(১৬ অক্টোবর ১৮৬১ - ১৮ জানুয়ারী ১৯০১)
বিবেকানন্দ লিখেছেন—
"আমি আপনার কাছে আরও একটি অনুরোধ করব— যদি সম্ভব হয় আমার মায়ের জন্য আপনার উপবৃত্তির পরিমাণ একশত টাকা স্থায়ী করা হোক, যাতে আমার মৃত্যুর পরেও এটি তার কাছে নিয়মিত পৌঁছাতে পারে। অথবা এমনকি যদি আপনার কখনও আমার প্রতি আপনার ভালবাসা এবং দয়া বন্ধ করার কারণ পান, তবে আমার দরিদ্র বৃদ্ধ মাকে প্রদান করা যেতে পারে, আপনার একবার একজন দরিদ্র সন্ন্যাসীর প্রতি আপনার ভালবাসার কথা স্মরণে রেখে।"
রাজপুতানা এস্টেটের (অধুনা রাজস্থানের ঝুনঝুনু জেলার খেতরির শেখাওয়াত এস্টেটের (থিকানা) জনপ্রিয় শাসক। তিনি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যু শাসকের পদে ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পূর্ব সূরি ফতেহ সিং-এর মৃত্যুর পর, তিনি খেতরির অষ্টম রাজা হন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ অনুগামী ভক্ত ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর উত্তর রাজস্থানের আলসিসার শেখাওয়াত এস্টেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আলসিসারের বাসিন্দা ঠাকুর ছটু সিং। সিংহের মা ছিলেন যোধপুরের নিমাজের ঠাকুরের কন্যা।
সে সময় খেতরির রাজা ছিলেন ফতেহ সিং। তিনি অপুত্রক ছিলেন। সেকারণে অজিত সিংকে দত্তক নেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফতেহ সিং-এর মৃত্যুর পর, অজিত সিং সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং খেতরির অষ্টম রাজা হন। খেতরি আয়তনে ছোট হলেও রাজ্যটি ছিল সেসময়ের রাজস্থানের অন্যতম উন্নত ও প্রগতিশীল রাজ্য। অজিত সিং শিল্প ও সঙ্গীতের একজন বড় ভক্ত ছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাণী ভিক্টোরিয়ার হীরক জয়ন্তীতে যোগ দিতে ইংল্যান্ডে যান ।
বিবাহ এবং ব্যক্তিগত জীবন
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে অজিত সিং আউয়ার ঠাকুর দেবী সিংয়ের কন্যা চম্পাবতীজি সাহিবাকে বিবাহ করেন। রাণী চম্পাবতীজি সাহিবা ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে মারা যান। মহারাজ অজিত সিং এবং চম্পাবতীজি সাহিবার দুই কন্যা এবং এক পুত্র ছিল।
তাদের প্রথম কন্যা, সূর্য কুমারী, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন, তার বিবাহ হয় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে শাহপুরার রাজাধিরাজা সাহেব উমেদ সিংজি দ্বিতীয় বাহাদুরের সঙ্গে। সূর্যকুমারী ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট শাহপুরায় মারা যান।
তাদের দ্বিতীয় কন্যা, চন্দ্রকুমারী ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তার বিবাহ হয় প্রতাপগড়ের মান সিংয়ের সঙ্গে।
তাদের একমাত্র পুত্র জয় সিং সাহেব ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। অজিত সিং-এর পুত্র সন্তান লাভ ঘটেছিল স্বামীজির আর্শীবাদে। তিনি আজমিরের মেয়ো কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে অজিত সিংয়ের মৃত্যুর পর, জয় খেতরির নবম রাজা হন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার পিতার স্মৃতিতে অজিত সিং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ জয়পুরে মারা যান .
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের জুনে প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে আমৃত্যু (১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি) অজিত সিং স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিষ্য ছিলেন। কপর্দকশূন্য বাঙালি সন্ন্যাসীর বিশ্বজয়ী সাইক্লোনিক হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার পথে স্বীকৃতি, লোকবল, অর্থসাহায্য দিয়ে খেতরি রাজ অজিত সিং তার গুরুকে জগতে সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ করে দেন।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২২ নভেম্বরে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ উল্লেখ করেন—
"আপনার কাছে মন খুলে বলতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই এবং আমি আপনাকে এই জীবনে আমার একমাত্র বন্ধু বলেই মনে করি।"
এছাড়াও, ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ হতে আজীবন (অর্থাৎ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) তার গর্ভধারিনীর ভরণপোষণের মাসোহারার ব্যবস্থা, রামকৃষ্ণ মিশনের অঙ্কুরোদ্গম সবেতেই স্বামীজি পাশে পেয়েছিলেন খেতরিনরেশকে।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বিবেকানন্দ (তখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত) এবং রামকৃষ্ণের অন্যান্য আটজন শিষ্য বরানগর মঠে আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে, বিবেকানন্দ বরানগরের মঠ ত্যাগ করে একজন পরিভ্রমণকারী সন্ন্যাসী হিসাবে তার জীবন শুরু করেন। পরিব্রাজক হিসাবে স্বামীজি রাজস্থানের আবু পাহাড়ে প্রথমে চম্পাগুম্ফায় তপস্যায় নিমগ্ন, তিনি সাক্ষাৎ পান একজন মুসলমান উকিলের। পরে সেই উকিলের বাংলোয় অবস্থানকালে সেখানে আসেন খেতরি রাজার দেওয়ান জগমোহনলালজী। তারই মাধ্যমে অজিত সিংয়ের সঙ্গে স্বামীজির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে আবু পাহাড়ে রাজার রাজপ্রাসাদে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুনের সন্ধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন যোধপুরের রাজা প্রতাপ সিং। প্রথম সাক্ষাতে স্বামীজির বাংলা, ইংরাজী এবং সংস্কৃত ভাষার দক্ষতায় মুগ্ধ হন। পরিচয়ের প্রথম পর্বে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর রাতের আহার সমাপনান্তে রাত এগারোটায় রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করেন স্বামীজি। [৮]প্রথম পরিচয়েই স্বামীজি যেমন খেতরিনরেশের হৃদয় জয় করেন, তেমনই খেতরিনরেশও সন্ন্যাসীর হৃদয় স্পর্শ করেন। কেননা সেই সাক্ষাতের পর জুন মাসের ৬, ৮, ৯,১১,১৪,১৭,১৮ তারিখের বিভিন্ন সময়ে আবু পাহাড়েই রাজা অজিত সিংয়ের সাক্ষাৎ এবং নানা বিষয়ে তাদের আলোচনা হয়। [৯] পরে স্বামীজি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই অজিত সিংয়ের পীড়াপীতেই খেতড়ি অভিমুখে যাত্রা করেন। দুজনে ৭ আগস্ট খেতড়িতে পৌঁছানোর অল্প দিনের মধ্যেই রাজা অজিত সিং স্বামীজির কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করে তার শিষ্য হন। রাজা স্বামীজিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। স্বামীজিও আশা রাখতেন, খেতড়িনরেশের দ্বারা ভারতের কল্যাণ সাধনে তিনি কিছু করতে পারবেন। তাই তিনি তার ধর্মজীবনের ভার শুধু গ্রহণ করেন নি, লৌকিক জ্ঞানার্জনে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। পরিব্রাজক জীবনে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট হতে ২৭ অক্টোবর ছিল খেতড়িতে স্বামীজির দীর্ঘতম অবস্থান। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট খেতড়ির রাজার রাজসভায় রাজা অজিত সিংয়ের আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার শেষে রাজসভায় শেষ অনুষ্ঠানে বসছে মজলিস। এক বাঈজী গান গাইবেন। শুনে স্বামীজি সভা থেকে বেরুতে চাইলেন। খেতড়ীর রাজা তখন স্বামীজিকে অনুরোধ করলেন আরও কিছু ক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্য। স্বামীজি রাজার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছেন জেনে বাঈজী সেসময় শুরু করেন সুরদাসের ভজন—
'প্রভু মেরে অবগুণ চিত্ না ধর। সমদরশি হ্যায় নাম তুমহারও, চাহে তো প্যার করো...।’
যার অর্থ হল- হে প্রভু, হে ঈশ্বর, আমার মন্দগুণের (পাপটুকুর) দিকে তাকাইও না, সমদর্শী তুমি, তুমি তোমার নামের গৌরব অক্ষুন্ন রাখো।
বাঈজীর দরদি কণ্ঠের সেই বিখ্যাত গান শেষ হলে অভূতপূর্ব দৃশ্যে ধরা পড়ে স্বামীজির চোখে কেবল অশ্রুধারা। গান শুরুর পূর্ব মুহূর্তে স্বামীজির যে অকারণ দম্ভ ও বুদ্ধিবৃত্তির একধরনের অসহিষ্ণুতা ছিল, গণিকা বা পতিতা নারীদের প্রতি যে আভিজাত্যপূর্ণ ঘৃণা ছিল তা মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। সহসা জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষে তিনি বাঈজীকে মা সম্মোধন করেন। তিনি বুঝেছিলেন, ঈশ্বরের প্রকাশ ছাড়া এ ঘটনা কিছুতেই সম্ভব নয়। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের সাক্ষাতের পর এই অভাবনীয় ঘটনা নিঃসন্দেহে স্বামীজির জীবনে চিত্তশুদ্ধির উচ্চস্তরের দিশা প্রদর্শনে সহায়ক হয়েছিল।
রাজস্থানের প্রখর তাপ ও ঊষ্ণ বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজা অজিত সিং স্বামীজিকে পাগড়ি পরার পরামর্শ দেন এবং রাজস্থানী শৈলীতে পরার কৌশল দেখান। বিবেকানন্দ খুব দ্রুতই কৌশলটি শিখে নেন এবং পরবর্তীতে তিনি নিজস্ব শৈলী উদ্ভাবন করেন যা তার জীবনে সাধারণ পোশাকের অন্যতম অংশ হয়ে ওঠে। খেতড়িতে অবস্থানকালে বিবেকানন্দ রাজপুতানার সংস্কৃতি ও জীবনধারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বক্তৃতা ও চিঠিতে প্রশংসা করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যে অবস্থানকালে অজিত সিংকে এবং পরে ভারত প্রত্যাগমনের পর বহু চিঠি লেখেন। অজিত সিং বিবেকানন্দকে তার সমাজসেবার জন্য যে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন, তা তিনি নানা অবস্থানে তার চিঠিপত্রে ও বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর মুন্সি জগমোহনলালকে এক চিঠিতে লেখেন, "কিছু নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্ম হয় নির্দিষ্ট ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য। অজিত সিং এবং আমি এমন দুটি আত্মা- জন্মেছি যে মানবজাতির ভালো কাজের জন্য আমরা একে অপরকে সাহায্য করার জন্য। মানবজাতির ভালোর জন্য কাজ করুন।... আমরা একে অপরের পরিপূরক"
অজিত সিং নিজের খরচে আগ্রায় কিছু পুরানো স্থাপত্য নিদর্শন পুনরুদ্ধার করছিলেন এবং পরিদর্শনে আগ্রায় গিয়েছিলেন। তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি আগ্রায় মুঘল সম্রাট আকবরের সমাধি কমপ্লেক্সে একটি টাওয়ার আচমকা ভেঙে পড়ার কারণে আঘাত পান এবং সেই আঘাতের কারণে মারা যান। মথুরায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর ৩ মাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, স্বামী বিবেকানন্দও ৩৯ বৎসর পাঁচ মাস চব্বিশ দিন বয়স দেহত্যাগ করেন।
মিসেস সেভিয়ারকে দেখতে মায়াবতীতে যাওয়ার পথে স্বামীজি খেতরির রাজার আকস্মিক মৃত্যুর খবর পান। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি তিনি মিসেস ওলে বুলকে এক চিঠিতে দুঃসংবাদটি জানান।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে মার্হি হেলকে লেখা এক পৃথক চিঠিতে বিবেকানন্দ জানান—
খেতরির রাজা কয়েক মাস আগে আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় মারা যান। তাই আপনি নিশ্চয় বুঝতে পাচ্ছেন যে, এখন আমার সমস্ত কিছুই অন্ধকার হয়ে গেছে এবং আমার নিজের স্বাস্থ্যও ভাল নেই। তবুও আমি শীঘ্রই সব কিছু কাটিয়ে উঠব নিশ্চিত এবং পরবর্তী কাজের জন্য অপেক্ষায় আছি।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই নিবেদিতাকে স্বামীজি লেখেন- ‘আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মী খেতড়ীর রাজা’। মহারাজের অকালমৃত্যুর পর লিখেছিলেন, ‘আমি কখনও তাঁর অনুগ্রহের ঋণ শোধ করতে পারব না’।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে খেত্রির প্রাসাদে মহারাজ অজিত সিংয়ের পৌত্র বাহাদুর সর্দার সিং খেত্রিতে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখার জন্য খেত্রির প্রাসাদ দান করেন। প্রাসাদটির নামকরণ করা হয় বিবেকানন্দ স্মৃতি মন্দির। মহারাজ অজিত সিং এবং স্বামী বিবেকানন্দের মার্বেল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। প্রসাদের উপরের তলার যে ঘরে স্বামীজি অবস্থান করতেন এবং অজিত সিংয়ের সাথে আধ্যাত্মিক আলোচনার করতেন, সেটিকে উপাসনা ঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে.
==========∆∆∆∆∆∆∆∆=============
No comments:
Post a Comment