Saturday, 10 August 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। পুলিনবিহারী সেন। খ্যাতনামা রবীন্দ্র বিশারদ। তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রবীন্দ্রচর্চা ও গবেষণায় এক অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাণ্ডারী ছিলেন, পুলিনবিহারী ছিলেন রবীন্দ্র রচনা ও সাহিত্যের ভাণ্ডারী। Dt - 11.08.2024. Vol - 953. Sunday. The blogger post in literary e magazine.



পুলিনবিহারী সেন
 (১১ আগস্ট, ১৯০৮ ― ১৪ অক্টোবর, ১৯৮৪)



 খ্যাতনামা রবীন্দ্র বিশারদ। তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রবীন্দ্রচর্চা ও গবেষণায় এক অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাণ্ডারী ছিলেন, পুলিনবিহারী ছিলেন রবীন্দ্র রচনা ও সাহিত্যের ভাণ্ডারী.

জন্ম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই আগস্ট অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ব্রাহ্মপল্লিতে। এদিনই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। পুলিনবিহারীরও আদরের নাম রাখা হয় '‌খুদু'‌। [২] পিতা বিপিনবিহারী সেন ছিলেন এক দেশকর্মী ও দরিদ্র-বান্ধব চিকিৎসক। মাতা বিজনবাসিনী দেবী। পুলিনবিহারী র পড়াশোনা ময়মনসিংহের জাতীয় বিদ্যালয়ে শুরু হয় এবং পরে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতন থেকে আই.এ, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি. এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করেন।

এম.এ পাশের পর তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী পত্রিকায়। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন বিশ্বভারতী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থন বিভাগে। এর আগে শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় তিনি উপাসনা গৃহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণ অনুলিখনে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতায় পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে রবীন্দ্র রচনা সম্পাদনার কাজে সহায়তা করে। বিস্মৃতপ্রায় রবীন্দ্র-রচনার সন্ধানে তিনি বিস্তারিত আকারে বাংলা ও ইংরাজী 'রবীন্দ্র-রচনা-পঞ্জী' সংকলনে ব্রতী হন। 'রবীন্দ্র-রচনাবলী'তে গ্রন্থ পরিচয়, রবীন্দ্র সাহিত্য সম্বন্ধে যে তথ্য বিন্যাসের সূচনা, 'রবীন্দ্র-রচনা-পঞ্জী'তে তা তিনি বিস্তারিত আকারে বিবৃত করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ হন। এখানে তার রবীন্দ্র গ্রন্থের পাঠান্তর সংবলিত গ্রন্থ-প্রকাশ প্রকাশন জগতে এক নূতন পথ প্রদর্শক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র (ষষ্ঠ-নবম খণ্ড) সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন। তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী থেকে পদত্যাগ করেন। তবে 'রবীন্দ্র-চর্চা-প্রকল্প'-এর অধ্যক্ষ হিসাবে পুনরায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থ পরিচয়, পাঠ-ভেদ নির্ণয় ছাড়া বহু গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল হল -

রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জি (১৯৭৪)
রবীন্দ্রায়ণ (১ম ও ২য় খণ্ড)
রবীন্দ্র শতবর্ষপূর্তি উৎসবের সময় রবীন্দ্র প্রসঙ্গে কয়েকটি গ্রন্থ
অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ সংখ্যা
জগদীশচন্দ্র বসু'র অব্যক্ত
প্রমথ চৌধুরী র সনেট পঞ্চাশং ও অন্যান্য কবিতা 
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের '‌'স্বপ্নপ্রয়াণ'‌'
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের বক্তৃতা - টুওয়ার্ডস এ প্রসপারাস ইন্ডিয়া
রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতি
যোগেশচন্দ্র বাগলের হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত 
পুলিনবিহারী সেন দীর্ঘকাল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

পুলিনবিহারী সেন বিভিন্ন সময়ে নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ।
রবীন্দ্র গবেষণার জন্য তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। 
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক লাভ।

জীবনবসান
পুলিনবিহারী সেন ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই অক্টোবর ৭৬ বৎসর বয়সে প্রয়াত হন।


শ্রীযুক্ত পুলিনবিহারী সেন—

জনগণমনঅধিনায়ক গানটি কোনো উপলক্ষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারচি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনো কোনো মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তোমার মনে জেগে উঠল।’

তখন বাজারে রটেছিল যে, পঞ্চম জর্জের কলকাতা আগমন উপলক্ষ্যেই কবির ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটি রচনা। সেদিন ইংরেজি পত্রিকাদু’টিতে লেখা হয়েছিল ‘কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়ে সমবেত কণ্ঠে হিন্দিতে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিসূচক জয়গান গেয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ পুলিনবিহারীর পাশাপাশি রবীন্দ্রবিরোধীদের উদ্দেশ্যেও সেই চিঠিতে লিখলেন— ‘সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথ অনুরোধের গান যে লেখেননি তা তো নয়, তবে সম্রাটের জয়গান লিখবেন এমনটা আশা করা বাড়াবাড়িই হয়েছিল। কবি এ কথা শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। লিখেওছেন সে কথা— ‘শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল।... আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। আজ মতভেদবশতঃ আমার প্রতি ক্রুদ্ধ ভাবটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশটা দুর্লক্ষণ।’

তরুণ বয়সি পুলিনবিহারী সেনকে লেখা কবির সেই চিঠিটি বহু বিভ্রান্তির উত্তর দিয়েছিল, সেই কারণেই চিঠিটি ঐতিহাসিক।

এ ছাড়াও পুলিনবিহারী সেন যে বাংলার সর্বাগ্রগণ্য রবীন্দ্র-বিশারদ, তা বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, প্রশান্তকুমার পাল প্রমুখ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। অথচ চির কালই তিনি আড়ালে থেকে নীরবে কাজ করে গেছেন। জীবনের উপান্তে এক সংবর্ধনা সভায় নিজের সম্বন্ধে পুলিনবিহারী বলেছিলেন, ‘আমি একজন সামান্য শ্রমিক মাত্র।’

এই ধীর স্থির মানুষটিই বিশ্বভারতীর কাজে ছেদ পড়ায় শেষ জীবনে পেনশন পেতেন না, রবীন্দ্রভবনের থেকে নামমাত্র মাসিক ভাতাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার সম্বল। অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। জীবনের উপান্তে কলকাতার ৫৪ বি, হিন্দুস্থান পার্কের ছোট ছোট দু’টি ঘরে স্বেচ্ছায় বইবন্দি হয়ে অত্যন্ত অর্থকষ্টে দিন কাটিয়েছেন। এই বাড়িতেই প্রতি রবিবার সকাল ন’টায় বিদ্বজ্জনদের সভা বসত। প্রমথনাথ বিশী, অন্নদাশঙ্কর রায়-সহ সাহিত্যের অনেক দিকপাল হাজির হতেন।

অকৃতদার পুলিনবিহারীর মুখে নির্মল হাসিটি লেগেই থাকত। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে সাহিত্য অকাদেমি তাঁকে বিশেষ রবীন্দ্র পুরস্কার দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সরলাবালা সরকার পুরস্কারও (১৯৬২) পেয়েছিলেন তিনি।

আগাগোড়া নিজেকে আড়ালে রাখার প্রয়াসে তাই তাঁর স্বভাব-কণ্ঠে বার বার ফিরে এসেছে কবির গান, ‘ভয় হয় পাছে তব নামে আমি আমারে করি প্রচার হে’। যখন ভারত সরকার থেকে তাঁকে একটি বৃত্তি আজীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা হয়, তিনি তা গ্রহণ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সেই বৃত্তি আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৪ সালের ১৪ অক্টোবর ৭৬ বছর বয়সে তাঁর জীবনদীপ চিরতরে নিভে যায়।

















===========∆∆∆∆∆∆∆∆=============







No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...