"আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসতো আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়বো বাঙলাদেশের খবর। এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে!”
(২৫ জুন ১৯৩৪ — ২ জুন ২০১১)
আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক, ঘোষক ও আবৃত্তিকার তথা কিংবদন্তি বাচিক শিল্পী.
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন। পিতার নাম নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীহারবালা। সাত বৎসর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন স্কুলের পড়াশোনার পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু সংসারের অর্থকষ্ট মেটাতে তিনি বন্ধ করেছিলেন পড়াশুনা। তাতে বিষম চটে গিয়েছিলেন তার পিতা। তিনি তখনই তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কলকাতায় ঘরছাড়া হয়ে উঠলেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ওই মেসে তখন থাকতেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রোজগারের জন্য তখন যা পেতেন তাই করতেন। কখনো গৃহশিক্ষকতা, টাইপিস্ট, স্টোরকিপার এবং চায়ের দোকানেও কাজ করতে হয়েছে অর্থকষ্ট এতটাই ভয়াবহ ছিল। কিন্তু এসবের মধ্যেও সৃজনী মনটা কিন্তু উধাও হয়ে যায় নি। সময় পেলেই শুনতেন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ও বাচনভঙ্গি। তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কাজী সব্যসাচী আবৃত্তিচর্চার সূত্রপাত তখনই। সারাদিন চায়ের দোকানে কাজ করতেন, রাতে ফিরে কলম-খাতা নিয়ে বসে যেতেন , কবিতাও লিখতেন। এমনই একটা সময় সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত এবং সুবীর হাজরার (সত্যজিৎ রায়ের সহকারী) একটি ছবিতেও প্রোডাকশনের কাজ করেছিলেন তিনি। যদিও সে ছবি মুক্তি পায়নি। সুধীন দাশগুপ্তই তাঁকে আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে বলেন। অতঃপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোষক হিসাবে আকাশবাণীর চাকরিতে প্রবেশ করেন। তারপর একটানা বত্রিশ বছর আকাশবাণীতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন যে।অচিরেই কুশলতায় হয়ে ওঠেন আকাশবাণীর সংবাদ ও ভাষ্যপাঠক। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীতে বাংলা বিভাগে সংবাদ পাঠক রূপে নির্বাচিত হন। তারপর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শেষদিকে ফিরে আসেন কলকাতার বেতার কেন্দ্রে। তার কণ্ঠে ' কলকাতার আকাশবাণীতে '‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’'—ভরাট কণ্ঠের এই সম্ভাষণ যে কি প্রভাবে মানুষকে আচ্ছন্ন করত তা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। আর সংবাদ পাঠকে তিনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ঘরে ঘরে সংবাদ পরিক্রমা শোনার জন্য রেডিও খোলা হতো। তার অনেক আবৃত্তি প্রকাশ পেয়েছে রেকর্ড ও ক্যাসেটে। পার্থ ঘোষ, তরুণ চক্রবর্তী, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু প্রমুখ প্রখ্যাত বাচিক শিল্পীরা তার কাছে এ ব্যাপারে ঋণী বলে উল্লেখ করেছেন।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত করে।
আকাশবাণী কলকাতার বেতার কেন্দ্র হতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে অবসরের পর যৌথ বা একক ভাবে সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের বই। সেগুলি হল-
বিষয়:আবৃত্তি (অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে)
বাংলাদেশের গল্প
একাত্তরের যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশ
তার স্ত্রী ছিলেন কত্থক নৃত্যশিল্পী রুবি বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে শুরু করেছিলেন 'রসকলি' নামে একটি আবৃত্তি ও নৃত্যচর্চা কেন্দ্র। কিন্তু ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হঠাৎ সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন অসুস্থ হয়ে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল তাঁর।
দক্ষিণ কলকাতার ল্যানসডাউনে নিজের বাসভবনে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২ রা জুন ৭৭ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সারা ভারতে এখনও পর্যন্ত তিনজন ব্রডকাস্টার পদ্মশ্রী পেয়েছেন। তার মধ্যে একজন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দু’জন- AIR-এর মেলভিন ডি মেলো (Melville de Mellow) এবং ঊষা মেহতা, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গোপন বেতার কেন্দ্র চালাতেন।
তাঁর কথায়, “আমরা যখন কলেজে পড়ি তখন উনি খ্যাতির একেবারে মধ্যগগনে। বাংলা শব্দের উচ্চারণ নিয়ে অক্লান্ত চর্চা ও সাধনা, এটা আমরা দেখেছিলাম দুজন বাঙালি ব্যক্তিত্বের মধ্যে। একজন শম্ভু মিত্র অন্যজন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবদুলালবাবুর সঙ্গে একটা বিশেষ কাজের সূত্রে জড়িয়ে গিয়েছিলাম, সেটা মনে পড়ছে খুব।
কলকাতার প্রথম আকাশবাণী কেন্দ্র গার্স্টিন প্লেস-এর বাড়িটা তখন প্রোমোটারদের হাতে চলে গিয়েছে। সেইসময় আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-কে বলি, বাড়িটা না ভেঙে যদি সেখানে একটা আর্কাইভ গড়ে তোলা যায় ভালো হয়। প্রস্তাব শুনে উনিও উৎসাহিত হন। এরপরই আমি যোগাযোগ করি দেবদুলালবাবুর সঙ্গে। তিনি এবং আমি দু'জনে মিলে তৎকালীন মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যাই। বিষয়টার মধ্যে বিভিন্ন জটিলতা ছিল, তবু আমরা হাল ছাড়িনি। প্রশান্তবাবুকে বলি, প্রোমোটাররা যদি ওই বাড়ির কোনও অংশ স্মারক জাতীয় কিছু করার অনুমতি দেন তাহলেও চলবে। সেই প্রস্তাবে রাজীও হয়ে যায় প্রোমোটাররা। তোড়জোড়ও শুরু হয়ে যায়। ফুটবল-ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার অজয় বসু, রামকুমার চট্টপাধ্যায়, যূথিকা রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গার্স্টিন প্লেস-এর আকাশবাণীতে যাঁরা যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমি আর দেবদুলালবাবু প্রত্যেকের বাড়িতে যাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কিছুই বাতিল হয়ে যায়। এ নিয়ে দেবদুলালবাবু খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন, ব্রডকাস্টিং মিউজিয়াম গড়ে তোলা নিয়ে ওনার অপরীসীম আগ্রহ ছিল, আত্মজীবনীমূলক বইতে সেকথা লিখেওছিলেন।”
==={{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}======
No comments:
Post a Comment