(২১ সেপ্টেম্বর ১৮৯১ ― ৩ অক্টোবর ১৯৫২)
একজন বাঙালি গবেষক ও সম্পাদক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সক্রিয় ছিলেন। বাংলা সাহিত্য নিয়ে তার বিভিন্ন কাজ ও প্রকাশনা গুরুত্ববহ ও তুলনারহিত.
জন্ম ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বালি'তে এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তন্ত্রশাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শৈশবে পিতৃহারা হন এবং নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মায়ের মৃত্যু হলে ১৯০৮ সালে কলকাতায় এসে একটি সওদাগরি অফিসে মুদ্রাক্ষরিকের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে এ চাকরি ত্যাগ করে জেমস অ্যান্ড কোম্পানিতে যোগদান করেন।। সেকেন্ড ক্লাশ পর্যন্ত পড়ে অর্থাভাবে পড়াশোনা করতে পারেন নি। কাজের খোঁজে কলকাতায় চলে আসেন এবং নিজের চেষ্টায় বিদ্যানুশীলন করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতার বিভিন্ন অফিসে টাইপিস্ট ও পরে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করেন।
ছোটবেলা থেকেই ব্রজেন্দ্রনাথ সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। বিপুল পরিশ্রমে ও নিষ্ঠার সাথে আমৃত্যু সাহিত্যচর্চা করেছেন। নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের সাথে পরিচয়ের সূত্রে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে "জাহ্নবী"তে তাঁর প্রথম রচনা স্বপ্নভঙ্গ প্রকাশিত হয়। এরপর অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের তত্ত্বাবধানে তিনি নবাবি আমলের ইতিহাস অবলম্বনে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দেই বেগমস্ অফ বেঙ্গল তথা বাংলার বেগম গ্রন্থ রচনা করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটি গ্রন্থ- Rajah Rammohun Roy’s Mission to England (১৮২৬), Dawn of New India (১৯২৭) ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ (১৩৩৮) বাঙালি বিদ্বৎসমাজকে নাড়া দেয়। বিশেষত, রামমোহন ও বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তিনি অনেক নতুন তথ্য পরিবেশন করেন। গবেষণাকর্মে তাঁর পারদর্শিতা অর্জন এবং পন্ডিতমহলে সে গবেষণাকর্মের নির্ভরযোগ্যতা লাভ, তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেয়। তিনি ১৯২৯ সালে প্রবাসী ও Modern Review পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। বাংলা ১৩৩৭ সনে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে গড়ে ওঠে। ১৩৩৯ সনে তিনি পরিষদের কার্য-নির্বাহক-সমিতির সভ্য হন এবং ১৩৪১ সনে পরিষদের ‘আজীবন সদস্য’ পদ লাভ করেন। পরে গ্রন্থাধ্যক্ষ (১৩৪০-৪১, ১৩৫২-৫৫), সহকারী সম্পাদক (১৩৪১-৪২), পরিষদ পত্রিকার সম্পাদক (১৩৪৫-৪৬) পরিষদের সম্পাদক (১৩৪৭-৫১, ১৩৫৬-৫৯) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি "প্রবাসী" ও "মডার্ন রিভিউ" পত্রিকার সহসম্পাদক হন এবং ঐতিহাসিক গবেষণামূলক প্রবন্ধাদি নিয়মিত লিখতে থাকেন। এই সময়ে তিনি শোভাবাজার রাজবাড়ি হতে প্রাপ্ত সমাচার দর্পণ, অন্যান্য সাময়িক পত্রিকা ও বিভিন্ন সংবাদপত্র ঘেঁটে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সমাজের বহু উপকরণ সংগ্রহ করেন। যদুনাথ সরকারের কাছে তিনি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ইতিহাস রচনার পদ্ধতি শিক্ষা করেন। ইতোমধ্যে শোভাবাজার-রাজবাড়ির গ্রন্থাগার থেকে তিনি বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ-এর পুরো ফাইল ও অন্যান্য সাময়িক পত্রিকার বিপুল ভান্ডার আবিষ্কার করেন। উনিশ শতকের সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এসব সাময়িক পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় এসব সাময়িক পত্রিকার ভিত্তিতে তিনি রচনা করেন সংবাদপত্রে সেকালের কথা (৩ খন্ড, ১৩৩৯, ১৩৪০, ১৩৪২), বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস (১৩৪২), বাংলা সাময়িক পত্র (১৩৪৬), বাংলা সাময়িক সাহিত্য: ১৮১৮-৬৭ (১৩৫১), সাময়িকপত্র সম্পাদনে বঙ্গনারী (১৩৫৭) প্রভৃতি গ্রন্থ।
উনিশ শতকের বহু দুর্লভ গ্রন্থহকে তিনি এগারো খন্ডে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থমালা (১৩৪৩-১৩৪৬) শিরোনামে সম্পাদনা করেন। তাঁর চেষ্টায় পরিষদের গ্রন্থপ্রকাশ বিভাগের কার্যসূচি নতুনভাবে পরিকল্পিত হলে বাংলা সাহিত্যের সাধকদের রচনাবলী পুনঃপ্রচারের ব্যবস্থা হয়। মৃত্যুঞ্জয়-গ্রন্থাবলী (১৩৪৬) সম্পাদনা করে তিনি এর নতুন ধারার সূচনা করেন। পরে সজনীকান্ত দাসসহ সম্পাদনা করেন বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলী (৩ খন্ড, ১৩৪৪-১৩৪৬), বঙ্কিম-রচনাবলী (৯ খন্ড, ১৩৪৫-১৩৪৮), মধুসূদন-গ্রন্থাবলী (২ খন্ড, ১৩৪৭-১৩৪৮), ভারতচন্দ্র-গ্রন্থাবলী (২ খন্ড, ১৩৪৯-১৩৫০), দীনবন্ধু-গ্রন্থাবলী (২ খন্ড, ১৩৫০-১৩৫১), রামমোহন-গ্রন্থাবলী (২ খন্ড, ১৩৫১-১৩৫২), দ্বিজেন্দ্রলাল-গ্রন্থাবলী (১৩৫৩), রামেন্দ্র-রচনাবলী (৫ খন্ড, ১৩৫৬-১৩৫৭), বলেন্দ্র-গ্রন্থাবলী (১৩৫৯) প্রভৃতি। ফলে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের স্থায়ী আয়ের পথ প্রশস্ত হয়। প্রবর্তিত হয় পরিষদের কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পূজা বোনাস ব্যবস্থা। সাহিত্য সাধক চরিতমালা, দু খণ্ডে সংবাদপত্রে সেকালের কথা, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, দু খণ্ডে বাংলা সাময়িক-পত্র, এবং ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের পরিষৎ পরিচয় ইত্যাদি হলো তাঁর গবেষণা গ্রন্থ। তাঁর উপকরণ সংগ্রহে ও তথ্য সমাবেশে বঙ্গ-সংস্কৃতি, সমাজ ও সাহিত্যে নবজাগরণের ধারাবাহিকতার ইতিহাস রচনার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। চারটি ইংরাজী গ্রন্থ সহ তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা তেত্রিশটি। এর মধ্যে পঁচিশটি গ্রন্থ সজনীকান্ত দাসের সাথে যুগ্মসম্পাদনায় প্রকাশিত।
গ্রন্থ রচনা
দিল্লীশ্বরী (১৯২৩)
বেগম সমরু
কেল্লা ফতে
মোগলযুগে স্ত্রীশিক্ষা
মোগল বিদুষী (১৯২৪)
অক্ষয়কুমার দত্ত
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ (১৯৩১)
বঙ্গ সাহিত্যে নারী
রাজা বাদশা
রণডঙ্কা
ব্রজেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্মকর্তা হিসাবে যখন ছিলেন, এর নবরূপায়ণ, গ্রন্থাবলি সম্পাদনা সহ সুষ্ঠু পরিচালনায় বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ক্যালকাটা হিস্টরিক্যাল সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। এছাড়া শশিশেখর, রাজশেখর ও গিরীন্দ্রশেখর বসুর উদ্যোগে গঠিত 'উৎকেন্দ্র সমিতি'রও একজন উৎসাহী সদস্য ছিলেন।
সম্মাননা
তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর গবেষণাকর্মের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। ১৯২৮ সালে Calcutta Historical Society তাঁকে Honorary Member মনোনীত করেন; ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ ‘রামপ্রাণ স্বর্ণপদক’ ও ১৯৫১-৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন। তিনি ১৩৫৩ সালে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে লাভ করেন ‘অক্ষয়কুমার বড়াল রৌপ্যপদক’।
সাহিত্য সাধক ব্রজেন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য সাধনায় আমৃত্যু লিপ্ত ছিলেন। রোগশয্যায় 'বাংলা সাময়িক-পত্র' সংশোধন সংযোজন শেষ করার দিন অর্থাৎ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা অক্টোবর প্রয়াত হন।
সম্প্রতি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌহিত্র বিশ্বনাথ রায় সাহিত্য সেবক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শীর্ষক এক গ্রন্থে তাঁর পিতামহের জীবনী, দর্শন ও সাহিত্যভাবনা নিয়ে এক আলেখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
===========∆∆∆∆∆∆∆∆∆============
No comments:
Post a Comment