"তাঁর লেখায় নায়ক 'বাঘের মতো বাঁচতে চায়'। তাঁর কাহিনীতে নায়ক ঘন জঙ্গলের ঘ্রাণকে ভালবাসে। তাঁর উপন্যাসে এক প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা 'হলুদ বসন্ত'। কেউ তাঁকে চেনেন শিকারের কাহিনীকার হিসেবে। কেউ আবার চেনেন অরণ্যপ্রেমী এক লেখক হিসেবে। সেই তিনিই তাঁর প্রায় সব লেখায় অক্ষরে অক্ষরে ফুটিয়ে তুলেছেন আরও একটি সত্ত্বা। প্রেমিকের সত্ত্বা--হয়তো এই সত্ত্বাটিই কোনও না কোনও ভাবে সবসময়ে বেঁধে রেখেছে তাঁর লেখনীকে আর পাঠককুলের হদস্পন্দন কমেছে-বেড়েছে তাঁরই লেখনীর ছন্দে। তিনি বুদ্ধদেব গুহ. "
একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। তিনি মূলত বন, অরণ্য এবং প্রকৃতি বিষয়ক লেখার জন্য পরিচিত। তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা ঋতু গুহ। বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এবং অভিজ্ঞতাময় তাঁর জীবন। ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্বআফ্রিকা তাঁর দেখা। পূর্বভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তাঁর সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়।
১৯৩৬ সালে ২৯ জুন কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল বরিশাল ও রংপুরে। একদিকে পড়াশোনা আর অন্যদিকে গান। রবীন্দ্রসঙ্গীতে পারদর্শী বুদ্ধদেব গুহ টপ্পা গানেও পটু ছিলেন। বহুসময় অনেকেই তাঁর গানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গানের সূত্রেই ভালবাসা- বিয়েও করেন গায়িকা ঋতু গুহকে। গান যেমন তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে ছিল, তেমনই পেশাগত জীবনেও উজ্জ্বল ছিলেন । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপরিচিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন।
পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল চাটার্ড অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন একজন নামী চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করেছিল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন তিনি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। একদা বামফ্রন্ট তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিমবঙ্গ বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ড এবং নন্দন উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে পরিচালন সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব গুহ খুব সুন্দর ছবি আঁকেন। নিজের লেখা একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন। গায়ক হিসেবেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।
বুদ্ধদেব গুহের প্রধান পরিচয় তিনি শিকার কাহিনি বা অরণ্যপ্রেমিক লেখক। কিন্তু অরণ্যানীর জীবন বা শিকার ছাপিয়ে তার রচনা ধারণ করেছে এক প্রেমিক সত্তাকে। এই প্রেমিক সত্তা একইসঙ্গে প্রকৃতি ও নারীকে অবিচ্ছিন্নভাবে ধারণ করেছে তার গল্প ও উপন্যাসে। তার সৃষ্টি 'বাবলি', 'মাধুকরী', 'কোজাগর', 'হলুদ বসন্ত', 'একটু উষ্ণতার জন্য','কুমুদিনী', ‘খেলা যখ’ এবং ‘ঋজুদা’ বাংলা কথাসাহিত্যের জগতকে সমৃদ্ধ করেছে তুলনারহিত আঙ্গিকে। তার রচিত 'বাবা হওয়া' এবং 'স্বামী হওয়া'- এ দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে পুরস্কারজয়ী বাংলা চলচ্চিত্র 'ডিকশনারি'। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও
তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যে বুদ্ধদেব গুহের এক নিঃসঙ্গ নাম কারণ যে ধারার সাহিত্য তিনি রচনা করেছেন তা বাংলা মূলধারার পরিপ্রেক্ষিতে অভিনব। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তার সাহিত্যের ভুবন খানিকটা দূরে। টাঁড়ে, বনে, অরণ্যে, বাঘের গায়ের ডোরায় সে সব কাহিনি ছায়াময়। তার নায়কদের নাম ঋজুদা, রুরু, পৃথু। নায়িকাদের নাম টিটি, টুঁই, কুর্চি। তারা ছাপোষা বাঙালি জীবনের চৌহদ্দিতে নেই। কিন্তু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে সেই বই বুকে নিয়েই বাঙালি গৃহবধূ তার নিঃসঙ্গ দুপুর কাটাতেন। লুকিয়ে ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়তে পড়তে বাঙালি কিশোর বুকের ভিতরে যৌবনের প্রথম আলোড়ন টের পেত। কিশোরী নিজের অজান্তেই কখন যেন যুবতী হয়ে উঠত।’’
জঙ্গলমহল' তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তারপর বহু উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লেখক হিসেবে খুবই অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার বিতর্কিত উপন্যাস 'মাধুকরী' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। ছোটদের জন্য তার প্রথম বই- 'ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে'। ঋজুদা তার সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় অভিযাত্রিক গোয়েন্দা চরিত্র। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৬ সালে। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতু গুহ তার স্ত্রী। সুকণ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ নিজেও একদা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। পুরাতনী টপ্পা গানে তিনি অতি পারঙ্গম। টিভি এবং চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার একাধিক গল্প উপন্যাস।
তিনি 'হলুদ বসন্ত' উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৬ সালে।ঋজু এবং নয়নার সম্পর্কের রসায়ন-এই উপন্যাসের মূল আধার। কিন্তু আর পাঁচটা প্রেমের উপন্যাস নয়। প্রেম কী, প্রেমের অপেক্ষা কী--সঙ্গীর সুখ? নাকি নিজের সুখ? মাত্র নব্বই পাতার উপন্যাসে ঘুরে-ফিরে এসেছে নানা প্রশ্ন। উপন্যাসের তালিকা করতে বসলে প্রথমেই থাকবে আরও একটি উপন্যাস- মাধুকরী। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস জনপ্রিয়তার বিচারে এখনও পাল্লা দেয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের চেনা ছকের বাইরের গল্প। কিন্তু সেটাই যেন ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে ডাকে। শ্লীলতা-অশ্লীলতা, সমাজ-নিয়ম সব বেড়া ভেঙে দেয় মাধুকরীর চলন। ছোট হোক বা বড় সব চরিত্রই যেন ভীষণ দাগ কেটে যায়। এমন করেই পাঠক মনে রাখে তাঁর আরও একটি উপন্যাস- একটু উষ্ণতার খোঁজে। তালিকা অনেকটাই দীর্ঘ- কোজাগর, কোয়েলের কাছে, চাপরাশ, পঞ্চম প্রবাস, শাল ডুংরী, সারেং মিঞা, মাণ্ডুর রূপমতী, বাবলি, নগ্ন নির্জন- আরও কত কত।
বাঙালিকে জঙ্গলের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন, অ্যাডভেঞ্চার চিনিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকিটা চিনিয়েছেন, জঙ্গলকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ। আরও একটি উপহার হয়েছে তাঁর। 'দাদাময়' বাংলা সাহিত্যে বাঙালিকে আরও একটি দাদা উপহার দিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ- ঋজুদা। তবে বাকি 'দাদা'-দের তুলনায় ইনি অনেকটাই আলাদা। গুগনোগুম্বারের দেশে, রুআহা-তে মারকাটারি অ্যাকশন-নিনিকুমারীর বাঘ, ছোটডোঙ্গরির চিতা, ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর-রুদ্ধশ্বাস কাহিনী কিংবা মউলির রাতের রহস্যঘেরা ডাক--বাঙালি কিশোর পাঠকের মনের অন্তঃস্থলে 'আইডল' হয়ে ওঠে ঋজুদা। শিকার কাহিনী শুধু নয়, বনজঙ্গলের প্রতি, বন্যপ্রাণীদের প্রতি-সর্বোপরি জঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের প্রতি নির্ভেজাল মমত্ব বারবার ফুটে উঠেছে ঋজুদার চরিত্রে। অথচ তিনি নিজে আপাদমস্তক সাহেবিকেতার শহুরে মানুষ। যাঁর মনপ্রাণ পড়ে থাকে জঙ্গলের সূর্যাস্তে, পাখির ডাকে কিংবা ছোট জংলি ঝোরাতে। আদতে বুদ্ধদেব গুহ মানুষটাও তাইই ছিলেন। ঋজুদা চরিত্রে কি তাঁরই ছায়া পড়েছে? এ প্রশ্ন আসতেই পারে পাঠকের মনে।
তিনি শিরোমন পুরস্কার এবং শরৎ পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন
২৯ আগস্ট ২০২১ রাত ১১টা ২৫মিনিটে মৃত্যু হয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলেও কিছু দিন আগে কোভিড ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, একটানা ত্রিশ দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেও গিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবৎ মূত্রথলিতে এবং বয়সজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট ও মুত্রনালীর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে ৩১ জুলাই দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন। চারজন চিকিৎসকের একটি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা হচ্ছিল। তবে চিকিৎসায় তেমন ফল না হওয়ায় তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই ২৯ আগস্ট রবিবার মধ্যরাতের কিছু আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।প্রকৃতিতেই মিশে গেলেন সারাজীবন প্রকৃতিকে ভালবাসা মানুষটি। রয়ে গেল তাঁর সৃষ্টি। পাতায় পাতায় মিশে থাকল প্রেম-অপ্রেম-জঙ্গল-অ্যাডভেঞ্চার। রয়ে গেল মাসাইমারার রূপকথা...রয়ে গেল মাধুকরীর হাটচান্দ্রা আর কিবরু।
মৃত্যুকালে তিনি দুই কন্যা রেখে গেছেন। তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহ ২০১১ সালে প্রয়াত হয়েছেন।
অগ্রগামীর পক্ষে জয়ন্ত ভট্টাচার্যের পরিচালনার বুদ্ধদেব গুহর (Buddhadeb Guha) চার চারটি উপন্যাস থেকে ছবি করার কথা ভাবেন প্রযোজক অজয় বসু। ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘নগ্ন নির্জন’ ও ‘চবুতরা’। উত্তম কুমার নিজে ‘নগ্ন নির্জন’ ও ‘চবুতরা’ পড়েন। ছবিগুলির সহ-প্রযোজক হতে চেয়েছিলেন চণ্ডীমাতা ফিল্মসের সত্যনারায়ণ খাঁ। যৌথ প্রযোজনায় উত্তম কুমার অভিনীত ছবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এই চারটি কাহিনির। আর ‘চবুতরা’ ছবিতে প্রথম বারের জন্য বাংলা ছবিতে অভিনয় করতেন রেখা! প্রযোজক অসীম সরকার, পরিচালক আলো সরকার এই বিষয়ে কথা বলেন শক্তি সামন্তের সঙ্গে। রেখা রাজি হন। ছবিতে থাকতেন আমজাদ খান। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই ছবিগুলি আর হয়নি। পিনাকী চৌধুরীর পরিচালনায় ‘কোয়েলের কাছে’ ছবির মহরত হয়ে যাবার পরও তা হয়ে ওঠেনি। সেই মহরতে অমিতাভ বচ্চনও এসেছিলেন। একবার ভেবে দেখুন যশোবন্ত অথবা সুকুমার বোসের ভূমিকায় মহানায়ককে। এইসব ঘটনা মনে ছিল বুদ্ধদেব গুহর। তবে কোনও আক্ষেপ ছিল না। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসে হয়তো আর দুঃখ পাওয়ার কথাও ছিল না। তবে মহানায়ক এবং কথাশিল্পীর অসংখ্য ভক্তের কাছে এ আক্ষেপ যাবার নয়। বুদ্ধদেব গুহর লেখা নিয়ে এই ব্যাপারটা বার বারই হয়েছে। সত্তরের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় আকাশবাণীতে অভিনীত ‘কোয়েলের কাছে’। যশোবন্তের ভূমিকায় ছিলেন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় আর লালসাহেব বসন্ত চৌধুরী! জানি না, পাঁচ দশক পেরিয়ে আজ আকাশবাণীর আর্কাইভে আর খুঁজেও পাওয়া যাবে কিনা সেই অবিস্মরণীয় নাটক!
========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆========
No comments:
Post a Comment