Wednesday, 5 June 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা।আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক ছিলেন। " পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ কথা। মৃত্যু আসে, চিরতরে পর্দা নামে কিন্তু স্পেনের বিষয়টি ভিন্ন, এখানে বরং মৃত্যু সব পর্দা, সব আড়াল সরিয়ে দিয়ে সবকিছু দৃশ্যমান করে তোলে।"।স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে জাতীয়বাদী কর্মিরা তাকে হত্যা করে, তার লাশ আর কখনও পাওয়া যায়নি। তাকে স্পেনে 'জনগণের কবি' বলে ডাকা হয়। Dt -05.06.2024. Vol -900. The blogger post in literary e magazine

" পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ কথা। মৃত্যু আসে, চিরতরে পর্দা নামে কিন্তু স্পেনের বিষয়টি ভিন্ন, এখানে বরং মৃত্যু সব পর্দা, সব আড়াল সরিয়ে দিয়ে সবকিছু দৃশ্যমান করে তোলে. "




ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা 
(স্পেনীয়: Federico García Lorca)
(১৮৯৯ সালের ৫ জুন - ১৯৩৬ সালে ২৯ আগষ্ট)

আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক । তিনি প্রজন্ম ২৭-এর সদস্য হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাঁর রচিত অসংখ্য রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিতময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের পাঠকদের কাছে এবং ধীরে ধীরে তাঁর কাব্য-সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে স্বতন্ত্র এক ধারায়। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে জাতীয়বাদী কর্মিরা তাকে হত্যা করে, তার লাশ আর কখনও পাওয়া যায়নি। তাকে স্পেনে 'জনগণের কবি' বলে ডাকা হয়।

                 জন্ম ১৮৯৯ সালের ৫ জুন স্পেনের প্রাচীন ঐতিহ্যময় শহর গ্রানাডা থেকে পাঁচ মাইল দূরে আন্দালুসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ছিলেন একজন জমিদার আর মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মূলত পিয়ানো বাজানো শেখাতেন। তাই খুব ছোটবেলায় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় লোরকার। সেই সুবাদে জনপ্রিয় গানগুলো গাইতে পারতেন শৈশবে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই বেশিরভাগ সময় কাটত বাড়ির আঙ্গিনায় আর পড়ার টেবিলে। দৈহিক পরিশ্রমে অপারগ ছিলেন বলে লোরকার নিকট স্বপ্নের জগতটা বেশ বড় হয়ে উঠে। স্পেনের পলস্নী জীবন, ষাঁড়ের লড়াই, প্রেম, জিপসিদের রোমান্টিক জীবন, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য সবকিছু সম্পর্কেই সম্যক একটি ধারণা পেয়েছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে তারা চলে আসেন বালদেরুবিয়ো শহরে। সেখান থেকে ১৯০৯ সালে গ্রানাডা শহরের উপকণ্ঠে উয়ের্তা দে সান বিসেন্তেয় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। লোরকার বয়স তখন ১১। যেসব জায়গায় লোরকা বসবাস করেছেন সর্বত্র প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছেন। পরবর্তীতে তার শিল্পচিন্তা ও লেখালেখিতে এর গভীর প্রভাব পড়েছিল।

১১ থেকে ১৬—এই ছয় বছর লোরকা পিয়ানো শেখেন আন্তোনিয়ো সেগুরা মেসা নামের এক সংগীতশিক্ষকের কাছে। মেসা লোরকার মধ্যে সংগীতজ্ঞ হওয়ার বাসনা জাগিয়ে তোলেন। পরে তার বন্ধুত্ব হয় সুরকার মানুয়েল দে ফাইয়ার সঙ্গে। আর তখন থেকে স্প্যানিয় লোকগীতি হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। 


ছোটবেলায় অসুস্থতার কারণে পড়াশোনায় কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়েন লোরকা। স্কুলশিক্ষা সমাপ্তির পর ১৯১৫ সালে লোরকা গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন ও সাহিত্য বিষয়ে। তবে সব প্রতিকূলতা উৎরে শেষপর্যন্ত তিনি আইনে স্নাতক করতে সক্ষম হন।
গ্রাডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার মনে জাগে ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা। ১৯১৬-১৭ সালব্যাপী তিনি স্পেনের উত্তরে কাস্তিয়া, লেয়োন ও গালিথিয়া ঘুরে বেড়ান দন ফের্নান্দো দে লোস রিয়োস নামের এক অধ্যাপকের সঙ্গে। এ অধ্যাপক তাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করেন। সে সময় তিনি লিখেন ভ্রমণবৃত্তান্ত ইমপ্রেসিয়োনেস ই পাইসাহেস বা মানচিত্র ও ভূদৃশ্যাবলি। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত বই (১৯১৮)। এর প্রকাশনায় অর্থ জুগিয়েছেন তার পিতা স্বয়ং।

১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদে চলে যান। সেখানে কাটিয়ে দেন পরবর্তী ১৫টি বছর। তার নতুন স্থান রেসিদেনসিয়া দে এস্তুদিয়ান্তে। এর সুবাদে তিনি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে থাকেন। এবার তার পাঠের বিষয় আইন ও দর্শন। কিন্তু কিছুদিন পরেই হাঁপিয়ে ওঠেন। পাঠ্যক্রমভুক্ত বিধিবদ্ধ পাঠে তার আর মন বসে না। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে তিনি আত্মনিয়োগ করেন শিল্পচর্চায়। মগ্ন থাকেন অভিনয়, কবিতাপাঠ ও প্রাচীন লোকগীতি সংগ্রহে। এ সময় এল মালেফিসিয়ো দে লা মারিপোসা বা প্রজাপতির দুরভিসন্ধি নামে একটি নাটক লিখে ফেলেন। ১৯২০ সালে সেটি মঞ্চস্থ হলে ঢি ঢি পড়ে যায়। কারণ, নাটকটি ছিল প্রচলিত ঘরানার বাইরে। এটি রচিত পোকামাকড়ের জীবন নিয়ে, মূলত একটি তেলাপোকা ও একটি প্রজাপতির মধ্যে ভালোবাসার কাহিনি। পরের বছর প্রকাশিত হয় তার লোককাহিনিভিত্তিক লিব্রো দে পোয়েমাস বা কবিতার বই। এতে এসেছে ধর্মীয় বিশ্বাস, একাকিত্ব ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ।

লোরকার ওপর ফ্লামেঙ্কো ও যাযাবর সংস্কৃতির প্রভূত প্রভাব পড়েছিল। এ জন্য তাদের কথা ঘুরেফিরে এসেছে তার লেখায়। ফ্লামেঙ্কো সংস্কৃতির প্রসারে ১৯২২ সালে তিনি প্রথম ‘কান্তে হোন্দো’ বা ‘গভীর গান’ উৎসব আয়োজন করেন। স্পেনের বিখ্যাত ডিপ সং গায়ক ও পিয়ানোবাদকেরা তাতে অংশ নেন। তিনি বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুর দিকে যেসব কবিতা লিখেছেন, তাতে গভীর গানের আদল খুঁজে পাওয়া যাবে। লোরকা ‘সাতাশের প্রজন্ম’ নামে একটি আভাঁ গার্দ শিল্পীসংঘে যোগ দেন। এই সংঘে ছিলেন সালভাদর দালি ও লুইস বুনুয়েলের মতো জাঁদরেল শিল্পীরা, যাঁরা তাকে পরাবাস্তববাদ ও প্রতীকবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ দুই শিল্পদর্শনের আশ্রয়ে তার কবিতা হয়ে ওঠে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময়, নান্দনিকতায় গূঢ়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তার কানসিয়োনেস বা গীতিমালা। ১৯২৮ সালে আলোর মুখ দেখে রোমান্সেরো হিতানো বা জিপসি গাথা। এ বই তাকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যায়।
কবিতার পাশাপাশি চলে তার নাট্যচর্চা। তার দ্বিতীয় নাটক মারিয়ানা পিনেদা ১৯২৭ সালে বার্সেলোনায় মঞ্চস্থ হলে বিপুল প্রশংসা কুড়ায়। পরের নাটক লা সাপাতেরা প্রোদিহিয়োসা বা মুচির আশ্চর্য বিবি একটি প্রহসন। তাতে চিত্রিত নারীর প্রতি গোপন প্রণয় ও স্খলনের কাহিনি।

লোরকা ১৯২৯ সালে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। ঘুরে বেড়ান হার্লেম ও ভের্মন্টে। তিনি কলাম্বিয়া স্কুল অব জেনারেল স্টাডিজে ভর্তি হন। বিষয় ইংরেজি। কিন্তু অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন লেখালেখি নিয়ে। কিছুদিন কিউবার হাভানাতেও কাটান। নিউইয়র্কে বসে তিনি যে কবিতাগুলো লেখেন, সেসব সংকলিত হয় পোয়েতা এন নুয়েভা ইয়র্ক বা নিউইয়র্কের কবিতা গ্রন্থে। বইটি অবশ্য প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পরে। এই গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোতে নাগরিক যন্ত্রণা ও একাকিত্ববোধ তীব্র হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘নিউ ইয়র্ক’ কবিতায় তিনি লেখেন (দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত নিউ ইয়র্কে কবি থেকে): 

‘এক ফোঁটা হাঁসের রক্তের
বহুগুণিতাঙ্কের নিচটাতে,...
কোমল রক্তের এক নদী।
যে নদী গান গেয়ে বয়ে চলে
 মহল্লার যত শয্যাঘর একে একে পিছে ফেলে পিছে ফেলে নিউইয়র্কের যত নকল ভোরের সিমেন্ট, বাতাস, টাকাকড়ি।’ 

তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ এবং এর ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দা। তার মনে পুঁজিবাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়। ধীরে ধীরে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

১৯৩০ সালে সেকেন্ড স্প্যানিশ রিপাবলিক ঘোষিত হলে লোরকা দেশে ফিরে আসেন। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে নাট্যবিষয়ক সংস্থা ‘বাররাকা’র পরিচালক পদে নিয়োগ দেন, যার কাজ সাধারণ জনগণের জন্য নাটক প্রণয়ন ও প্রদর্শন। তিনি গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বিনামূল্যে নাটক দেখাতে থাকেন। নিজে নাটক পরিচালনা করেন এবং তাতে অভিনয় করেন। বাররাকারতত্ত্বাবধানে স্প্যানীয় ক্লাসিকগুলো দেখানো হয়; লোরকার নিজের নাটকগুলোও স্থান পায়, বিশেষ করে তার ট্র্যাজেডিত্রয়—বোদাস দে সাংগ্রে বা রক্তবিবাহ, ইয়েরমা ও লা কাসা দে বেরনার্দা আলবা বা বেরনার্দা আলবার বাড়ি। কাব্যগুণে সমৃদ্ধ এই নাটকগুলোতে ধ্বনিত হয় বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তিনি শ্রেণি, নারী ও যৌনতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ট্যাবুশাসিত সমাজের মৌন ভেঙে দেন এবং সাধন করেন এক সামাজিক বিপ্লব। তার শেষ কাব্যগ্রন্থ সোনেতোস দে আমোর অস্কুরো বা তামসিক প্রেমের সনেট সমকামী ভালোবাসাকে ঘিরে নিষেধের বেড়াজাল চুরমার করে দেয়।


 সাহিত্যচিন্তা

 ১৮ বছরের কবিতা রচনা কে ৪ টি ধারায় ভাগ করা হয়:

১. প্রস্তুতির ও প্রাথমিক বছরগুলো (১৯১৮-১৯২৭)
২. জিপসি বালাদ (১৯২৬-২৮)
৩. নিউইয়র্কে লেখা কবিতা (১৯২৯-৩০)
৪. তার পরের কবিতা (১৯৩১-৩৬)

এর মধ্যে মৌলিক ও মূল্যবান হচ্ছে জিপসি বালাদ এবং নিউইয়র্কের কবিতা। মোটা দাগে জিপসি বালাদের মধ্যে লোরকা গীতলতা এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করে ঐতিহ্যগত লোকজ লোরকা নতুনত্ব ভরিয়ে দিলেন। নিউইয়র্কে লেখা কবিতাগুলোয়, যা পরে পোয়েতা এন নুয়েভা ইয়র্ক (নিউইয়র্কের কবিতা) কাব্য গ্রন্থে প্রকাশিত হয়, তিনি চিত্রকল্প এবং কোলাজ এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন আবার একই সঙ্গে সংগ্রথিত করেছেন যে এগুলো পরাবাস্তববাদী অভিধা প্রাপ্ত হয়ে উঠেছে।

"জন্ম যেমন আমাকে আলোড়িত করে না, তেমনি মৃত্যু নিয়েও কোনো উৎসাহ আমার নেই. "
লোরকা লিখেছিলেন:

কিন্তু এখন সে চিরনিদ্রিত
এখন তার কঙ্কাল ফুঁড়ে জন্ম
নেবে গুল্ম ও ঘাসফুল নিশ্চিত
এখন তার রক্তধারায় শোনা যাবে
আরাধ্য সংগীত

এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শেষ হতে তখনো অনেক দিন বাকি।

সেই কবিতায় খসখসে সবুজ উর্দি-পরা, জিভ-কাটা সেপাই রাইফেল হাতে কবিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ফসলকাটা মাঠের বধ্যভূমিতে, যেখানে হাজার হাজার নারীপুরুষ ভিড় করে দেখতে এসেছে ‘কবির মৃত্যু’: “কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে/ কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশী আগে বাজিয়ে/ কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে/ কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে/ কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে/ জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি/ যুবক এনেছে তার যুবতীকে/ বৃদ্ধ ছুঁয়ে আছে বৃদ্ধতরের কাঁধ...” বন্দি কবি আর কিছু বলেন না স্রেফ ওঁর হাতের শৃঙ্খল খুলে দেওয়া ছাড়া, বৈজ্ঞানিক কসাই আদার ব্যাপারি এমএলএ ভিখিরি বাদামওয়ালা চাষি পকেটমার শিক্ষিকা জনমজুরে ভরা জনতার ভিড় ছাড়িয়ে তাঁর চোখ চলে যায় অরণ্যের দিকে, যেখানে ছেলেবেলার বাতাবিলেবু গাছের সঙ্গে মিশে যায় হেমন্তদিনের শেষ আলো, আর ‘অস্ফুট হৃষ্টতায়’ নড়ে ওঠে তাঁর ঠোঁট: “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও/ প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব।” প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, দ্বিতীয়তে তাঁর বুক ফুটো হয়ে যায়, একে একে কণ্ঠ, কপাল, বুকের উপরে রাখা ডান হাত ছিন্নভিন্ন, সে হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি শান্ত ভাবে বলেন, “বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!”

এমনটা যে হয়নি, কবির মৃত্যু না দেখেও, সেই সময়ে না থেকেও জানি আমরা। গ্রানাদার যে খামারবাড়ি হয়ে উঠেছিল লোরকা পরিবারের নিয়মিত গ্রীষ্মাবাস, স্পেনে গণতন্ত্রী রিপাবলিকান আর দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী ফ্রাঙ্কোর দলবলের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা গৃহযুদ্ধ থেকে ‘বাঁচতে’ মাদ্রিদ ছেড়ে সেই বাড়িতেই চলে আসেন লোরকা। বাঁচতে পারেননি, এক পড়শির বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পরেও না। কারা তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল, লেখা আছে ইতিহাসে। কেউকেটা কেউ নয়, বরং পাড়ার চেনা লোক সব, এমনকি আত্মীয়ও কেউ কেউ। এমনই তো হয় কালবেলায়। যে লোকটা আমার মতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, যার প্রতি আমার অন্য ব্যক্তিগত ঘেন্নাও দগদগে, ধরো তাকে। মারো, শেষ করে ফেলো। আজও তো চার দিকে হয়ে চলেছে একই ঘটনা। ‘ট্র্যাজেডি’ আর ‘পেথস’ এক জিনিস নয়, লোরকার মৃত্যুর পূর্বাপর খতিয়ে দেখলে তা ‘ট্র্যাজিক’ নয়, ‘প্যাথেটিক’ বলেই মনে হয়। এ প্রশ্নও জাগে, যে মানুষটা আগাম সঙ্কেত পাচ্ছিলেন যে তাঁর স্বদেশে গণতন্ত্রী আর ফ্যাসিস্টদের গৃহযুদ্ধে দ্বিতীয়টিরই ছায়া ঘনাচ্ছে তাঁর চার দিকে, তখন তিনি অন্য কোথাও চলে গেলেন না কেন? অল্প কিছু দিনের বসবাসেই যে নিউ ইয়র্কের হারলেম তাঁর মনকে আরাম দিয়েছিল, সেই আমেরিকায় তো চলে যেতে পারতেন তিনি! কিংবা তাঁর বন্ধুু সালভাদর দালির প্রাণের শহর প্যারিসে, বা অন্তত আর্জেন্টিনায়, কিউবায়— যেখানে তাঁর নাটক আর কবিতার কদর হয়েছিল খুব, যেখানে পাওয়া যেত সমমন, সহমানসিকতা ?

জাত লেখকের প্রমাণ দেশ-কাল নির্বিশেষে তাঁর সৃষ্টির ছড়িয়ে পড়া, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মাটিতে তার ফুটে ওঠা। যে কারণে শেক্সপিয়র বা ব্রেশট অভিনীত হয় আজও, কোথায় কে আজও গেয়ে ওঠে উপনিষদ বা ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’। সংস্কৃতি-সচেতন বাঙালি তথা ভারতীয় এ ভাবেই আপন করে নিয়েছেন লোরকাকেও— থিয়েটারে, সিনেমায়। গোবিন্দ নিহালনির ‘তমস’, ‘অঙ্কুর’, ‘আক্রোশ’ নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার সিকিভাগও হয় কি ১৯৯১-এর ছবি ‘রুক্‌মাবতী কী হাভেলি’ নিয়ে? ইউটিউবে আছে গোটা ছবিটা, দেখেছি ক’জন? দেখলেও মনে কি রেখেছি তার শিকড়— লোরকার লেখা ‘বের্নার্দা আলবার বাড়ি’ নাটকটা? গ্রামের এক বাড়িতে পাঁচ মেয়ে আর পরিচারিকা নিয়ে থাকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ, রক্ষণশীল এক মা। মেয়েরা সোমত্ত হয়েছে, তবু বিয়ে দেয় না। কড়া শাসনে রাখে, স্বামীর মৃত্যুর পর কয়েক বছরের বাধ্যতামূলক শোকপালন চাপিয়ে দেয় তাদের উপর। এ বাড়িতে তাঁর কথাই শেষ কথা। সত্যিই কি তা-ই? ছোট মেয়ে বিদ্রোহ করে, প্রেম করাই তার বিদ্রোহ। দমন ও অবদমনের, শাসন ও দ্রোহের টানাপড়েনে সম্ভাবনাময় জীবনের কোন পরিণতি হয়, তুলে ধরে এ নাটক। গোবিন্দ নিহালনির ছবিতে স্পেন হয়ে ওঠে আমাদের রাজস্থান, মরুগ্রামের পাথুরে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এনে ফেলেন তিনি লোরকার নাটককে। বের্নার্দা আলবা হয়ে ওঠে রুক্‌মাবতী, পাঁচ বোন আঙ্গুস্তিয়াস-মাগদালেনা-মার্তিরিও-আমেলিয়া-আদেলাকে সাবিত্রী-দময়ন্তী-মুমল-চন্দ্রা-পদ্মা (দু’ক্ষেত্রেই নামের নিহিতার্থ লক্ষণীয়) বলে ভাবতে অসুবিধে হয় না বিন্দুমাত্র। উত্তরা বাওকর, ইলা অরুণ, পল্লবী জোশী, জ্যোতি সুভাষদের অভিনয় দেখতে দেখতে মনে হয় কোথায় লোরকার স্পেন, এ তো আমার, আমাদের দেশের গল্প। আজও। পরিচালকের এক সাক্ষাৎকারেও পড়ছিলাম, স্পেনের এক কলেজে এই ছবিটি দেখানোর পর সেখানকার পড়ুয়াদের মনে হয়েছিল ‘রুক্‌মাবতী কী হাভেলি’ আদ্যন্ত ভারতের, ভারতীয় ছবি একটি।









=================!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!{=====












No comments: