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশের বাইরে গজল শিল্পী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তাঁর সুনাম আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় এবং পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের অনেক গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। রুনা লায়লা বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, হিন্দি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচি, পশতু, ফার্সি, আরবি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি, লাতিন ও ইংরেজি ভাষাসহ মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন। Dt - 17.11.2024. Vol -1055. Sunday. The blogger post in literary e magazine.

রুনা লায়লা  (জন্ম: ১৭ নভেম্বর ১৯৫২ ----) একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশী কণ্ঠশিল্পী। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সংগীতের জন্য বিখ্যাত। ত...