( ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮০ - ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১)
একজন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজতান্ত্রিক এবং গবেষক.
কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতা ছিলেন অ্যাটর্নী বিশ্বনাথ দত্ত এবং মা ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী। তাঁর দুই দাদা ছিলেন নরেন্দ্রনাথ বা স্বামী বিবেকানন্দ এবং সাধক মহেন্দ্র। তার দুই ভ্রাতা এবং মাতা ভুবনেশ্বরী তাকে শিক্ষাক্ষেত্রে সহায়তা করেন। ভূপেন্দ্রনাথ কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট থেকে এন্ট্রান্স পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবার আগে তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর সাথে পরিচিত হয়ে হিন্দুসমাজের ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
বৈপ্লবিক ধারায় ইংরেজকে ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য তিনি ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারিস্টার পি মিত্রের নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতিতে যোগ দেন। এখানে তিনি যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভগিনী নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের সাহচর্য পান। মাৎসিনী এবং গ্যারিবল্ডির আদর্শ তার প্রাথমিক বৈপ্লবিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার দাদা বিবেকানন্দের রচনাও তাকে প্রভাবিত করেছিল ।
অরবিন্দ ঘোষের সহায়তায় ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবীদের পত্রিকা সাপ্তাহিক যুগান্তরের সম্পাদক হন। দেশের বৈপ্লবিক চেতনা বাড়ানোর জন্য এই পত্রিকাটি ছাড়াও সোনার বাঙলা নামে একটি বেআইনি ইস্তাহার প্রকাশের জন্য ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তার এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। মুক্তির পর তিনি সহকর্মীদের পরামর্শে ছদ্মবেশে আমেরিকা যাত্রা করেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়া হাউসে আশ্রয় পান। এরপর তিনি ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন এবং দুই বছর পর ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গদর পার্টি এবং সোশ্যালিস্ট ক্লাবের সংস্পর্শে এসে সমাজতন্ত্রবাদে বিশেষ জ্ঞানলাভ করেন। আমেরিকায় থাকাকলে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে তাকে অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হয়েছিল। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করতে তিনিও অন্যান্য ভারতীয় বিপ্লবীদের মত বার্লিনে আসেন। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঐতিহাসিক বার্লিন কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছদ্মবেশে দক্ষিণ ইউরোপ পৌছান। বার্লিন কমিটির অনুরোধে জার্মান সরকার তাকে গ্রিস থেকে বার্লিনে আনেন। তার নেতৃত্বে বার্লিন কমিটি তাদের কর্মক্ষেত্র পশ্চিম এশিয়ায় বিস্তৃত করে। এই সমস্ত অঞ্চলে অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল কাজে যেসব বীর ভারতবাসী প্রাণ দিয়েছেন বা লিপ্ত ছিলেন তাদের তথ্যাদির প্রামানিক চিত্র তিনি তার বইতে বর্ণনা করেছেন।
বৈপ্লবিক আন্দোলনের সাথে সাথে তিনি সমাজতত্ত্ব এবং নৃতত্বের গবেষণা চালিয়ে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পান। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আহ্বানে বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তিনি মস্কোতে আসেন। এই অধিবেশনে মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত উপস্থিত ছিলেন। তিনি সোভিয়েট নেতা লেনিনের কাছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রদান করেন।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতের শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের একটি কর্মসূচী পাঠান। ১৯২৭-২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির এবং ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসর করাচী অধিবেশনে শ্রমিক এবং কৃষকদের মৌলিক অধিকার নিয়ে একটি প্রস্তাব নেহেরুকে দিয়ে গ্রহণ করান। এছাড়াও তিনি বহু শ্রমিক এবং কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভারতের কৃষক আন্দোলনে যুক্ত থেকে বঙ্গীয় কৃষক সভার অন্যতম সভাপতি এবং দুবার অখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি হন । আইন অমান্য আন্দোলনে কারাবরণ করেন।
সাহিত্য প্রতিভা
সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, বৈষ্ণবশাস্ত্র, হিন্দু আর্যশাস্ত্র, মার্কসীয় দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য ছিল। বাংলা, ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, ইরানী প্রভৃতি ভাষায় তার অনেক রচনা প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
অপ্রকাশিত রাজনীতিক ইতিহাস
যুগসমস্যা
তরুণের অভিযান
জাতিসংগঠন
যৌবনের সাধনা
সাহিত্যে প্রগতি
ভারতীয় সমাজপদ্ধতি (৩ খণ্ড)
আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতা (৩ খণ্ড)
বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতন্ত্র
বাংলার ইতিহাস
ডায়ালেক্টস অফ হিন্দু রিচুয়ালিজম
ডায়ালেক্টস অফ ল্যান্ড ইকোনমিকস অফ ইন্ডিয়া
বিবেকানন্দ দ্য সোসালিস্ট।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিপ্লবী কর্মজীবনের সময় ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্রেরও গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বেঙ্গল রেভল্যুশনারি সোসাইটিতে যোগ দেন। তিনি শ্রী অরনবিন্দ এবং বারীন্দ্র ঘোষের সাথে ঘনিষ্ঠ সাহচর্য বজায় রেখেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং 1907 সালে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গদর পার্টিতে যোগদান করেন এবং সেখানে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ অধ্যয়ন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জার্মানিতে যান এবং সেখানে বিপ্লবী ও রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি 1916 সালে বার্লিনের ভারতীয় স্বাধীনতা কমিটির সেক্রেটারিও হন এবং 1918 সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
ভূপেন বেড়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদের পরিবেশে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এবং স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাঙালি তরুণরা ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা গ্রহণের জন্য ক্রমশ অনুপ্রাণিত হতে থাকে। ভূপেনের নিজের ভাষায়, “ যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণ এবং বঙ্কিমের 'আনন্দমঠ'-এর ম্যাজিনি এবং গ্যারিবাল্ডির বাংলা অনুবাদ বাঙালি মনকে আলোড়িত করেছিল। আমাদের মধ্যে আরও অগ্রসর ব্যক্তিরা ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা, সমাজতন্ত্র অধ্যয়ন করবে এবং রাশিয়ান বিপ্লবীদের প্রচেষ্টাকে অনুসরণ করবে।
=============√√√√√√√=============
No comments:
Post a Comment