১৯১৯ সালে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলায় দেশ উত্তাল হয়। ডায়ারের কীর্তি নিয়ে রামানন্দ তাঁর ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেন। সে সময়ে এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগের বিষয়ে দ্বিধায় পড়েন রবীন্দ্রনাথ। বিষয়টি নিয়ে তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও সিএফ অ্যান্ড্রুজের কাছে পরামর্শ চান। অ্যান্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথকে উপাধি ত্যাগ করতে নিষেধ করলেও, রামানন্দ উপাধি ত্যাগে অনুমোদন জানান। বন্ধু রামানন্দের পরামর্শই গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আসলে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম বলা যায় রামানন্দ চটোপাধ্যায় ও তাঁর ‘প্রবাসী’ পত্রিকাকে। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি বিষয়ক অনেক লেখা প্রকাশ পায় ওই পত্রিকায়। ১৯১৭-তে মন্টেগু-র আসার সময়ে তখন ভারতবর্ষে সংঘটিত হয়ে চলেছে একাধিক সভা-সমিতি। রামানন্দ বারে বারে রবীন্দ্রনাথকে তাড়া দিতেন দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে লিখতে। রবীন্দ্রনাথও সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি। ‘ছোট ও বড়’ জাতীয় একাধিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ সে সময়ে ‘প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-তে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও রামানন্দের এই আহ্বানকে স্বীকার করেছেন এক পত্রে (৫-১১-১৯১৭), ‘আপনি যদি এই সময়ে আমাকে একটু ধাক্কা না দিতেন তবে আমি এই শরৎকালের স্বচ্ছ অতল দিনগুলির মধ্যে ডুব মেরে নিছক নৈষ্কর্ম্ম্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতুম, আমার টিকি দেখা যেত না’। ওই চিঠিতেই তিনি লিখেছেন, ‘এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমান, হোমরুল, ইণ্টার্ণ্মেণ্ট্ প্রভৃতি কোনো কথাই বাদ পড়েনি।... হয়ত ছাপা হবার পূর্ব্বে একবার সভায় দাঁড়িয়ে পড়লে আসর গরম করা যেতে পারে। সে সম্বন্ধে যথাকালে আপনার পরামর্শ নেওয়া যেতে পার্ব্বে’।
প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-কে কেন্দ্র করে যে সব রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত, সে সবের জন্য রামানন্দের পিছনে সর্বদা গোয়েন্দা পুলিশ লেগে থাকত। তবে তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। কত বার যে রামানন্দকে সমস্ত ছাপা ‘ফর্মা’ পুড়িয়ে আবার নতুন করে ছাপতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনও দিন তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে মাথা নত করেননি। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বেশ কয়েক বার মতবিরোধ দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক বিষয়ে। এক বার সিটি কলেজের বিরুদ্ধে সুভাষ বসুর আক্রমণে রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হন। তিনি রামানন্দকে বলেন, ওই আচরণ নিয়ে নিন্দাসূচক কিছু লেখার জন্য। রামানন্দ সে সময়ে তা করেননি। রবীন্দ্রনাথ পরে সেটি জেনে লিখেছেন, ‘...কিন্তু তারপরেই মনে হয়েছিল প্রস্তাবটা সঙ্গত নয়। ... সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও অন্যায়কে আমি ক্ষমা করতে পারি নে এ আমার দুর্বলতা।... আপনি আমাকে অনুতাপের হাত থেকে রক্ষা করেছেন’। (২৫-০১-১৯৩৮)
এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এক খ্যাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে লেখা চিঠি রামানন্দের পত্রিকায় প্রকাশ করতে। কিন্তু রামানন্দ তা করেননি। রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন, ‘আপনি ওটা ছাপতে চান না শুনে আমি আরাম বোধ করলুম’। (১১-১০-১৯২৮)
একাধিক সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন কারণে যা করতে চেয়েছেন, শান্ত-বিচক্ষণ রামানন্দ তাঁর বিচারের ছাঁকনিতে ছেঁকে সে বিষয়ে তাঁকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন। এতে অবশ্য কোনও দিন রবীন্দ্রনাথ ক্ষুণ্ণ হননি। তাঁর উদার-চেতনায় বন্ধু রামানন্দ চিরকাল পরামর্শদাতা হয়েই থেকে গিয়েছেন। তাই কখনও দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়নি।
১৯১৭-তে অ্যানি বেসান্তকে নিয়ে যখন কংগ্রেসের সভাপতির পদ ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়, সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামানন্দের মতানৈক্য ঘটেছিল। রামানন্দ জাতীয় কংগ্রেসে অন্য দেশের মানুষের সভাপতিত্বকে গ্রহণ করতে পারেননি। এ নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে ঘরোয়া বিতর্কও তৈরি হয়। যারা বেসান্তের বিপক্ষে ছিলেন, তাঁরা ‘অভ্যর্থনা সমিতি’র সভাপতি করেন বৈকুণ্ঠনাথ সেনকে। যারা বেসান্তের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা ওই পদে ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে নিজের পক্ষে আনতে বহু চেষ্টা করেছিলেন। যদিও রামানন্দ নিজের মতে অটল ছিলেন। পরে দেখা যায়, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি করছিলেন, তারাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাখতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন এবং সে আসনে বসেন বৈকুণ্ঠনাথই। আসলে রামানন্দ জানতেন, রবীন্দ্রনাথের জায়গা দলাদলির রাজনীতিতে নয়, তাঁর আসন অনেক উপরে। তাই বারে বারেই রবীন্দ্রনাথকে সচেতন করতেন এ সব বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথও সে কথা মেনে নিতেন নির্দ্বিধায়।
বয়সে বড় হয়েও রবীন্দ্রনাথ রামানন্দের ভাবনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। আসলে পথ যেখানে সত্য, সেখানেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মিল। তাই কখনও কখনও অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেলেও শুধরে দিয়েছেন বন্ধু রামানন্দ। উদার মনে তা মেনেও নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
অন্যান্য মনীষীদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের বহু লেখা ও গান প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ-তে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবাসীতে প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’ শীর্ষনামক প্রবন্ধে কবিগুরু লিখেছেন, “…স্বামী তার (স্ত্রীর) পক্ষে আইডিয়া। ব্যক্তির কাছে পাশববলে সে নত হয় না, আইডিয়ার কাছে ধর্মবলে সে আত্মসমর্পণ করে। …এই আইডিয়াল প্রেম হচ্ছে যথার্থ মুক্ত প্রেম। …এতদিন ভারতীয় সমাজের যে আধারের উপর তার বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই আধারের বিকৃতি হওয়ায় বিবাহের মূলগত ভাব ও তার ব্যবহার সব কিছুর সঙ্গে ঠিকমতো খাপ খাচ্ছে না।… এইজন্যে স্হিতির মধ্যে যে সম্পদ নারী তারই সাধনা করলে সার্থকতা লাভ করে।”
সমাজের সেবার কাজেও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনেক অবদান রয়েছে। ১৮৯৬ সালে উত্তর-পশ্চিম রাজ্যে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার ত্রাণকার্যের জন্য রামানন্দ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে একটি সেবাশ্রম চালু করেন। এলাহাবাদে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে, অনেকের নিষেধ সত্বেও রামানন্দ সেবাকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯০০ সালে এবং ১৯০৬ সালে যথাক্রমে অর্ধকুম্ভমেলা ও পূর্ণ কুম্ভমেলায় দুর্গত শিবির স্হাপন করেন। শান্তিনিকেতনে একটি নৈশ বিদ্যালয় স্হাপনের জন্য রামানন্দ অর্থ দান করেন। শান্তিনিকেতনে একটি স্কুল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়লে, রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে অর্থসংকট থেকে উদ্ধার করেন।
১৯৪৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এই মহামনীষী ও কর্মযোগীর মৃত্যু ঘটে
*""""""""""'''''''""""""########₹₹₹₹₹₹₹######
No comments:
Post a Comment