(৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - ২৬ মে, ১৯৯৯)
একজন বাঙালি কবি, কথা-সাহিত্যিক ও প্রখ্যাত নাট্যকার ছিলেন।
তাঁর লেখালিখি শুরু হয়, অবিভক্ত বাংলার নড়াইলের চিত্রা নদী তাঁর কবিতাকে প্রভাবিত করেছে। হাতে লেখা পত্রিকা ‘সাথী’তে লিখেছেন, ‘পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের বিন্যাস’ বিষয়ে প্রবন্ধ। এ লেখা তৈরিতে তাঁর জ্যাঠামশায়, প্রাবন্ধিক-ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব ছিল। শচীন্দ্রনাথ ক্রমশ লিখতে থাকেন গল্প, গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক।
১৯৪১ সালে লেখেন তাঁর প্রথম নাটক ‘উত্তরাধিকার’। সে বছরই বালিগঞ্জ শিল্পী সঙ্ঘের উদ্যোগে তা মঞ্চস্থ হয়। নাটক দেখে মুগ্ধ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রিনরুমে এসে আলাপ করে যান নাট্যকার-অভিনেতা শচীন্দ্রের সঙ্গে। আর প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁকে ডেকে নেন ‘ডাক্তার’ ছবিতে, সহকারী পরিচালক হিসেবে। ছবিতে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন শচীন্দ্রনাথ। পঙ্কজকুমার মল্লিক, তুলসী লাহিড়ী বা অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়।
১৯৪৪-৪৫ নাগাদ লেখা হয় প্রথম উপন্যাস ‘এজন্মের ইতিহাস’। সরোজকুমার রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ১৪ মার্চ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জেগুয়ার’ নামের গল্পটি শচীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিল। এর আগে ‘ইঁদুর’ গল্পটিও প্রকাশিত হয় ‘দেশ’-এ। কিন্তু ‘জেগুয়ার’ সমসময়ের বাংলা গল্পকেই যেন পাল্টে দিল। অন্তহীন সমুদ্রতরঙ্গ শব্দ-ধ্বনি-প্রাণ নিয়ে ঢুকে পড়ল বাংলা সাহিত্যে। তৈরি হল ‘সাগর-বলাকা’, ‘প্রবাল বলয়’, ‘মাটি’, ‘মৎস্যকন্যা’, ‘বৃত্ত’, ‘প্রেম’, ‘বিষুব রেখা’-র মতো স্মরণীয় গল্প-যাত্রা। সাগরের হাওয়া এসে লাগল বাংলা গল্পে। এর আগে যে তাতে সমুদ্রের গন্ধ ছিল না তা নয়, কিন্তু তা এমন রক্ত-মাংস-স্পর্শের সাগর ছিল না। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়— ‘ড্রয়িংরুমের সীমাবদ্ধতা ও পল্লি বাংলার রোম্যান্টিক পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে বাংলা গল্পকে তিনি বিষুব-রৈখিক অঞ্চলে, ট্রপিক অরণ্য কান্তারে, আমিষগন্ধে ভরা সাত সাগরের তীরে তীরে, কখনও বন্দরে, কখনও মধ্য-সমুদ্রে, কখনও দ্বীপে দ্বীপান্তরে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।’ বছরের পর বছর সমুদ্রে ভেসে চলা নাবিকের জীবন, যৌনতা, প্রেম, ত্যাগ, প্রাণময়তা, নিষ্ঠুরতা নিয়ে তাঁর আগে কেউ কলম ধরেছেন কি ?
জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই সেপ্টেম্বর কলকাতার কালীঘাটের ১০/১০ নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটের মামার বাডিতে। পিতা সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা সুরুচি দেবী। তার শৈশবের বছর সাতেক কাটে মামার বাড়িতেই। ছোট বেলায় দুরন্ত ছিলেন, লেখাপড়ায় মন ছিল না। তাই দাদামশাই তাঁকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই দাদু ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে চলে গেলেন পৈতৃক বাড়ি, অবিভক্ত বাংলার তথা অধুনা বাংলাদেশের নড়াইলে। ভর্তি হলেন সেখানকার ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে । প্রসঙ্গত এখানে তার জ্যাঠামশাই প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি প্রভাব লেখাপড়ার মধ্যে এসেছিল। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। সেখানে পড়াকালীনই তার ‘জানি জানি আজ আমারে পড়ে না মনে’ লেখা তার লেখা গান, মুগ্ধ করেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
আশুতোষ কলেজ থেকে আই.এ. ও পরে বি.এ.পাশ করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। আর্থিক অনটনের কারণে ইন্ডিয়ান কপার কর্পোরেশনে ইনস্পেক্টরের চাকরি নিয়ে চলে যান ঘাটশিলা। সেখানে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন । তার উৎসাহে, প্রেরণায় সেখানকার পরিবেশ তার কলমে এসেছে। এখানে থাকতে বিভূতিভূষণের ভাগ্নি উমা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়। ১৯৪৫-এ ‘এম এল ব্যানার্জি অ্যান্ড সন্স’ নামে এক জাহাজ কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে ওয়ালটেয়র চলে যান এবং তার এই যাত্রাও বাংলা সাহিত্যে তৈরি করল নতুন পথ। প্রথম সাগরের হাওয়া এসে লাগল তার সৃষ্ট বাংলা গল্পে। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। উপ-অধিকর্তা হিসাবে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকরঞ্জন শাখার নাট্য পরিচালক হিসাবেও কাজ করেছেন।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যখন শচীন্দ্রনাথ সতেরো বৎসরের কিশোর, তার প্রথম গল্প ‘বুভুক্ষা’ প্রকাশিত হয় 'মানসী' পত্রিকা আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় । কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন । গল্পটি পড়ে তিনি এমন মুগ্ধ হন যে, পকেট থেকে নিজের কলমটি বের করে তার হাতে তুলে দেওয়ার সময় বলেছিলেন -
‘তোমার জীবনে সুখ আসবে, দুঃখ আসবে, কিন্তু এই কলমটি তুমি ছেড়ো না। মনে রেখো, এই কলমের জন্যই তুমি জন্মেছ।’
শরৎচন্দ্রের সেকথা রেখেছেন বলা চলে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গল্প প্রবন্ধ ও নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। উমানন্দ ভৈরব, উমা দেবী, শিবানী দেবী, শান্তি ভট্টাচার্য প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রচনা লিখেছেন । পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে যেখানেই গেছেন সেই পরিবেশের সেখানের মানুষের কথা তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন সময়ে লেখার মধ্য দিয়ে । বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে সেগুলি অমূল্য রত্ন সম্পদ। জাহাজে চাকরির দৌলতে মানুষের যে বিচিত্র জীবনকথার উপাদান তিনি পেয়েছিলেন তাই নিয়ে লিখেছিলেন 'সিন্দুর টিপ', 'ডোডো পাখির নিজের দেশ' প্রভৃতি বহু উপন্যাস ও গল্প। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেখেন প্রথম নাটক ‘উত্তরাধিকার’। সে বছরই কলকাতার বালিগঞ্জ শিল্পী সঙ্ঘের উদ্যোগে তা মঞ্চস্থও হয়।১৯৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দে লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘এ জন্মের ইতিহাস’। সরোজকুমার রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। দেবদাসীদের কাহিনী অবলম্বনে রচিত উপন্যাস 'জনপদবধূ' এবং এটি দীর্ঘ কাল মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতার বিশ্বরূপা, স্টার বা রঙমহলে। ‘এই তীর্থ’ উপন্যাস থেকে হয়েছে ‘জীবন সংগীত’ চলচ্চিত্র। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘মার্কো’, ‘মেমোরিয়ালের পরী’, ‘বিভূতিভূষণের মৃত্যু’, ‘চন্দ্রলোক থেকে আসছি’ -র মতো গল্প, ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপের ফকির’ উপন্যাস। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -
রচনাসম্ভার :
অপরিচিতের নাম
অভিমানী আন্দামান
আনন্দ ভৈরবী
উত্তরাধিকার
এ জন্মের ইতিহাস
এই তীর্থ
এক আশ্চর্য মেয়ে
একটি রঙ করা মুখ
কত আলোর সঙ্গ
কর্নাটরাগ
কৃষ্ণপক্ষের আলো
ছায়াসঙ্গিনী
জনপদবধূ
জলকন্যা
ঢেউ ওঠে পড়ে
তারুণ্যের কাল
তীরভূমি
তোমার পতাকা
দুই নদী
দেবকন্যা
দ্বিতীয় অন্তর
নগরনন্দিনীর রূপকথা
নগ্নদ্বীপ
নতুন নাম নতুন ঘর
নয়ানজুলি
নিধুবাবুর টপ্পা
নীলসিন্ধু
নীলাঞ্জনছায়া
পথ
পত্রলেখার উপাখ্যান
প্রজন্মের ইতিহাস
বন্দরে বন্দরে
বিদিশার নিশা
মধ্যদিনের গান
শান্তির স্বাক্ষর
শ্বেত কপোত
সাক্ষী বালুচর
সিন্দুর টিপ
সীমান্তশিবির
সূর্যের সন্তান
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
স্বপ্ন সঞ্চার
স্বাতীনক্ষত্রের জল
মাস্তুল।
সম্মাননা
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে'বন্দরে বন্দরে’ উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত করে ।
রাজ্য সরকারের চাকরি হতে অবসরের পর তার শেষ জীবন কাটে কলকাতার চেতলার মহেশচন্দ্র দত্ত লেনের বাড়ি "তীরভূমি" তে। সেখানেই তিনি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মে প্রয়াত হন।
নিজের শেষ লেখাটি শুরু করেছিলেন মৃত্যুর আগের দিন। ‘শেষ অধ্যায়’ নামের সেই অসম্পূর্ণ আত্মজৈবনিক উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলেন, ‘ভেবে দেখলাম আমার জীবনে প্রথম অধ্যায় বলে চিহ্নিত করবার মতো তেমন কিছু নেই। যা আছে তা শেষ অধ্যায়ে পুঞ্জীভূত।’...গোটা পনেরো বাক্য, লিখতে লিখতেই সন্ধের দিকে অসুস্থ। ২৫ মে ১৯৯৯। হাসপাতালের পথে গাড়িতেই কোমায়, পর দিন মারা যান কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ৬২ বছর আগে, ১৯৩৭ সালে লেখা তাঁর প্রথম গল্প ‘বুভুক্ষা’ পড়ে মুগ্ধ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পকেট থেকে নিজের কলমটি বার করে তুলে দিয়েছিলেন বছর সতেরোর কিশোরের হাতে— ‘তোমার জীবনে সুখ আসবে, দুঃখ আসবে, কিন্তু এই কলমটি তুমি ছেড়ো না। মনে রেখো, এই কলমের জন্যই তুমি জন্মেছ।’ শচীন্দ্রনাথের মনে রেখেছিলেন কথাগুলো। ‘বুভুক্ষা’ লেখা হয়েছিল ‘মানসী’ পত্রিকা আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতা। বিচারক ছিলেন শরৎচন্দ্র।
===========√√√√√√√√√√√√√=========
No comments:
Post a Comment