Wednesday, 26 June 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। সাহিত্য সম্রাট উপাধি পান। Dt -26.06.2024. Vol - 920. The blogger post in literary e magazine



বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 (২৬ জুন ১৮৩৮ – ৮ এপ্রিল ১৮৯৪)


উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। সাহিত্য সম্রাট উপাধি পান। 

            জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়ার রঘুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিবাহ করেন৷ রামজীবনের পুত্র তথা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র,মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী,বঙ্কিমের পূর্বে তার আরও দুই পুত্রের জন্ম হয় – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কনিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তার গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” 

১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন।১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল।


কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তার বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৯ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।


তাঁর বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্‌টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং বাঙলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন‍্যতম মুখ হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত।


বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ে হয় ১৮৪৯ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১১ বছর। নারায়নপুর গ্রামের এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু চাকুরি জীবনের শুরুতে যশোর অবস্থান কালে ১৮৫৯ সালে এ পত্নীর মৃত্যু হয়। অতঃপর ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।


কর্মজীবন : 

যশোর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের তারিখ: ১৮৫৮, ৭ আগস্ট

নেগুয়া (মেদিনীপুর) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ ফেব্রুয়ারি

খুলনা - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ নভেম্বর

বারুইপুর (২৪ পরগনা) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬৪, ৫ মার্চ

মুর্শিদাবাদ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - উচ্চতর কার্যভার গ্রহণের তারিখ: ১৮৬৯, ১৫ ডিসেম্বর।

মুর্শিদাবাদ - কালেক্টর - পদোন্নতির তারিখ: ১৮৭১, ১০ জুন।

কলিকাতা - বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারি - যোগদানের তারিখ: ১৮৮১, ৪ সেপ্টেম্বর।

আলিপুর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮২, ২৬ জানুয়ারি।

জাজপুর (কটক) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ৮ আগস্ট।

হাওড়া - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি।

ঝিনাইদহ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৫, ১ জুলাই।[১৪]

অবসর গ্রহণের তারিখ: ১৮৯১, ১৪ সেপ্টেম্বর।

তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ১৮৯১ সালে ‘রায়বাহাদুর’ এবং ১৮৯৪ সালে ‘Companion of the Most Eminent Order of the Indian Empire’ (CMEOIE) উপাধি প্রদান করে। 

চবিবশ পরগনা জেলার বারুইপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম দুটি বিখ্যাত উপন্যাস দূর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) ও কপালকুন্ডলা (১৮৬৬) রচনা করেন। উপন্যাস দুটি দ্রুত প্রচার লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালের মধ্যে তাঁর অন্যান্য গদ্য রচনাসহ মোট চৌদ্দটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ১৮৮০ থেকে বঙ্কিমমনীষা রাজনীতি ও ধর্মের দিকে অগ্রসর হয়। কারণ সেসময় তিনি একজন পুনরুত্থানবাদী সংস্কারক হওয়ার চেষ্টা করেন। আনন্দমঠ (১৮৮২) সম্ভবত বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। পরবর্তীকালে তাঁর সব চিন্তা ধর্মীয় পূনরুত্থান ও জাতীয় নবজাগরণের কর্মকান্ডে আবর্তিত হয়। এ সময় থেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদ ও লেখকের চেয়ে একজন দেশপ্রেমিক ও গর্বিত হিন্দু বলেই বেশি মনে হতো। তাঁর জীবন তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর সৃষ্টিশীলতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলেছে।


বাংলা উপন্যাস ও বাংলা গদ্য সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর পূর্বে বাংলা উপন্যাস বলতে যা বোঝাত তা ছিল কতিপয় সংস্কৃত নাটক ও গল্প এবং কিছু ফারসি ও আরবি গল্পের অনুবাদ এবং সেগুলি ছিল প্রধানত শিক্ষামূলক ও নীতিমূলক। সেসব উপন্যাসের মূল লক্ষ্য ছিল কাব্যচর্চা, প্রকৃতির পূঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, মানবীয় সৌন্দর্যের অযৌক্তিক উপস্থাপনা, অবিরাম কাল্পনিক ঘটনার বিবরণ এবং বিস্ময়কর ও অতিপ্রাকৃত বিষয়ের বর্ণনা। রচনারীতি ও গদ্যশৈলীর দিক থেকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবু বিলাস (১৮২৩) এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) ছিল আধুনিক সাহিত্যের ধারায় দুটি ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। চরিত্রচিত্রণ, শিল্পসৃজন, বর্ণনা, নান্দনিকতা এবং সর্বোপরি বাংলা গদ্যের উৎকর্ষ সাধনে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যকে এমন একটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বিকশিত হয়েছে বিশ শতকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।

বাংলা সাময়িকী সাহিত্যের প্রসারেও বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অসামান্য। তাঁর সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকার মাধ্যমে একটি নতুন লেখকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা সাময়িকী সাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত এবং রচনাশৈলীর দিক থেকে এক নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। সমাচার দর্পণ, সংবাদ প্রভাকর, সম্বাদ কৌমুদী এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা রচনাশৈলীর যে ধারা সৃষ্টি করেছিল, বঙ্কিমচন্দ্র তার পরিবর্তন করে ভিন্নধর্মী সমালোচনার ধারা সৃষ্টি করেন, যদিও অতীতের মতো ধর্মীয় আলোচনা ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ‘কৃষ্ণচরিত’, ‘ধর্মতত্ত্ব’ ও ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ নামে মনোগ্রাফ আকারে ধারাবাহিকভাবে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়। তবে এ থেকে এরূপ মনে করার কোন অবকাশ নেই যে, বঙ্কিমচন্দ্র একজন হিন্দুধর্ম-প্রচারক ছিলেন। তাঁর সফল কয়েকটি উপন্যাস বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র ইউরোপীয় জার্নালের মতো সমালোচনার মঞ্চ হিসেবে বঙ্গদর্শনকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক অন্যান্য অনেক সাময়িকীর মতো বঙ্গদর্শনও খুব অল্প সময়, মাত্র চার বছর (১৮৭২-১৮৭৬) স্থায়ী হয়েছিল।

সাহিত্য জীবনের শেষ দিকে বঙ্কিমচন্দ্রকে সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার চেয়ে হিন্দুধর্মের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রতিই বেশি মনোযোগী মনে হয়েছে। ১৮৮০-র দিকে স্পষ্টতই তিনি সাহিত্যচর্চার চেয়ে ধর্মচর্চার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। তিনি প্রাচীন ভারতের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। তাঁর এ ধারণা আনন্দমঠ (১৮৮২) ও দেবী চৌধুরাণী (১৮৮২) গ্রন্থে এবং ধর্মশাস্ত্র ও গীতার ভাষ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি নব্য হিন্দুবাদের একজন সংস্কারক এবং একটি হিন্দুজাতি গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে ইতিহাসের ধারাকে উপেক্ষা করেছেন। বিগত কয়েক শতকে বাংলার সমাজ ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে যে পরিবর্তন ও পুনর্গঠন হয়েছে তা তাঁর মানসপটে ধরা পড়ে নি। বাংলা যে ইতোমধ্যে একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে এবং এখানকার হিন্দু-মুসলমানরা যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বসবাস করেছে, একথা মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। এ জন্যই তিনি হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান এবং একটি একক হিন্দুজাতি গঠনের চিন্তা করেছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসসমূহে, যেগুলির সঙ্গে প্রকৃত ইতিহাসের সম্পর্ক খুবই কম, হিন্দু দেশপ্রেম এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রচারের প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর বিজয় দেখানো হয়েছে, যেমন: রাজসিংহ (১৮৮২) এবং সীতারাম (১৮৮৮)। কোন কোনটিতে আবার ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধেও হিন্দুজাতির বিজয় দেখানো হয়েছে, যেমন: দেবী চৌধুরাণী এবং আনন্দমঠ।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর হিন্দুজাতির পুনরুত্থান বিষয়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থে ‘বন্দে মাতরম্’, ‘মাতৃভূমি’, ‘জন্মভূমি’, ‘স্বরাজ’, ‘মন্ত্র’ প্রভৃতি নতুন শ্লোগান তৈরি করেন। পরবর্তীতে এগুলি হিন্দু জাতীয়তাবাদী, বিশেষ করে হিন্দু জঙ্গিরা ব্যবহার করেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মধ্যপন্থী রাজনৈতিক নেতারা প্রথম দিকে বঙ্কিমচন্দ্রের এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী শ্লোগানে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু স্বদেশী যুগের যুবসমাজের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচন্ড জনপ্রিয়তা এবং তাঁর মতাদর্শে যুবসমাজের মধ্যে যে উদ্যম সৃষ্টি হয়েছিল, তা কংগ্রেসকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে এবং একটি জাতীয়তাবাদী দলে পরিণত হতে প্রভাবিত করে। এরপর কংগ্রেস তার জাতীয় রাজনীতির শ্লোগান হিসেবে ‘বন্দে মাতরম্’কে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে এবং সমগ্র ভারতবর্ষে তা ব্যবহূত হতে থাকে। অতীতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার এবং পরবর্তী জীবনে সাহিত্যব্যক্তিত্ব হিসেবে নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আবির্ভাব পর্যন্ত সকলের কাছে, এমনকি শিক্ষিত মুসলিম সমাজের কাছেও সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। 


সাবিত্রী

-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১ 

তমিস্রা রজনী ব্যাপিল ধরণী,

দেখি মনে মনে পরমাদ গণি,

বনে একাকিনী বসিলা রমণী

কোলেতে করিয়া স্বামীর দেহ।

আঁধার গগন ভুবন আঁধার,

অন্ধকার গিরি বিকট আকার

দুর্গম কান্তার ঘোর অন্ধকার,

চলে না ফেরে না নড়ে না কেহ ||

 ২

 কে শুনেছে হেথা মানবের রব?

কেবল গরজে হিংস্র পশু সব,

কখন খসিছে বৃক্ষের পল্লব,

কখন বসিছে পাখী শাখায়।

ভয়েতে সুন্দরী বনে একেশ্বরী,

কোলে আরও টানে পতিদেহ ধরি,

পরশে অধর অনুভব করি,

নীরবে কাঁদিয়া চুম্বিছে তায় ||

 ৩

 হেরে আচম্বিতে এ ঘোর সঙ্কটে,

ভয়ঙ্কর ছায়া আকাশের পটে,

ছিল যত তারা তাহার নিকটে

ক্রমে ম্লান হয়ে গেল নিবিয়া।

সে ছায়া পশিল কাননে,-অমনি,

পলায় শ্বাপদ উঠে পদধ্বনি,

বৃক্ষশাখা কত ভাঙ্গিল আপনি,

সতী ধরে শবে বুকে আঁটিয়া 

সহসা উজলি ঘোর বনস্থলী,

মহাগদাপ্রভা, যেন বা বিজলী,

দেখিয়া সাবিত্রী যেন রত্নাবলী,

ভাসিল নিঝরে আলোক তার।

মহাগদা দেখি প্রণমিলা সতী,

জানিল কৃতান্ত পরলোকপতি,

এ ভীষণা ছায়া তাঁহারই মূরতি,

ভাগ্যে যাহা থাকে হবে এবার ||

 ৫

 গভীর নিস্বনে কহিলা শমন,

থর থর করি কাঁপিল গহন,

পর্ব্বতগহ্বরে ধ্বনিল বচন,

চমকিল পশু বিবর মাঝে।

“কেন একাকিনী মানবনন্দিনী,

শব লয়ে কোলে যাপিছ যামিনী,

ছাড়ি দেহ শবে ; তুমি ত অধীনী,

মম অঙ্গে তব বাদ কি সাজে ||”

 ৬

 “এ সংসারে কাল বিরামহীন,

নিয়মের রথে ফিরে রাত্রি দিন,

যাহারে পরশে সে মম অধীন,

স্থাবর জঙ্গম জীব সবাই।

সত্যবানে আসি কাল পরশিল,

লতে তারে মম কিঙ্কর আসিল,

সাধ্বী অঙ্গ ছুঁয়ে লইতে নারিল,

আপনি লইতে এসেছি তাই |

সব হলো বৃথা না শুনিল কথা,

না ছাড়ে সাবিত্রী শবের মমতা,

নারে পরশিতে সাধ্বী পতিব্রতা,

অধর্ম্মের ভয়ে ধর্ম্মের পতি।

তখন কৃতান্ত কহে আর বার,

“অনিত্য জানিও এ ছার সংসার,

স্বামী পুত্র বন্ধু নহে কেহ কার,

আমার আলয়ে সবার গতি ||

 ৮

 “রত্নছত্র শিরে রত্নভূষা অঙ্গে,

রত্নাসনে বসি মহিষীর সঙ্গে,

ভাসে মহারাজা সুখের তরঙ্গে,

আঁধারিয়া রাজ্য লই তাহারে।

বীরদর্প ভাঙ্গি লই মহাবীরে,

রূপ নষ্ট করি লই রূপসীরে,

জ্ঞান লোপ করি গরাসি জ্ঞানীরে,

সুখ আছে শুধু মম আগারে |


 “অনিত্য সংসার পুণ্য কর সার,

কর নিজ কর্ম্ম নিয়ত যে যার,

দেহান্তে সবার হইবে বিচার,

দিই আমি সবে করমফল।

যত দিন সতী তব আয়ু আছে,

করি পুণ্য কর্ম্ম এসো স্বামী পাছে-

অনন্ত যুগান্ত রবে কাছে কাছে,

ভুজিবে অনন্ত মহা মঙ্গল ||

 ১০

 “অনন্ত বসন্তে তথা অনন্ত যৌবন,

অনন্ত প্রণয়ে তথা অনন্ত মিলন,

অনন্ত সৌন্দর্য্যে হয় অনন্ত দর্শন,

অনন্ত বাসনা, তৃপ্তি অনন্ত।

দম্পতি আছয়ে, নাহি বৈধব্য-ঘটনা,

মিলন আছয়ে, নাহি বিচ্ছেদযন্ত্রণা,

প্রণয় আছয়ে, নাহি কলহ গঞ্জনা,

রূপ আছে, নাহি রিপু দুরন্ত |

১১

রবি তথা আলো করে, না করে দাহন,

নিশি স্নিগ্ধকরী, নহে তিমির কারণ,

মৃদু গন্ধবহ ভিন্ন নাহিক পবন,

কলা নাহি চাঁদে, নাহি কলঙ্ক।

নাহিক কণ্টক তথা কুসুম রতনে,

নাহিক তরঙ্গ স্বচ্ছ কল্লোলিনীগণে,

নাহিক অশনি তথা সুবর্ণের ঘনে,

পঙ্কজ সরসে নাহিক পঙ্ক ||”

 ১২

 “নাহি তথা মায়াবশে বৃথায় রোদন,

নাহি তথা ভ্রান্তিবশে বৃথায় মনন,

নাহি তথা রিপুবশে বৃথায় যতন,

নাহি শ্রমলেশ, নাহি অলস।

ক্ষুধা তৃষ্ণা তন্দ্রা নিদ্রা শরীরে না রয়,

নারী তথা প্রণয়িনী বিলাসিনী নয়,

দেবের কৃপায় দিব্য জ্ঞানের উদয়,

দিব্য নেত্রে নিরখে দিক্ দশ ||”

 ১৩

 “জগতে জগতে দেখে পরামাণুরাশি

মিলিছে ভাঙ্গিছে পুনঃ ঘুরিতেছে আসি,

লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ি ফেলিছে বিনাশি,

অচিন্ত্য অনন্ত কালতরঙ্গে।

দেখে লক্ষ কোটী ভানু অনন্ত গগনে,

বেড়ি তাহে কোটী কোটী ফিরে গ্রহগণে,

অনন্ত বর্ত্তন রব শুনেছি শ্রবণে,

মাতিছে চিত্ত সে গীতের সঙ্গে ।

১৪

দেখে কর্ম্মক্ষেত্রে নয় কত দলে দলে,

নিয়মের জালে বাঁধা ঘুরিছে সকলে,

ভ্রমে পিপীলিকা যেন নেমীর মণ্ডলে,

নির্দ্দিষ্ট দূরতা লঙ্ঘিতে নারে।

ক্ষণকাল তবে সবে ভবে দেখা দিয়া,

জলে যেন জলবিম্ব যেতেছে মিশিয়া,

পুণ্যবলে পুণ্যধামে মিলিছে আসিয়া,

পুণ্যই সত্য অসত্য সংসার ||

 ১৫

 “তাই বলি কন্যে, ছাড়ি দেহ মায়া,

ত্যজ বৃথা ক্ষোভ ; ত্যজ পতিকায়া,

ধর্ম্ম আচরণে হও তার জায়া,

গিয়া পুণ্যধাম।

গৃহে যাও ত্যজি কানন বিশাল

থাক যত দিন পরশে কাল,

কালের পরশে মিটিবে জঞ্জাল,

সিদ্ধ হবে কাম ||

১৬

শুনি যমবাণী জোড় করি পাণি,

ছাড়ি দিয়া শবে, তুলি মুখখানি

ডাকিছে সাবিত্রী ;- কোথায় না জানি,

কোথা ওহে কাল।

দেখা দিয়া রাখ এ দাসীর প্রাণ,

কোথায় গেলে পাব কালের সন্ধান,

পরশিয়ে কর এ সঙ্কটে ত্রাণ,

মিটাও জঞ্জাল ||

 ১৭

 “স্বামীপদ যদি সেবে থাকি আমি,

কায় মনে যদি পূজে থাকি স্বামী,

যদি থাকে বিশ্বে কেহ অন্তর্য্যামী,

রাখ মোর কথা।

সতীত্বে যদ্যপি থাকে পুণ্যফল,

সতীত্বে যদ্যপি থাকে কোন বল,

পরশি আমারে, দিয়ে পদে স্থল,

জুড়াও এ ব্যথা ||”

 ১৮

 নিয়মের রথ ঘোষিল ভীষণ,

আসি প্রবেশিল সে ভীম কানন,

পরশিল কাল সতীত্ব রতন,

সাবিত্রী সুন্দরী।

মহাগদা তবে চমকে তিমিরে,

শবপদরেণু তুলি লয়ে শিরে,

ত্যজে প্রাণ সতী অতি ধীরে ধীরে

পতি কোলে করি ||

১৯

বরষিল পুষ্প অমরের দলে,

সুগন্ধি পবন বহিল ভূতলে,

তুলিল কৃতান্ত শরীরিযুগলে,

বিচিত্র বিমানে।

জনমিল তথা দিব্য তরুবর,

সুগন্ধি কুসুমে শোভে নিরন্তর,

বেড়িল তাহাতে লতা মনোহর,

সে বিজন স্থানে।


শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য ততটা ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)।








=================================














No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...