(৬ জুন ১৯১১ - ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)
১৯১১ সালের ৬ই জুন তৎকালীন যশোরের (বর্তমান নড়াইল জেলার) লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয়।তার পিতা-মাতার নাম সত্যরঞ্জন গুপ্ত এবং লবঙ্গলতা দেবী। তিনি শৈশবকাল অতিবাহিত করেন কলকাতায়।
পিতার স্থানান্তরিত চাকুরীর কারণে তিনি অনেক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তন্মধ্যে গাইবান্দা উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম। ১৯৩০ সালে কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন অর্জন করেন। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আই.এসসি ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি কলকাতায় কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ (তৎকালীন কারমাইকেল স্কুল) থেকে ডাক্তারি বিদ্যায় কৃতকার্য হন।এরপর তিনি লন্ডন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তার বড় বোন পোকার কামড়ে মারা যায়। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে এই রোগ সাড়ানোর জন্য স্বপ্ন দেখেন ও পরবর্তী জীবনে বাস্তবায়িত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হন। এরপর তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। এই চাকুরীর সূত্রে তিনি চট্টগ্রাম, বার্মা (বর্তমানঃ মায়ানমার) থেকে মিশর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষ ডিগ্রী অর্জন শেষে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। এরপর তিনি ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ও তার পরিবার স্থায়ীভাবে কলকাতায় অভিবাসিত হন।
নীহাররঞ্জনের স্ত্রী কনক এবং চার মেয়ে ছিল। তার বাড়ির নাম ছিল উল্কা, তারই এক কাহিনির নামে। রবিবার ছাড়া বাকি দিনগুলো তিনি শ্যামবাজার স্ট্রিটের (পরে ধর্মতলা স্ট্রিটে) চিকিৎসকের চেম্বার, লেখালেখি, পূজা, পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া, আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।লেখালেখি করতেন দুপুরবেলা।] তিনি সিগারেট খেতেন। প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ বলেন তিনি রোজ এক টিন ‘পিকাডেলি’ সিগারেট খেতেন, পরে ‘পিকাডেলি’র চালান বন্ধ হতে ‘গোল্ডফ্লেক’ খেতেন। তবে হৃদ গোলযোগের কারণে ডাক্তার ধূমপান নিষেধ করায় একদিনেই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেন। তার পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। ব্যক্তিগতভাবে কোনারকের সূর্যমন্দির, পুরী আর বারাণসী পছন্দের গন্তব্য ছিল তার।
বাংলাদেশের জন্মস্থানের প্রতি তীব্র ভালোবাসা কাজ করতো। বাড়ির নাম ছিল ‘আনন্দ অন্নদা কুটির’। তিনটি ভবন রয়েছে সেখানে, যার মাঝেরটি দোতলা। নীচতলার বারান্দার ভিতরের কপাটহীন দরজার উপরে দেয়ালে বাড়ির নাম লেখা ছিল। বাড়িটি বর্তমানে সরকারি সম্পত্তির অধীনে। নীহাররঞ্জনের আত্মীয় কেউ সেখানে থাকেন না।তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখতেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীহাররঞ্জনের সাথে একবার দেখা করেন।
শৈশবকাল থেকেই তিনি সর্বদাই স্বপ্ন দেখতেন লেখক হবার। কলকাতায় গেলে পরে বইপাড়ায় আশুতোষ লাইব্রেরি নামক ছোটদের বইয়ের একটি গ্রন্থাগারের শিশুসাথী নামে একটি পত্রিকা ছিল। আইএসসি পড়াকালীন নীহাররঞ্জন সেখানে একটি গল্প পাঠালেন যা মনোনিত ও পরে ছাপা হয়। ছাপা পত্রিকার সংখ্যা তাকে পাঠিয়ে সম্পাদক আরও লেখা চাইলেন ও একদিন দেখা করতে বলেন। দেখা করার পরে সম্পাদক তাকে পাঁচ টাকা সম্মানী দেন। এরপরে সেখানেই তিনি তার রাজকুমার শীর্ষক ধারাবাহিক উপন্যাস লেখেন। এটাই তার লেখা প্রথম উপন্যাস। তখন তার বয়স ১৮। তার মা তাকে সর্বদা লেখালেখির জন্য উৎসাহিত করতেন। কলকাতায় আসার আগে তাকে বলেন, “খোকা, ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছিস যা, তবে লেখা ছাড়িস না, লেখার অভ্যাস ছাড়িস না।”
একসময় তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণসহ তার স্বাক্ষর বা অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন।অবস্থানকালীন সময়ে তিনি গোয়েন্দা গল্প রচনায় আগ্রহান্বিত হয়ে স্বীয় লেখার উত্তরণ ঘটান এবং আগাথা ক্রিস্টির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি তার ১ম গোয়েন্দা উপন্যাস কালোভ্রমর রচনা করেন। এতে তিনি গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে কিরীটী রায়কে সংযোজন করেন যা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। পরবর্তীতে কিরীটী তীব্র জনপ্রিয়তা পায় বাঙালি পাঠকমহলে। তিনি বাংলা সাহিত্যে রহস্য কাহিনী রচনার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক ছিলেন।
উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপট ও উপযোগী করে রচিত হয়েছে তার রহস্য উপন্যাসগুলো। বর্মা বা অধুনা মায়ানমার দেশের কথা বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে তার রচনায়। এ পর্যন্ত প্রায় পঁয়তাল্লিশটি উপন্যাসকে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়ণ করা হয়েছে যথাক্রমে টলিউড ও বলিউডের চলচ্চিত্রাঙ্গনে।এছাড়াও তিনি শিশুদের উপযোগী সাহিত্য পত্রিকা সবুজ সাহিত্যের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
খ্যাতনামা অভিনেতা উত্তম কুমার নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাছে কিরীটী রায়ের ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন।[৫] তবে নীহাররঞ্জন রাজি হননি, কারণ উত্তমকে কিরীটীর চরিত্রে মানাবে না বলে তিনি মনে করেছিলেন।[১১] তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিরীটী চরিত্রের জন্য মনে মনে ভাবতেন।
মায়া মৃগা (1960)
থাই কারুলু (1962) [ থায়িন করুনাই (তামিল) হিসাবে পুনর্নির্মিত] - উলকা [7]
আনাই (1962) [1960 সালের বাংলা চলচ্চিত্র মায়া মৃগা এর রিমেক]
মেরি সুরত তেরি আঁখেন (1963) – উলকা [8]
উত্তর ফাল্গুনী (1963) ( মমতা , কাবিয়া থালাইভি এবং পুষ্পাঞ্জলির চরিত্রে পুনর্নির্মিত ) [9]
বাদশা (1963)
তাপসী (বাংলা -1965)
লাডলা (1966) (1960 সালের বাংলা চলচ্চিত্র মায়া মৃগা এর রিমেক)
মেরে লাল (1966) (বাংলা চলচ্চিত্র বাদশার রিমেক)
নাই রোশনি (1967) ( পুভম পটাম এবং পুণ্যবতী হিসাবে পুনর্নির্মিত )
দেব মাগান (1969) [ থাই মামাথে (কন্নড়) এবং রক্ত সম্বন্ধম (তেলেগু) হিসাবে পুনঃনির্মিত] - উলকা
দেবরা কান্নু (1975) [ আনান ওরু কোয়েল , এল্লাম নিনাক্কু ভেন্ডি এবং বাঙ্গারু চেল্লেলু (তেলেগু) হিসাবে পুনর্নির্মিত]
দো আনজানে (1976) ( মাওয়ারী মনচিতানাম এবং আসিয়া বালে হিসাবে পুনঃনির্মিত ) – রাত্রির যাত্রী [১০]
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (1981) [11]
লালু ভুলু (1983)
কিরীটী ও কালো ভ্রমর (2016) [12]
কিরীটী রায় (2016)
এবং কিরিটি (2017)
নীলাচলি কিরীটী (2018)
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান ইটনায় অবস্থিত নীহাররঞ্জন গুপ্তের বাসভবনে শিশুস্বর্গ-২ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৪ নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে নড়াইলের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এস এম সুলতানের মৃত্যুর পর শিশু সংগঠনের কর্মীরা তা দখল করে। ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নীহাররঞ্জন গুপ্তের বাসভবন অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী হয়। কিন্তু, অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
‘‘আমি অনেক রহস্যকাহিনি রচনা করেছি। এর মূলে আছে আমার জীবনে দেখা দুটি ঘটনা। যা, বিশেষ করে দ্বিতীয়টি, মনকে নাড়া দিয়েছিল সাঙ্ঘাতিক ভাবে। এবং সেটা আমার প্রথম যৌবনকাল।’’
এ কাহিনি আমাদেরই পাড়ার। এক পোড়ো জমিদারবাড়ির সত্যিকারের ঘটনা। ও বাড়িতে এক নিঝুম দুপুরে খুন হয়ে যান বাড়ির বউমা। অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা সেই রমণীকে গুলি করে খুন করে তার সুপুরুষ দেওর। সে আবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বউদিকে খুন করে নিজেকেও রেওয়াত করেনি। ওই বন্দুকেরই গুলিতে শেষ করে দেয় নিজেকেও।
বাবা লিখেছেন, ‘‘ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে দুটি দেহ। চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কে বুঝি সাদা পাথরের মেঝের ওপর মুঠো মুঠো রক্তগোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশে পড়ে দোনলা বন্দুকটা।’’
প্রথম ঘটনা এটিই। দ্বিতীয়টি বাবার বাল্যকালের সময়। বাবা লিখেছেন, ‘‘সেটি মর্মন্তুদ হলেও তার মধ্যে তেমন রহস্যের ইশারা ছিল না। সেটি ছিল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা।’’
দুটি ঘটনারই কেন্দ্রে অসামান্যা রূপসী দুই যুবতী নারী, অবৈধ ত্রিকোণ প্রেম, পরিণতিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
দ্বিতীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে বাবা লিখেছিলেন, ‘‘কেউ জানতেও পারল না, মেয়েটি তার গোপন ভালবাসার জন্যই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।’’
সকলের অজ্ঞাতে সেই মৃত্যুর কারণ বহু দিন বাবার মনের মধ্যে অস্বস্তির একটা বাতাবরণ তৈরি করত। বাবা লিখছেন, ‘‘পরবর্তী কালে আমার প্রথম যৌবনে জমিদারিবাড়ির নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘জোড়া খুন’ রহস্য কাহিনি রচনা করতে।’’
এই কাহিনি রচনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল কিরীটী রায়ের ভ্রূণ।
কিরীটী-জন্মের পূর্বশর্ত হিসেবে যদি কাজ করে থাকে এ দু’টি কাহিনি, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই গোয়েন্দা কাহিনি-লেখক পাঁচকড়ি দে। বাবার কথাতেই বলি, ‘‘ইতিপূর্বে পাঁচকড়ি দে’র খানকয়েক রহস্য উপন্যাস পড়েও ক্রাইমজগতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল। কেবল পরিচয়ই নয়, মনের মধ্যে কিছুটা রোমাঞ্চও সৃষ্টি করেছিল। ... গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে রীতিমতো যেন একটা রোমাঞ্চকর আকর্ষণ অনুভব করতাম।’’
==========∆∆∆∆∆∆∆∆∆===========
No comments:
Post a Comment