- অজিত দত্ত
- ১৯৩০ সালে অজিত দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কুসুমের মাস প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু সতীর্থ। তিনি বুদ্ধদেব বসুর সাথে যৌথভাবে প্রগতি নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরে কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠী তে যোগ দেন। অজিত দত্ত নিয়মিত কল্লোল পত্রিকায় লেখালেখি করতেন, তিরিশের দশকে কল্লোল অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা সাহিত্য পত্রিকা। ১৯৪৬ সালে তার 'নষ্ট চাঁদ' প্রকাশের পরের বছর দেশ পত্রিকায় রৈবতক ছন্দ নামে ধারাবাহিকভাবে তার মন পবনের নাও প্রকাশিত হয়। অজিত দত্ত সমসাময়িক বাংলা কবিতা, ছন্দ চিন্তা, রবীন্দ্র বিষয়ক ভাবনা, বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের রচনার মূল্যায়ন, শিল্পসাহিত্য ভাবনা এবং শিশুসাহিত্য সম্পর্কিত ৫০টি প্রবন্ধ লেখেন।কাব্য গ্রন্থ
|
|
- প্রবন্ধগ্রন্থ
- জনান্তিকে (১৯৪৯)
- মন পবনের নাও (১৯৫০)
- সরস প্রবন্ধ (১৯৬৮)
- বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস (প্রবন্ধ, ১৯৬০)
- কথা-ভারতী (অনুবাদ)
- দুর্গাপূজার গল্প (অনুবাদ)
১৯০৭ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা) এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র চার বছর বয়সে তার পিতা অতুলকুমার দত্ত মারা যান। তার মা হেমালিনী দেবী ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী।
১৯২৪ সালে ঢাকার কিশোরীলাল জুবিলী স্কুল থেকে অজিত দত্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন এবং জগন্নাথ কলেজে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯২৬ সালে তিনি কলকাতা চলে যান এবং বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার বড়ো ভাই মারা গেলে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হন। অজিত দত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বি.এ এবং ১৯৩০ সালে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তির্ণ হন।
অজিত দত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী পদে যোগদান করে তার কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পরেই তিনি কলকাতায় রিপন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে স্কুল ছেড়ে তিনি রিপন কলেজে যোগদান করেন। ১৯৩৬ সালে রিপন কলেজ ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপানশন বোর্ডে এসিস্ট্যান্ট পাবলিসিটি অফিসার পদে যোগ দেন এবং সেখানে তিনি ১০ বছর চাকরি করেন। এখানে পদোন্নতি না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাংকের অধিকর্তা শচীন ভট্টাচার্যের ১২/১৪টি কনসার্নের পাবলিসিটি অফিসার হন। এখানেও ১০ বছর চাকরি করে ১৯৫৬ সালের ২১শে আগস্ট তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।।
কবি অজিত দত্ত মূলত রোমান্টিক প্রেমের কবি। নারী ও প্রকৃতিকে শুভ দৃষ্টিতে দেখেছেন " কুসুমের মাস" কাব্যগ্ৰন্থের নাম কবিতায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত---
"আমিও কুসুমপ্রিয়। আজকে তো কুসুমের মাস।
মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম- বিতানে ।
বসিয়া নিভৃত কুঞ্জে কহিব তোমার কানে - কানে,
কোন ফুলে ভরিয়াছে জীবনের মধু অবকাশ"।
এই কাব্য গ্ৰন্থ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য--"প্রতিটি কথায় বর্ষার কোনো সিক্ত ফুলের মৃদু স্পর্শ, লঘু সৌরভ"। কবি জীবনানন্দের সুযষ নায়িকা 'বনলতা' তেমনি কবি অজিত দত্তের নায়িকা 'মালতী সুতরাং নায়িকার মালতীর চিত্রাঙ্কন স্বাভাবিক---
"মালতীর জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত্রি হয়েছে আতুর
একটি চুম্বন - তবে একটি গভীর আলিঙ্গন,
নিটল যৌবন তার রূপমদ্যে আজি ভরপুর
আকাশেও জ্যোৎস্না নয়, মালতীর সোনার স্বপন"।
জনপ্রিয় 'মালতি' আলোচনায় জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন-- "সৌন্দর্যের পরম প্রকাশে , মৃত্যু ও অমৃত পিপাসার মহাসঙ্গমে, অজিত দত্তের কুসুমের মাস প্রেম চেতনার তুঙ্গশিখর স্পর্শ করেছে। মৃত্যুকে সম্মুখে রেখেই কবি প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন----।----কবিচিত্তে এই প্রেমের আলম্বন --- স্বরূপিনীর নাম "মালতী" । মৃত্যুস্বয়ম্বরা এই মালতি কে ভালোবেসেই কবি পেয়েছেন জীবনসত্য কে"।
কবি অজিত দত্ত র "পাতালকন্যা" কাব্যগ্রন্থের 'রাঙা সন্ধ্যা' কবিতায় লিখেছেন----
"তুমি নীড়, তুমি উষ্ণ কোমল, পাখার শব্দ ক্ষীন।
তবু সে আমাকে ডাকে , ডাকে শুধু ছেদহীন ক্ষমাহীন"।
১৯৭৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর তিনি তার কলকাতার ২০ রাসবিহারী এভিনিউ এর বাড়িতে পরলোক গমন করেন।
কবিতা
*রাঙা সন্ধ্যা
রাঙা সন্ধ্যার স্তব্ধ আকাশ কাঁপায়ে পাখার ঘায়
ডানা মেলে দুরে উড়ে চলে যায় দুটি কম্পিত কথা,
রাঙা সন্ধ্যার বহ্নির পানে দুটি কথা উড়ে যায় |
পাখার শব্ দে কাঁপে হৃদয়ের প্রস্তর-স্তব্ ধতা,
দূর হতে দূর---তবু কানে বাজে সে পাখার স্পন্দন,
ক্ষীণ হতে ক্ষীণ, ঝড়ের মতন তবু তার মত্ততা |
চলে যায় তারা চোখের আড়ালে, লক্ষ কথার বন
অট্টহাস্যে কোলাহল করে, তবু ভেসে আসে কানে
পাখার ঝাপট, বজ্র ছাপায়ে এ কি অলিগুঞ্জন?
যাযাবর যত পক্ষী-মিথুন আসে তারা কোনখানে?
মানুষের ছায়া সে আলোর নিচে পড়েছে কি কোনদিন?
তুমি ত আমারে ভুলে যাবে নাকো যাই যদি সন্ধানে?
তুমি নীড়, তুমি উষ্ণকোমল, পাখার শব্ দ ক্ষীণ |
তবু সে আমাকে ডাকে, ডাকে শুধু ছেদহীণ ক্ষমাহীণ ||
*************
* যেখানে রুপালি
যেখানে রুপালি ঢেউয়ে দুলিছে ময়ূরপঙ্খী নাও,
যে-দেশে রাজার ছেলে কুমারীকে দেখিছে স্বপনে,
কুঁচের বরন কন্যা একাকী বসিয়া বাতায়নে
চুল এলায়েছে যেথা --- কালো আঁখি সুদূরে উধাও;
যে-দেশে পাষাণ-পুরী, মানুষের চোখের পাতাও
অযুত বত্সরে যেথা নাহি কাঁপে ইষত্ স্পন্দনে,
হীরার কুসুম ফলে যে-দেশের সোনার কাননে,
কখনো, আমার পরে, তুমি যদি সেই রাজ্যে যাও;
তাহ'লে, তোমারে কহি, সে-দেশে যে-পাশাবতী আছে,
মায়ার পাশাতে যেই জিনে লয় মানুষের প্রাণ,
মোহিনী সে-অপরূপ রূপময়ী মায়াবীর কাছে,
কহিয়া আমার নাম শুধাইও আমার সন্ধান;
সাবধানে যেও সেথা, চোখে তব মোহ নামে পাছে,
পাছে তার মৃদু কণ্ঠে শোনো তুমি অরণ্যের গান |
*************
একটি কবিতার টুকরো
মালতী, তোমার মন নদীর স্রোতের মতো চঞ্চল উদ্দাম;
মালতী, সেখানে আমি আমার সাক্ষর রাখিলাম |
জানি, এই পৃথিবীতে কিছুই রহে না;
শুক্ল কৃষ্ণ দুই পক্ষ বিস্তারিয়া মহা শূণ্যতায়
কাল-বিহঙ্গম উড়ে যায়
অবিশ্রান্ত গতি |
পাখার ঝাপটে তার নিবে যায় উল্কার প্রদীপ,
লক্ষ-লক্ষ সবিতার জ্যোতি |
আমি সেই বাউস্রোতে খ'সে-পড়া পালকের মতো
আকাশের নীল শূণ্যে মোর কাব্য লিখি অবিরত;
সে-আকাশ তোমার অন্তর,
মালতী, তোমার মনে রাখিয়াছি আমার সাক্ষর |
*************
* মিস্
কলঙ্ক-কঙ্কণ ভাঙো! ও কেবল ভূষণ তোমার |
বার-বার সকলের চোখের উপরে তাই বুঝি
সেই তব কলঙ্কের ঐশ্বর্য্যের মহামূল্য পুঁজি
ঢঙে আর ন্যাকামিতে নানা ভাবে করিছ প্রচার |
দ্রৌপদীর কথা ভাবি' মনে আনিও না অহংকার
ঊষাকালে তব নাম মানুষ স্মরিবে চোখ বুজি',
দুর্ভাগ্য, দুর্ভাগ্য তব, রাহুময় তোমার ঠিকুজি,
সেথায় নক্ষত্র নাই অনির্বাণ স্মরনীয়তার |
কলঙ্ক-ভূষণ খোলো! বহু-প্রেম-গর্ব যদি চাহ---
যদি ভালবাসিবার শক্তি থাকে, প্রিয়তম-মাঝে
দ্যাখো তবে পার্থ-ভীম-যুধিষ্ঠিরে, পঞ্চপাণ্ডবেরে;
যে কলঙ্কে লুব্ধ করি বহু হূ'তে বহুকরদেরে
ঊর্ণায় টানিতে চাও--- সে-ভূষণ নারীরে না সাজে,---
বিশ্বাস করিতে পারো, এর চেয়ে উত্কৃষ্ট বিবাহ |
*************
* নইলে
প্যাঁচ কিছু জানা আছে কুস্তির?
ঝুলে কি থাকতে পারো সুস্থির?
নইলে
রইলে
ট্রাম না-চ'ড়ে---
ভ্যাবাচাকা রাস্তায় প'ড়ে বেঘোরে |
প্র্যাকটিস করেছ কি দৌড়ে?
লাফিয়ে ঝাপিয়ে আর ভোঁ-উড়ে?
নইলে
রইলে
লরিতে চাপা,
তাড়া ক'রে বাড়ি থেকে বাড়িয়ো না পা |
দাঁত আছে মজবুত সব বেশ?
পাথর চিবিয়ে আছে অভ্যেস?
নইলে
রইলে
ভাত না-খেয়ে,
চালে ও কাঁকড়ে আধাআধি থাকে হে |
স্হির ক'রে পা দুটো ও মনটা,
দাঁড়াতে পারো তো বারো ঘন্টা?
নইলে
রইলে
না-কিনে ধুতি---
যতই দোকানে গিয়ে কর কাকুতি |
*************
* সনেট
এক বার মনে হয়, দূরে---বহু দূরে---শাল, তাল,
তমাল, হিন্তাল আর পিয়ালের ছায়া-ম্লান দেশে
প্রেম বুঝি নাহি টুটে, অশ্রু বুঝি কোনোদিন এসে
আঁখি হ'তে মুছে নাহি নেয় স্বপ্ন | বুঝি এ বিশাল
ধরণীর কোনো কোণে ফুল ফুটে রয় চিরকাল,
বসন্ত-সন্ধ্যার মোহ দক্ষিণ বাতাসে আসে ভেসে,
বুঝি সেথা রজনীর পরিতৃপ্ত প্রেমের আবেশে
প্রভাত-পদ্মের ভরে কেঁপে ওঠে তারার মৃণাল |
যদি তাই হয়, তবু সেই দেশে তুমি আর আমি
বাহুতে জড়ায়ে বাহু নাহি যাবো শান্তির সন্ধানে
মোদের জানালা-পথে ব'য়ে যাক পৃথিবীর স্রোত |
সে-স্রোতে কখনো যদি ভেসে আসে নীলাভ শরৎ
তোমার চোখের কোলে, মেঘ যদি কভু মোহ আনে,
স-চোখে আমার পানে চেয়ো তুমি অকস্মাৎ থামি' |
*************
* চরৈবেতি
কীর্তির সীমা উত্তোরণের পরে
অজ্ঞাতবাসে যাত্রারম্ভ করো,
রাজৈশ্বর্য পশ্চাত বন্দরে
ফেলে চল খুঁজি রাজ্য বৃহত্তর |
জীবনের পুঁথি যতোটা হয়েছে পড়া
নতুন গ্রন্থে চলো খুঁজি তার মানে!
এসো শুরু করি নতুন কুটির গড়া---
স্থাপত্য যার বিশ্বকর্মা জানে |
পিরামিড্ আর সৌধের জঞ্জালে
দিগন্ত আজ অর্ধেক গেছে ঢাকা |
আকাশের রং ছেয়েছে ধোঁয়ার জালে,
পাঁকে বসে গেছে ধর্মরথের চাকা |
জীবন উহ্য জীবনের আয়োজন,
প্রেমোপকরণে প্রেম অনুপস্থিত,
কীর্তির প্রেত রাজ্য ফেঁদেছে মনে,
বাক্যের জালে মগ্ন প্রাণের গীত |
কতো সম্পদ, কতো সোনা-রূপো-হীরে
জমেছে ঝাঁপিতে সারা দিন তাই গোনা,
এই অবসরে প্রেম এসে যায় ফিরে,
মুছে যায় ক্রমে হৃদয়ের আল্পনা |
চলো ফেলে দিই জীবনের জঞ্জাল,
নতুন মাটিতে নতুন ফসল বুনি,
পৃথিবী এখনো যৌবনে উত্তাল,
হৃদয় এখনো অপূর্ব ফাল্গুনী |
এখনো নয়নে নয়নের আলো খোঁজা,
জীবন গড়ার এখনো সময় আছে,
দীর্ঘপথের সোনালী নুড়ির বোঝা
যতো ফেলে যাওয়া, মুক্তি ততোই কাছে ||
*********************************
No comments:
Post a Comment