Sunday, 10 July 2022

শুভ প্রয়াণ দিবস। চিত্রশিল্পী অতুল বসু। Vol -792. Dt -10.09.2022. ২৫ আষাঢ় ১৪২৯. রবিবার। The bolgger in litareture e-magazine





অতুল বসু


মৃত্যু ১০ জুলাই,১৯৭৭ সাল। 



১৮৯৮ সালে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছেলেবেলা ময়মনসিংহ শহরেই কেটেছে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন-এর ময়মনসিংহ শাখায় তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। এরপর পড়াশোনা করেন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতার জুবিলি আর্ট একাডেমিতে। এই আর্ট একাডেমির পাঠ্যসূচি বাংলার অন্য আট দশটি সাধারণ বিদ্যাপীঠের মত ছিল না। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার এবং ভবানীচরণ লাহা। এখানকার ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি লন্ডনে অধ্যয়ন এবং ইউরোপ জুড়ে বিশেষ ভ্রমণের জন্য বৃত্তি পান। তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু বিনির্মাণে এই ভ্রমণ বিশেষ প্রভাব রেখেছিল।

চিত্রকলা বিষয়ক তিনটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণে অতুল বসুর ভূমিকা ছিল। ১৯১৯ সালে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ আর্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এক্ষেত্রে অতুল বসু তাকে সহায়তা করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান বাস্তববাদের উপর গুরুত্বারোপ করত এবং বাংলার স্কুলগুলোতে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির চেষ্টা করত। ওয়াস টেকনিকে অঙ্কিত লিরিক্যাল থিমের সাথে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। এই একাডেমি মূলত প্রতিকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং পল্লীর চিত্র অঙ্কনের ধারাকে অনুসরণ করেছিল। ১৯২১ সালে ভবানীচরণ লাহার সহযোগিতায় অতুল বসু সোসাইটি অফ ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটি প্রচলিত প্রাচ্য কলাচিত্রের তৎপরতা ও প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল। এছাড়া ১৯৩৩ সালে প্রদোৎকুমার ঠাকুর কর্তৃক একাডেমি অফ ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠার সময়ও অতুল বসু সক্রিয় সহযোগিতা করেন। তিনি কিছুকাল আবার কলকাতা স্কুল অফ আর্টস-এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

চিত্রকর্ম

মূলত তেল রং ব্যবহার করে অতুল বসু তার শৈল্পিক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন। তার চিত্রকর্মে কোমল উপস্থাপনা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কেবল সে চিত্রশিল্পীর পক্ষেই এটি সম্ভব যে তার শৈল্পিক পেশায় সূক্ষ্ণ কারিগরি তারতম্য সম্বন্ধে জানে। এছাড়া তার ছবিগুলোতে তুলির ব্যবহার অতি ব্যপৃত ছিল। তিনি উইন্ডসোর দুর্গ এবং বাকিংহাম প্রাসাদে সংরক্ষিত মূল বিষয়গুলো থেকে প্রতিকৃতি অঙ্কন করে বিখ্যাত হন। তার আত্মপ্রতিকৃতির শৈল্পিক মান ছিল অতি উঁচু। তার অসংখ্য শিল্পকীর্তির মধ্যে স্কেচ-এ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আবক্ষ প্রতিমূর্তি ('রয়েল বেঙ্গল টাইগার') এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালী অভিযানের সময়ে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তামগ্ন মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। ভারতের স্বাধীনতার পর সংসদে ও কলকাতার ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধে জাতীয় নেতাদের প্রতিকৃতি তার শিল্পপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

বিখ্যাত চিত্রকর্মসমূহ

কল্পনাপ্রবণ ও স্মৃতি জাগরূক স্ফিংস (তেল প্লাইউড দ্বারা অঙ্কিত)
আত্মপ্রতিকৃতি (১৯৪৫)

রচিত গ্রন্থ

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত "Verified Perspective"

সম্মাননা

অতুল বসু তার প্রথম শিল্প নৈপুণ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে 'গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি' পান। লণ্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমির ছাত্রাবস্থায় বিখ্যাত 'আইভরি' পুরস্কার লাভ করেন।


======={{{{{{{{{{{{{{{{}}}}}}}}}}}}}}}}}}}====






                                
  

Saturday, 9 July 2022

শুভ প্রয়াণ দিবস। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক রায়বাহাদুর রাজকুমার সর্বাধিকারী। Vol -791. Dt -09.07.2022. ২৪ আষাঢ়। উল্টো রথযাত্রা। The blogger in literature e-magazine


রায়বাহাদুর রাজকুমার সর্বাধিকারী


১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুলাই তিনি ৭২ বৎসর বয়সে  কলকাতায় প্রয়াত হন।।।।

 জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল ব্লকের রাধানগরের এক কায়স্থ বংশে। 'সঙ্গীতলহরী' ও 'তীর্থভ্রমণ' গ্রন্থের রচয়িতা যদুনাথ সর্বাধিকারী ছিলেন তার পিতা। রাজকুমার যদুনাথ সর্বাধিকারীর আট পুত্র সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের অসাধারণ অধিকারী ও সংস্কৃত কলেজের মেধাবী ছাত্র রাজকুমার বি.এ ও বি. এল পাশের পর রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে তিনি লখনউ চলে যান। রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি আওয়ধ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক এবং দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত 'সমাচার হিন্দুস্থানী' পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদ পান। পরে দক্ষিণারঞ্জন প্রতিষ্ঠিত লখনউ কলেজের (পূর্বতন ক্যানিং কলেজের, বর্তমানে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ) সংস্কৃতের ও আইনের অধ্যাপক হিসাবে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করেন। সেখানে রাজকুমার অধ্যাপনার সাথে সাথে অযোধ্যার তালুকদার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হন এবং দক্ষতার কাজ করতে থাকেন। আইনগত কোন সমস্যায় তিনি Taluqdari system of oudh তথা 'অযোধ্যার তালুকদারী প্রথা' নামে এক উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দক্ষিণারঞ্জন প্রতিষ্ঠিত "লখনউ টাইমস্" পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।

 ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালের মৃত্যুর পর তিনি কলকাতার ইংরাজী সাপ্তাহিক হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হন। 

অবসর গ্রহণের পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। তার প্রচেষ্টাতেই ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ হতে হিন্দু প্যাট্রিয়ট দৈনিক সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হয়। 

তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর আইন অধ্যাপক হন। তার প্রদত্ত টেগোর বক্তৃতামালা "হিন্দু ল' অব ইনহেরিটান্স" নামে প্রকাশিত হয়। তৎকালীন ছাত্রদের উপযোগী ব্রিটিশ সংবিধানের ইতিহাস - "ইংলণ্ডের শাসন প্রণালী" এদেশে তিনিই প্রথম রচনা করেন তিনটি ভাগে। প্রথম ভাগ এন্ট্রান্স ক্লাশে, দ্বিতীয় ভাগ এফ.এ ক্লাশে ও তৃতীয় ভাগ বি.এ ক্লাশে পড়ানো হত। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে "রায়বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করে। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ গুলি হল -

১) ঠাকুর আইন সংক্রান্ত উপদেশমালা
২) ব্যাকরণ প্রবেশিকা

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। আর এক অগ্রজ ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক সূর্যকুমার সর্বাধিকারী। এই তিন ভ্রাতা মিলে বাঙালি জাতির উন্নয়ন ও বিকাশ নানা অবদান রেখে গেছেন। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় বিদ্যাসাগরের মহৎ কাজে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন ছিল এবং তারা প্রচুর অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। 




======={{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}========

Thursday, 7 July 2022

শুভ প্রয়াণ দিবস। বিশিষ্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। Vol -790. Dt -08 July,2022. ২৩ আষাঢ়,১৪২৯. শুক্রবার। The blogger in literature e-magazine


" মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ
মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত
আকাশের দিকে বিক্ষিপ্ত;
বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র
আগুনের শিখার মত হাওয়ায় কম্পমান। "

সুভাষ মুখোপাধ্যায়


যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালে ৮ জুলাই কলকাতায় তাঁর প্রয়াণ ঘটে। 


"ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত”
বা 
"প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয়, হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।"
বা
"জলায় এবার ভাল ধান হবে –
বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে
এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে
সারাটা উঠোন জুড়ে
অন্ধকার নাচাতে নাচাতে"
বা 




গ্রন্থাবলি
কাব্যগ্রন্থ

পদাতিক (১৯৪০), অগ্নিকোণ (১৯৪৮), চিরকুট (১৯৫০), ফুল ফুটুক (১৯৫৭), যত দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬), এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২), একটু পা চালিয়ে ভাই (১৯৭৯), জল সইতে (১৯৮১), চইচই চইচই (১৯৮৩), বাঘ ডেকেছিল (১৯৮৫), যা রে কাগজের নৌকা (১৯৮৯), ধর্মের কল (১৯৯১)।

কবিতা সংকলন

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড (১৩৮১ বঙ্গাব্দ), কবিতাসংগ্রহ ১ম খণ্ড (১৯৯২), কবিতাসংগ্রহ ২য় খণ্ড (১৯৯৩), কবিতাসংগ্রহ ৩য় খণ্ড (১৯৯৪), কবিতাসংগ্রহ ৪র্থ খণ্ড (১৯৯৪)।

অনুবাদ কবিতা

নাজিম হিকমতের কবিতা (১৯৫২), দিন আসবে (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ, নিকোলো ভাপৎসারভের কবিতা), পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ (১৩৮০ বঙ্গাব্দ), ওলঝাস সুলেমেনভ-এর রোগা ঈগল (১৯৮১ বঙ্গাব্দ), নাজিম হিকমতের আরো কবিতা (১৩৮৬ বঙ্গাব্দ), পাবলো নেরুদার আরো কবিতা (১৩৮৭ বঙ্গাব্দ), হাফিজের কবিতা (১৯৮৬), চর্যাপদ (১৯৮৬), অমরুশতক (১৯৮৮)।

ছড়া

মিউ-এর জন্য ছড়ানো ছিটানো (১৯৮০)।

কবিতা সম্পর্কিত গদ্যরচনা

কবিতার বোঝাপড়া, টানাপোড়েনের মাঝখানে।

রিপোর্টাজ ও ভ্রমণসাহিত্য

আমার বাংলা (১৯৫১), যেখানে যখন (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), ডাকবাংলার ডায়েরী (১৯৬৫), নারদের ডায়েরী (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), যেতে যেতে দেখা (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), ক্ষমা নেই (১৩৭৮ বঙ্গাব্দ), ভিয়েতনামে কিছুদিন (১৯৭৪), আবার ডাকবাংলার ডাকে (১৯৮৪), টো টো কোম্পানী (১৯৮৪), এখন এখানে (১৯৮৬), খোলা হাতে খোলা মনে (১৯৮৭)।

অর্থনৈতিক রচনা

ভূতের বেগার (১৯৫৪, কার্ল মার্ক্স রচিত ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল অবলম্বনে)।

অনুবাদ রচনা

মত ক্ষুধা (১৯৫৩, ভবানী ভট্টাচার্যের সো মেনি হাঙ্গার্স উপন্যাসের অনুবাদ), রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ (১৯৫৪), ব্যাঘ্রকেতন (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মভিত্তিক একটি অনুবাদ), রুশ গল্প সঞ্চয়ন (১৯৬৮), ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন (১৯৬৮), চে গেভারার ডায়েরী (১৯৭৭), ডোরাকাটার অভিসারে (১৯৬৯, শের জঙ্গের ট্রায়াস্ট উইথ টাইগার্স অবলম্বনে), আনাফ্রাঙ্কের ডায়েরী (১৯৮২), তমস (১৩৯৫ বঙ্গাব্দ, ভীষ্ম সাহানীর উপন্যাসের অনুবাদ)।

উপন্যাস

হাংরাস (১৯৭৩), কে কোথায় যায় (১৯৭৬)।

জীবনী

জগদীশচন্দ্র (১৯৭৮), আমাদের সবার আপন ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন (১৯৮৭), ঢোলগোবিন্দের এই ছিল মনে।

শিশু ও কিশোর সাহিত্য

নীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের কিশোর সংস্করণ (১৯৫২), অক্ষরে অক্ষরে আদি পর্ব (১৯৫৪), কথার কথা (১৯৫৫), দেশবিদেশের রূপকথা (১৯৫৫), বাংলা সাহিত্যের সেকাল ও একাল (১৯৬৭), ইয়াসিনের কলকাতা (১৯৭৮)।

সম্পাদিত গ্রন্থ
সম্পাদনা
কেন লিখি (১৯৪৫, বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকদের জবানবন্দী, হিরণকুমার সান্যালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রচিত), একসূত্র (১৯৫৫, ফ্যাসিবিরোধী কবিতা সংকলন, গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা), ছোটদের পুজো সংকলন – পাতাবাহার, বার্ষিক আগামী ইত্যাদি।

সংকলন
গদ্যসংগ্রহ (১৯৯৪)

সম্মান
 সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে; ১৯৭৭ সালে অ্যাফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইজ; ১৯৮২ সালে কুমারন আসান পুরস্কার; ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার; ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ওই বছরেই পান সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।[৭] ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত করেছিল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা।

এছাড়াও প্রগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়নের ডেপুটি সেক্রেটারি ও ১৯৮৩ সালে অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সাধারণ সংগঠক নির্বাচিত হন কবি। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ছিলেন সাহিত্য অকাদেমীর একজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য।

যদিও নিজের কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর রসিকতার অন্ত ছিল না। কখনও তিনি নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার মতো লোকেদের মা-সরস্বতী দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে মারেন।’ আবার লিখেছেন কোথাও, ‘আমার লেখায় আমি দেখেছি, যে জায়গাটা লোকে খুব প্রশংসা করেছে, এটা দারুণ লিখেছো, সে সব জায়গা, আমি দেখেছি, আসলে আমার নয়। অন্যের কথা। সাধারণ মানুষের কথা। আমি মেরে দিয়েছি। আত্মসাৎ করেছি। কেউ ভিক্ষে করে খায়। তুমি কী করো? না, টুকিয়ে, টুকিয়ে খাই।’ তবে দিনের শেষে নিজের কবিতা লেখার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি চাই কবিতা দিয়ে মানুষের হাতগুলোকে এমন ভাবে কাজে লাগাতে যাতে দুনিয়াটা মনের মতো করে আমরা বদলে নিতে পারি।’

আর এখন যখন ধর্ম ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, ধর্মের শাখাপ্রশাখায় যেখানে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চতুর্দিক, সেখানে সেই ১৯৮৫ সালে এক জায়গায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘এ দেশের মুসলমানের সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষের তো রক্তেরই সম্বন্ধ।’ লিখেছিলেন, ‘...মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে শাস্ত্রের গণ্ডি টেনে ধর্মকে যারা খাটো করতে চাইছে, আসলে তারাই যে ঘরের

শত্রু বিভীষণ— এটা আজ বোঝবার সময় এসেছে।’ বিশ্বাস করতেন, ইংরেজি আগ্রাসনেও ‘মুখে মুখে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে।’ বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন— ‘আমি যত দূরেই যাই।/ আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোনে/ সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা...’।

তাঁর সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই সম্পর্কের যাত্রাপথকে রাজ্য সরকারের তরফে আগামিকাল, মঙ্গলবার উদ্‌যাপন করা হবে। সেই সঙ্গে সারা শহর জুড়ে ‘পদাতিক’ কবির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অন্য অনেক অনুষ্ঠান তো রয়েছেই।

‘‘নিজের জন্মদিন পালন পছন্দ না করলে কী হবে, আমাদের জন্মদিন পালনের জন্য সব কিছু করতেন দাদু। হয়তো ঘর অন্ধকার। রাতে ঘুমিয়ে আছি। মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার সেই ঘরে ঢুকতেন। তার পরে বলতেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’’’— বলছিলেন পৃথা।

জন্ম  পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯। তাঁর পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। পিতা ছিলেন সরকারি আবগারি বিভাগের কর্মচারী; তার বদলির চাকরির সুবাদে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। তার ছেলেবেলার প্রথম দিকটা, যখন তার বয়স তিন-চার, সে সময়টা কেটেছে কলকাতায়, ৫০ নম্বর নেবুতলা লেনে। একটা ভাড়াবাড়ির দোতলায় যৌথ পরিবারের ভিড়ের মধ্যে।] প্রথমে নওগাঁর স্কুলে এবং পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সক্রিয় রাজনীতি করার মানসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’[৪]

১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ বিএ পাস করেন। পরে আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে প্রয়াসী হন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার ফলে পঠনপাঠন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কবি শিক্ষকরূপে লাভ করেন কবি কালিদাস রায় ও কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক মুরলীকৃষ্ণ বসুকে। বিদ্যালয়ে বন্ধুরূপে পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়, পরিমল সেনগুপ্ত, রমাকৃষ্ণ মৈত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে। আরো পরে কর্মজীবনে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, কারাজীবনের সঙ্গী আব্দুর রজ্জাক খান, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, উর্দু সাহিত্যিক পারভেজ শহীদী, চারু মজুমদার, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখের।


কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাধারণ মানুষের কথাকে নিজের কবিতায় তুলে এনেছিলেন। সাধারণ মানুষের ভাষাই তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল কবিতা। শুধু কবিতাই নয়। অসাধারণ গদ্য লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন!


"আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।
কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
যেন আমি হেঁটে যাই."

===={{=={=={{{{{{{{∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}==}==}}









Wednesday, 6 July 2022

শুভ প্রয়াণ দিবস। শার্লক হোমস এর স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। Vol -789. Dt - 07.07.2022. ২২ শা আষাঢ় ১৪২৯.

আর্থার কোনান ডয়েল

১৯৩০ সালের ৭ জুলাই ৭১ বছর বয়সে হার্ট অ্যটাকে স্যার আর্থার কনান ডয়েলের মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুর ঠিক আগে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন,”You are wonderful.”

স্যার আর্থার কনান ডয়েল লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও খেলাধুলা করতে ভালোবাসতেন৷ সাউথ সি তে থাকাকালীন তিনি পোর্টসমাউথ অ্যসোসিয়েসন ফুটবল ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতেন৷ ১৮৯৯-১৯০৭ সালের মধ্যে তিনি মের্লবোন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন৷ ডয়েল শখের বক্সিংও করেছেন৷ ১৯১০ সালে তিনি ক্রোবারো বেকন গল্ফ ক্লাবের ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন৷
তাঁর রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল, ‘দ্য সাইন অফ দ্য ফোর'(১৮৯০), ‘দ্য ফার্ম অফ গ্রিডেল স্টোন’ ( ১৮৯০), ‘দ্য হোয়াইট কোম্পানি'( ১৮৯১) , ‘দ্য গ্রে শ্যাডো'( ১৮৯২), ‘দ্য রিফিউজি’ ( ১৮৯৩) , ‘রডনি স্টোন’ ( ১৮৯৬), ‘দ্য ট্র্যাজেডি অফ কোরস্কো'( ১৮৯৮), ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড'( ১৯১২), ‘দ্য ল্যন্ড অফ মিস্ট’ (১৯২৬) প্রভৃতি। তাঁর লেখা ছোটো গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য অ্যডভেঞ্চার অফ শার্লক হোমস'( ১৮৯২) , ‘দ্য মেমরী অফ শার্লক হোমস'( ১৮৯৪), ‘রাউন্ড অফ ফায়ার স্টোরিস'( ১৯০৮), ‘হিস লাস্ট বো'( ১৯১৭) প্রভৃতি।
 তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন আসে নানান ভাবে ৷ তাঁর স্ত্রী লুসিয়া ৪ জুলাই ১৯০৬ সালে টি.বি রোগে মারা যান। ১৯০৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন৷ ইতিমধ্যে ডয়েল নাটক রচনার দিকে মন দেন। তাঁর লেখা ‘ব্রিগেডিয়ার জেরা্রড'(Brigadier Gerard) এবং ‘দ্য ট্রাজেডি অব করস্কো'(The Tragedy of the Korosko) কোনটিই তেমন সাফল্য পায়নি। হতাশ না হয়ে তিনি তৃতীয় নাটক লেখেন৷ বক্সিংয়ের উপর ভিত্তি করে ‘দ্য হাউস অব টেম্পারলে’ (The House of Temperley)নাটকটিও সফলতা পায় নি৷ তাঁর চতুর্থ নাটক ‘দ্য স্পেকল্ড ব্যান্ড'(The Speckled Band) সফলতার মুখ দেখে৷ এই নাটকের সফলতার পর তিনি নাটক লেখা থেকে বিরতি টানেন। নাটক লেখা থেকে তাঁর এই স্বেচ্ছাবসর সম্পর্কে তিনি বলেন,”Not because it doesn’t interest me, but because it interests me too much” 

১৮৫৯ সালের ২২ মে স্কটল্যান্ডের ইডেনবার্গে স্যার আর্থার কনান ডয়েলের জন্ম হয় ৷ তাঁর বাবার নাম চার্লস আল্টামন্ট ডয়েল (Charles Altamont Doyle) এবং মায়ের নাম মেরী। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন শিল্পী ১৮৯৩ সালে মারা যান৷
নয় বছর বয়সে স্যার আর্থার কনান ডয়েলের প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু হয় ইংল্যান্ডের জেসুইট প্রিপেটরি স্কুলে (Jesuit preparatory school)। এরপর ১৮৭৫ সালে তিনি স্টোনিহার্সট কলেজে (Stonyhurst College) ভর্তি হন৷ ১৮৭৫ – ৭৬ সালে তিনি জেসুইট স্কুল স্টিলা ম্যাটুটিনা(Stella Matutina)তে ভর্তি হন। ১৮৭৬ সালে সতেরো বছর বয়সে তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত তিনি মেডিকেল নিয়ে পড়াশোনা করেন ইউনিভার্সিটি অফ ইডেনবার্গ মেডিক্যাল স্কুলে ( University of Edinburgh Medical School)।এই একই সময়ে তিনি প্র্যাকটিকাল বোটানির পাঠও নেন রয়াল বোটানিক গার্ডেন থেকে৷

স্যার আর্থার কনান ডয়েলের কর্মজীবন শুরু হয় ১৮৮০ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে মেডিক্যালে তৃতীয় বর্ষের পড়াশোনা চলাকালীন স্কটল্যান্ডের পিটারহেডে অবস্থিত গ্রীনল্যান্ড হোয়েলার হোপ(Greenland whaler Hope ) -এ চিকিৎসক হিসেবে। এটি আসলে ছিল ‘ হোপ’ নামক একটি জাহাজ যেখানে তিনি সার্জেনের চাকরী পেয়েছিলেন৷ পড়াশোনা চলাকালীন তিনি ছোটোগল্প লেখা শুরু করেন৷ তাঁর প্রথমদিকের লেখা একটি গল্প ‘The Haunted Grange of Goresthorpe’ ব্ল্যাকউড’স ম্যগাজিনে পাঠিয়ে ছিলেন কিন্তু সেটি ছাপা হয় নি৷ তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প হল ‘দ্য মিস্ট্রী অব সাসাসা ভ্যালি'(The Mystery of Sasassa Valley) যেটি ৬ ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৯ সালে Chambers’s Edinburgh Journal – এ প্রকাশ পায়৷এডগার অ্যলান পো এবং ব্রেট হার্টে ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক৷ প্রথম লেখা প্রকাশ পাওয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়ে লেখালিখির দিকে মনোযোগ দেন। ১৮৮৯ সালেই ডয়েলের লেখা দ্বিতীয় গল্প ‘দ্য আমেরিকান টেল’ (The American Tale) লন্ডন সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়৷ জাহাজে সার্জেন্টের চাকরির অভিজ্ঞতায় তিনি সমুদ্র নিয়ে তাঁর প্রথম অ্যডভেঞ্চারের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন ‘ক্যাপ্টেন অব পোল স্টার’ (Captain of the Pole-Star) নামে। কনান ডয়েল মেডিকেলে স্নাতক হয়ে যাওয়ার পর মায়ুম্বা ‘Mayumba’ নামের একটি স্টিমারে মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন৷ এই চাকরিটি তাঁর পছন্দ না হওয়ায় স্টিমার ইংল্যান্ডে পৌঁছলে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন৷ চাকরি ছেড়ে তিনি নিজস্ব প্র্যাকটিস শুরু করেন৷ চিকিৎসার পাশাপাশি একজন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও এই সময় তিনি লেখালিখি চালিয়ে যান।
১৮৮৬ সালের মার্চ মাস থেকে তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন৷ এই উপন্যাস তাঁকে পরিচিতি দিতে শুরু করে। তাঁর এই উপন্যাসে দুটি প্রধান চরিত্র ছিল একজন ‘সেরিদান হোপ’ আরেকজন ‘অর্মন্ড সেকার’। দুই বছর পর ১৮৮৭ সালে উপন্যাস টি বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল (Beeton’s Christmas Annual) ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট'(A Study in Scarlet) এই উপন্যাসেই শার্লক হোমস এবং ডঃ ওয়াটসন এর প্রথম দেখা পাওয়া যায়। এরপর ডয়েলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকটি আসে। যে সমস্ত উপন্যাসে শার্লক হোমসের উপস্থিতি ছিল সেগুলির জন্য লেখকের পরিচিতি বাড়তে থাকে। বাণিজ্যিক ভাবে সফল হয়ে ওঠে তাঁর লেখা উপন্যাসগুলি। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস, কবিতা এবং নাটক লিখে ছিলেন।

১৮৮৮ সালে তিনি ‘দ্য মিস্ট্রি অফ ক্লোম্বার’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন যার বিষয়বস্তু ছিল তিনটি বৌদ্ধ ভিক্ষুকের জীবনী৷ এই গল্পটিতে কনান ডয়েল তাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রতি মুগ্ধতার কথা বর্ণনা করেছেন ৷ ১৮৮৮ – ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি সাতটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন যেগুলির জন্য তিনি সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন৷ ডয়েলের মতে ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট কম্পানি'(The White Company) লেখার সময়ে তিনি সবথেকে বেশী আনন্দ পেয়েছিলেন৷ তিনি নয়টি উপন্যাস ছাড়াও পাঁচটি আখ্যান এবং’প্রফেসার চ্যালেঞ্জার’এর নামে একটি গল্পের সিরিজ লিখেছিলেন। শার্লক হোমসের সিরিজের পর এটিই তাঁর সর্বাধিক পরিচিত ও সেরা লেখা হিসেবে গন্য হয়৷ প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের চরিত্রটি ছিল শার্লক হোমসের সম্পূর্ণ বিপরীত। স্যার আর্থার কনান ডয়েল ইংল্যান্ডের তুলনায় আমেরিকাতে লেখক হিসেবে বেশী খ্যাতি পেয়েছিলেন৷
সুইজারল্যান্ডে ঘুরতে গিয়ে কনান ডয়েল একটি জলপ্রপাত দেখে ঠিক করেন তাঁর গোয়েন্দা গল্পের মূল চরিত্রকে এখানেই তিনি শেষ করে দেবেন৷ ১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম ‘ গল্পে শার্লক হোমস জলপ্রপাতের উপর থেকে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়৷ গল্পটি প্রকাশের পর ‘দ্য স্ট্র্যাণ্ড ম্যাগাজিনের’ (যেখানে শার্লক হোমসের গল্পগুলি প্রকাশিত হত) প্রায় কুড়ি হাজার গ্রাহক তাদের সাবস্ক্রিপশন তুলে নেয়৷ জনতার মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা যায়। সেই বিক্ষোভের ফলে ১৯০২ সালে ‘দ্য হাউণ্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’ গল্পে তিনি আবার শার্লক হোমসকে ফিরিয়ে আনেন৷ গল্পটি সাফল্য পায় এবং ম্যাগাজিনের গ্রাহক সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়৷

={=={{=[{{{{{{[{{{]==[[[[[=======[{{{{{======

Tuesday, 5 July 2022

শুভ প্রয়াণ দিবস। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শঙ্করী প্রসাদ বসু। Vol - 788. Dt - 06.07.2022. ২১ আষাঢ়, ১৪২৯. The blogger in literature e-magazine

শঙ্করীপ্রসাদ বসু

বিশিষ্ট লেখক ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু প্রয়াত হয়েছেন। রবিবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিট নাগাদ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে তাঁর জীবনাবসান হয়। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি। ৩০ জুন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর বড় ছেলে সুদীপ জানান, আজ, সোমবার হাওড়ার শিবপুর শ্মশানে শঙ্করীবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।

শঙ্করীবাবু দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে লেখক-চিন্তাবিদ হিসেবে নিজস্বতার ছাপ রেখে গিয়েছেন তিনি। রম্য ভঙ্গিতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চর্চা থেকে ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি শঙ্করীবাবু বিচিত্রচারী। ষাটের দশকে বাংলা খবরের কাগজে ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ নিয়ে প্রতিবেদন লেখার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর বইও আছে ‘লাল বল লারউড’। আবার তিনিই সাত খণ্ডে ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর মতো গবেষণালব্ধ বই লিখতে দীর্ঘ কাল কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
 ছোটো ছেলে শঙ্খ বসু বলেছেন, "বাবা বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। সঙ্গে ধরা পড়েছিল রক্তের সংক্রমণ। ২৯ জুন তাঁকে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করি। বাবাকে হারিয়ে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।" তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে অনেকগুলি লেখা অপ্রকাশিত অবস্থাতেই থেকে গেল। আজ, সোমবার শিবপুর শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মৃত্যুতে শোক ব্যক্ত করেছেন শঙ্কর, প্রফুল্ল রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক। শোকস্তব্ধ সাহিত্য অনুরাগী মানুষও।
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৯), শরৎ পুরস্কার (১৯৮০), বিবেকানন্দ পুরস্কার (১৯৮৬), বিদ্যাসাগর পুরস্কার (১৯৯৬) ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

                   জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার তৎকালীন রিপন কলেজ বর্তমানের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাশ করেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু এম.এ পাশের পর প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন হাওড়ারই বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে। তারপর পর্যাক্রমে হাওড়া দীনবন্ধু কলেজ, হাওড়া গালর্স কলেজ, কলকাতার ও আমহাস্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে অধ্যাপনার পর স্থায়ীভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। তিন দশকের বেশি সময় কাজ করে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্যাতকীর্তি গবেষক ও ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপকপদ থেকে অবসর গ্রহণের পর, আমৃত্যু রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের (গোলপার্ক) স্বামী বিবেকানন্দ আর্কাইভসের ডিরেক্টর এবং নিবেদিতা-চেয়ারে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

নানা বিষয়ে সত্তরটিরও বেশি গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে– রসসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, মধ্যযুগের সাহিত্য, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, সমালোচনা ইত্যাদি। বাল্যে-যৌবনে তিনি ক্রিকেট খেলতে ভালবাসতেন। হাওড়ার ঘেষের মাঠে টেনিসের বলে ব্যাট করে পরে কলকাতার মাঠে সিএবি লিগেও খেলেছেন তিনি। বাংলায় ধারাবিবরণী দিয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় স্বাদু বাংলায় খেলার বিবরণীও লিখেছেন। স্বভাবতই ক্রিকেট নিয়ে বাংলা ভাষায় আছে কয়েকটি রম্যরচনা।তবে বিবেকানন্দ ও সমকালীন ইতিহাস নিয়ে রচিত গবেষকগ্রন্থ তাঁর মনীষা ও কঠোর পরিশ্রমের নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ ভারতেতিহাসের এমন দিক উন্মোচন করেছেন যা ইতিহাসের গবেষকদেরও শিক্ষনীয়। যে অনুসন্ধিৎসা ও তথ্যবিস্তার সাত খণ্ডের 'বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ' বা চার খণ্ডের 'নিবেদিতা লোকমাতা' ইত্যাদি গ্রন্থজুড়ে লক্ষিত হয় তা' অনন্য, অতুলনীয়। উপরোক্ত গ্রন্থদুটি তথ্যসমৃদ্ধ আকরগ্রন্থ হিসাবে পরিগণিত। 


রচনা কর্ম: 

বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ,( সাত খণ্ডে)
সহাস্য বিবেকানন্দ 
এবং বন্ধু বিবেকানন্দ. 
 নিবেদিতা লোকমাতা।
আমাদের নিবেদিতা
লেটার্স অফ সিস্টার নিবেদিতার (সম্পাদনা)
মধ্যযুগের কবি ও কাব্য।
কৃষ্ণ
রামকৃষ্ণ সারদা জীবন হে প্রসঙ্গ
চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি
বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম
কবি ভারতচন্দ্র
বল পড়ে ব্যাট নড়ে
ক্রিকেট, সুন্দর ক্রিকেট
নট আউট  
লাল বল লারউড। প্রভৃতি।

                   নেতাজীর উপর অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর প্রথম বই ‘সুভাষচন্দ্র ও ন্যাশন্যাল প্লানিং’ ১৯৭০ সালে জয়শ্রী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বইয়ের মুখবন্ধ থেকেই জানতে পারা যায় যে সেই প্রকাশনার মাসিক ‘জয়শ্রী’ পত্রিকাতে ১৯৬৭-র জানুয়ারিতে, অর্থাৎ ‘নেতাজী-সংখ্যায়’, এ বিষয়ে অধ্যাপক বসুর একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধ পাঠের সৌভাগ্য না হলেও এ সম্বন্ধে অধ্যাপক বসুর একটা রচনা ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে “জয়শ্রী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু জন্মশতবার্ষিকী গ্রন্থের” ১২৫ থেকে ১৩৯ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিও সেই রচনাটার শীর্ষকও “সুভাষচন্দ্র ও ন্যাশন্যাল প্লানিং” এবং প্রবন্ধের শেষে লেখা রয়েছে “এই প্রবন্ধটি লেখকের ‘সুভাষচন্দ্র ও ন্যাশন্যাল প্লানিং’ গ্রন্থের অংশবিশেষ”, কিন্তু কিছু কিছু মিল থাকলেও দু’টো আলাদা রচনা। এটা কি সেই ১৯৬৭ জানুয়ারির জয়শ্রী পত্রিকায় প্রকাশিত সেই প্রবন্ধ? তা জানতে পারা গেল না।

যাইহোক, সুভাষচন্দ্রের উপর লেখা এই প্রথম বইতেই কিন্তু অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্পষ্ট করে দিয়েছেন দেশনায়ক সম্পর্কে তাঁর মনোভাব। তিনি লিখেছেন, “এই গ্রন্থে আমি দেখাতে চেয়েছি সুভাষচন্দ্রের জীবনের নেতাজী-পর্ব যত বড়ই হোক – হয়তো সর্বোচ্চ শিখর – তার পূর্বেই তিনি যে চিন্তা ও কর্মশক্তি দেখিয়েছিলেন, তার দ্বারাই ভারত-ইতিহাসে তাঁর স্থান সুনির্ধারিত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ১৯৪০ পর্যন্ত সময়ে সকল কংগ্রেস-নেতার মধ্যে সুভাষচন্দ্রই সর্বাধিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন; সেই সঙ্গে অনুরূপ কর্মপ্রতিভাসসম্পন্ন পুরুষ। …নিজস্বতার জন্য গান্ধীবাদী ও মার্ক্সবাদী কারো কাছেই তিনি প্রিয় হননি কারণ সুভাষচন্দ্র কোন কিছুর দাসত্ব করবার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি।”

আর সেই জয়শ্রী জন্মশতবার্ষিকী গ্রন্থের প্রবন্ধটা তিনি শেষ করেছেন এভাবে যাতে আমরা অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সাথে ১০০ শতাংশ একমত। অধ্যাপক বসু লিখেছেন, “পণ্ডিতজী, (অর্থাৎ জওহরলাল নেহেরু), প্লানিং কমিশনের উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন তাঁর ‘ডিসকভারি অব্ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে। কিন্তু ঐ অংশে সুভাষচন্দ্রের নামোল্লেখ নেই।”

তিনি আরও লিখেছেন, “পণ্ডিতজী যখন স্বাধীন ভারতের নায়ক, তখনও পরিকল্পনা-বিষয়ক নানা পুস্তিকা বেরিয়েছে। তাতেও সুভাষচন্দ্র অনুল্লিখিত।

“ইতিহাসের বিচিত্র বিধান। প্লানিং কমিটির ব্যাপারে যাঁকে প্রচুরতম ক্ষতি স্বীকার করতে হল, প্লানিং কমিটির ইতিবৃত্ত তাঁকেই ভুলে গেল। সুভাষচন্দ্র এতে কিছু মনে করেন না, কারণ তিনি তাঁর একটি আদর্শের মধ্যে সান্ত্বনার অফুরন্ত উৎস আবিষ্কার করেছেন—‘ব্যক্তিকে মরতে হবে, যাতে করে জাতি বাঁচে, আজ আমাকে মরতে হবে, যাতে ভারত বাঁচতে পারে, স্বাধীন হতে পারে, অর্জন করতে পারে মহা গৌরব।”

অধ্যাপক বসু তারপর লিখছেন, “আমরা যারা সুভাষচন্দ্র নই, সুভাষচন্দ্র থেকে বহুদূরে আছি – সেই আমরা ঐ মহাবাক্যে সান্ত্বনা পাই না। শুনেছি ইতিহাস সত্য কথা বলে, তবে সে সত্যকে দেখে যাবার সৌভাগ্য অধিকাংশ মানুষের ঘটে না।”

কি সুন্দর পরিমার্জিত ভাষায় তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি ঈর্ষাকাতর তথাকথিত বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন এই লেখায়, তা আমাদের তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর ভক্ত করে ফেলে নিমেষে।

-¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶

শুভ প্রয়াণ দিবস। ব্যঙ্গরসিক সাহিত্যস্রষ্টা বনবিহারী মুখোপাধ্যায়।Vol -787.. Dt -5.7.2022. ২০ শা আষাঢ় , ১৪২৯. The blogger in literature e-magazine


বনবিহারী মুখোপাধ্যায়. 


দরদি চিকিৎসক বনবিহারী ৮০ বৎসর বয়সে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুলাই প্রয়াত হন।


                                  বেপরোয়া' নামে তার একটা দল ছিল। দলের অন্যতম সভ্য বিষ্ণুচরণ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে "বেপরোয়া" নামে যে পত্রিকা প্রকাশিত হয় তার বেশির ভাগ লেখাই তিনি লিখতেন। তার গল্প উপন্যাস নাটকের যে ভাবসংঘাত, তা বেশিরভাগই শ্লেষ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে ফুটে উঠলেও তাতে ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল না। সমকালীন সমাজের মধ্য যে অন্ধতার তথা রক্ষণশীলতা ছিল কেবল তার বিরুদ্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনা থাকতো. 


ডাক্তারি পেশায় আসার আগে বনবিহারীর কাছে সংস্কৃত অত্যন্ত প্রিয় বিষয় ছিল এবং সংস্কৃত কবিতা রচনায় পারদর্শী ছিলেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে "কাব্যতীর্থ" উপাধি পান। সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রে সুপরিচিত তিনি ফরাসি সাহিত্যেও অধিকার অর্জন করেছিলেন। এছাড়া নক্ষত্রবিজ্ঞান, পক্ষীতত্ত্ব বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল। 'বঙ্গবাণী', 'শনিবারের চিঠি' প্রভৃতিতে নিয়মিত লিখতেন। ' ' বনবিহারী যেমন ভাল লিখতে পারতেন, তেমন আঁকতেও পারতেন। নিজের রচনা তিনি হাসির ছবি দিয়ে নিজেই সাজাতেন। সেসময় বাংলাদেশে শক্তিশালী কার্টুনিস্ট হিসাবে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে নিজেকে পরিচিত করাতে পেরেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরীরাণী অবলম্বনে 'ঢেলে সাজা' নাম দিয়ে কার্টুনের সহযোগিতায় তার প্যারডি তৎকালে বিশেষ উপভোগ্য হয়েছিল। তার ব্যঙ্গ কবিতা ও কার্টুন 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। তার রচিত উপন্যাস ও গ্রন্থ গুলি হল-

  • উপন্যাস-
    • 'দশচক্র'
    • 'যোগভ্রষ্ট'
  • অন্য গ্রন্থ-
    • 'সিরাজের পেয়ালা'
    • 'নরকের কীট'

বনবিহারী তার বিধবা ভগিনী 'শৈল'র পুনর্বিবাহ দিয়েছিলেন সামাজিক বাধানিষেধ উপেক্ষা করে। ওই বিবাহে তিনিই পৌরহিত্য করেন এবং সেখানে বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী বনবিহারীকে বলতেন - "ইণ্ডিয়ান ভলতেয়ার"। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি ভাগলপুরে বসবাস করতে থাকেন এবং পরামর্শ চিকিৎসকরূপে ডাক্তারি করতেন।

 জন্ম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গরলগাছা গ্রামে। পিতা বিপিন বিহারী মুখোপাধ্যায়। মায়ের নাম অপর্ণা। পরে অবশ্য মুখোপাধ্যায় পরিবার কলকাতার বেহালায় বসবাস করতে থাকেন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় ছিল তার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা। মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা ছিলেন বিদ্যোন্মুখ, প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিবান। মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা কালে বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তথা বনফুল ছিলেন তার ছাত্র। চিকিৎসকের পেশায় বনবিহারীর অসামান্য জনপ্রিয়তা ছিল। অকৃতদার তিনি সাধারণ মানুষের সেবায় সতত নিয়োজিত ছিলেন। অসহায়রা তার যথেষ্ট সহায়তা পেতেন। নিজে সাহিত্য অনুরাগী হিসাবে প্রেরণাও দিতেন ছাত্রদের। বনফুল পরবর্তীকালে মাস্টারমশাইয়ের জীবনী ভিত্তি করে "অগ্নীশ্বর" উপন্যাস রচনা করেছেন। যেটি তারই ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর-সংযোজনায় উত্তমকুমার অভিনীত ছায়াছবিটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময় ।


======{=====[[{{{={{{{{{{{{{{========={{{{


Monday, 4 July 2022

মহা প্রয়াণ দিবস। স্বামী বিবেকানন্দ। Vol -786. Dt- 4th July,2022. ১৯ শা আষাঢ়,১৪২৯ বঙ্গাব্দ।

" ওঁম নমঃ শ্রীযতিরাজায় বিবেকানন্দ সূরয়ে
    সচ্চিদসুখস্বরূপায় স্বামীনে তাপহারিণে।।"


কী হল আমার নরেনের ?
হঠাৎ চলে গেল কেন ?
ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয় ।
আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা ।
আমি কী নিয়ে থাকব নরেন ?
ফিরে আয় । ফিরে আয় ।
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন ।

তারপর তাঁকে তুলে দিলেন নৌকায় ।
জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা ।
মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না ।

ফিরে আয় নরেন ফিরে আয় ।
ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ।
তাঁর কান্না‚ ফিরে আয় নরেন‚ ফিরে আয়‚ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে ।

নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন‚ প্রভুর ওই জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম !

সন্ধে ছটা ।
দাহকার্য সম্পন্ন হল । আর নিবেদিতা অনুভব করলেন‚ কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল । তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন‚ অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে‚ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি‚ সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন । 

নিবেদিতার মনে হল‚ মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে-আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর‚ তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি ।





                 দিনটি ছিল ৪ জুলাই ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ।  বিবেকানন্দ ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, বেলুড় মঠের চ্যাপেলে তিন ঘণ্টা ধরে ধ্যান করেন। এরপর তিনি ছাত্রদের শুক্লা-যজুর্বেদ শেখান, যা একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং যোগ দর্শন। পরে সহকর্মীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠের বৈদিক কলেজে একটি পরিকল্পনার আলোচনা করেন। তিনি ভ্রাতা-শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে হাঁটেন এবং তাকে রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নির্দেশনা দেন। সন্ধ্যা ৭:০০ টায় বিবেকানন্দ তার ঘরে ফেরেন এবং তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেন;এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ৯:১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার শিষ্যদের মতে, বিবেকানন্দের মহাসমাধি ঘটেছিল; আর চিকিৎসকের প্রতিবেদনে বলা হয় এটি হয়েছে তার মস্তিষ্কে একটি রক্তনালী ফেটে যাবার কারণে, কিন্তু তারা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ধার করতে পারেননি।তার শিষ্যদের মতানুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র-মস্তিষ্কের চূড়ার রন্ধ্র-অবশ্যই ফেটে থাকবে যখন তিনি মহাসমাধি অর্জন করেছিলেন। বিবেকানন্দ চল্লিশ বছর জীবৎকাল পূর্ণ করার আগেই তার ভাববাণী সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয়, যার বিপরীত পাশে ষোল বছর আগে রামকৃষ্ণ দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল। 

৪ঠা জুলাই, ১৯০২
========
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিবেকানন্দের । তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে । আজই তো সেই দিন । আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আর আমার দেহত্যাগের দিন। মা ভুবনেশ্বরী দেবীর মুখটি মনে পড়ল তাঁর। ধ্যান করলেন সেই দয়াময় প্রসন্ন মুখটি। বুকের মধ্যে অনুভব করলেন নিবিড় বেদনা ।

তারপর সেই বিচ্ছেদবেদনার সব ছায়া সরে গেল ।
ভারী উৎফুল্ল বোধ করলেন বিবেকানন্দ। মনে নতুন আনন্দ, শরীরে নতুন শক্তি । তিনি অনুভব করলেন, তাঁর সব অসুখ সেরে গিয়েছে । শরীর ঝরঝর করছে । শরীরে আর কোনো কষ্ট নেই।

মন্দিরে গেলেন স্বামীজি । ধ্যানমগ্ন উপাসনায় কাটালেন অনেকক্ষন । আজ সকাল থেকেই তাঁর মনের মধ্যে গুন গুন করছে গান । অসুস্থতার লক্ষন নেই বলেই ফিরে এসেছে গান, সুর, আনন্দ । তাঁর মনে আর কোনও অশান্তি নেই । শান্ত , স্নিগ্ধ হয়ে আছে তাঁর অন্তর। 
উপাসনার পরে গুরুভাইদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন ।

বেলা বাড়ল। সাড়ে আটটা নাগাদ প্রেমানন্দকে ডাকলেন তিনি। বললেন, আমার পুজোর আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে । সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে ।

 বিবেকানন্দ একা হতে চান ।
প্রেমানন্দকে বললেন‚ আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে ।
এখন আমি সেখানে বসেই ধ্যান করব ।

অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন ।
আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন ।চারদিকের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিতে বললেন স্বামীজি ।

বেলা এগারোটা পর্যন্ত ধ্যানে মগ্ন রইলেন স্বামীজি । ধ্যান ভাঙলে ঠাকুরের বিছানা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন তিনি --
মা কি আমার কালো,
কালোরূপা এলোকেশী
হৃদিপদ্ম করে আলো ।
তরুন সন্ন্যাসীর রূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গুরুভাইরা ।

বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই দুপুরের খাওয়া সারতে বললেন বিবেকানন্দ । আজ নিজে একলা খাচ্ছেন না । খেতে বসলেন সবার সঙ্গে ।

সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলেদের নৌকো ভিড়েছিল । নৌকোভর্তি গঙ্গার ইলিশ । স্বামীজির কানে খবর আসতেই তিনি মহাউত্‍সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন । তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে ইলিশের অনেকরকম পদ ।

 গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশভক্ষনে বসলেন বিবেকানন্দ । তিনি জানেন, আর মাত্র কয়েকঘন্টার পথ তাঁকে পেরোতে হবে । ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলার আর প্রয়োজন নেই । জীবনের শেষ দিনটা তো আনন্দেই কাটানো উচিত।

'একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে। ঘটিবাটিগুলোও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ।' বললেন স্বামীজি । 

পেট ভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল. ইলিশ ভাজা ।

দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল, একটু লেখাপড়া করা যাক ।

 বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন‚ লাইব্রেরি থেকে শুক্লযজুর্বেদটি নিয়ে আয় ।
তারপর হঠাৎ বললেন‚ এই বেদের মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না |
আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ শিরাগুচ্ছে‚ ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি রয়েছে‚ তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে । আর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে । মহীধর সেটি ধরতে পারেননি ।
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন ।

এরপর দুপুর একটা থেকে চারটে পর্যন্ত তিনঘন্টা স্বামীজী লাইব্রেরী ঘরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে ।

তিনি পাণিনির ব্যাকরণের সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগলেন ।
ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসির হুল্লোড়ে পরিণত হল ।

ব্যাকরনের ক্লাস শেষ হতেই এক কাপ গরম দুধ খেয়ে প্রেমানন্দকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত প্রায় দু মাইল পথ হাঁটলেন ।
এতটা হাঁটা তাঁর শরীর ইদানিং নিতে পারছে না । 

কিন্তু ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাইয়ের গল্প অন্যরকম । কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না।
বুকে এতটুকু হাঁফ ধরল না । আজ তিনি অক্লেশে হাঁটলেন । 

বিকেল পাঁচটা নাগাদ মঠে ফিরলেন বিবেকানন্দ । সেখানে আমগাছের তলায় একটা বেঞ্চি পাতা । গঙ্গার ধারে মনোরম আড্ডার জায়গা । স্বামীজির শরীর ভাল থাকে না বলে এখানে বসেন না । আজ শরীর -মন একেবারে সুস্থ । তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন বিবেকানন্দ ।
আড্ডা দিতে দিতে ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল । 

সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা হবে । সন্ন্যাসীরা কজন মিলে চা খাচ্ছেন । স্বামীজি এক কাপ চা চাইলেন ।

সন্ধ্যে ঠিক সাতটা। শুরু হলো সন্ধ্যারতি । স্বামীজি জানেন আর দেরি করা চলবে না । শরীরটাকে জীর্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করার পরমলগ্ন এগিয়ে আসছে ।

তিনি বাঙাল ব্রজেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন । ব্রজেন্দ্রকে বললেন , 'আমাকে দুছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর ।

 আমি না ডাকলে আসবি না ।'
স্বামীজি হয়তো বুঝতে পারছেন যে এটাই তাঁর শেষ ধ্যান ।

তখন ঠিক সন্ধ্যে সাতটা পঁয়তাল্লিশ । স্বামীজি যা চেয়েছিলেন তা ঘটিয়ে দিয়েছেন । 
 
ব্রজেন্দ্রকে ডাকলেন তিনি । বললেন , জানলা খুলে দে । গরম লাগছে ।
মেঝেতে বিছানা পাতা । সেখানে শুয়ে পড়লেন স্বামীজি । হাতে তাঁর জপের মালা ।

ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন স্বামীজিকে । স্বামীজি ঘামছেন । বললেন , আর বাতাস করিসনে । একটু পা টিপে দে । 

রাত ন'টা নাগাদ স্বামীজি বাঁপাশে ফিরলেন । তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল । কুন্ডলিনীর শেষ ছোবল । বুঝতে পারলেন বিবেকানন্দ । শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন তিনি ।

 দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । গভীর সেই শ্বাস । মাথাটা নড়ে উঠেই বালিশ থেকে পড়ে গেল ।

 ঠোঁট আর নাকের কোনে রক্তের ফোঁটা । দিব্যজ্যোতিতে উজ্জ্বল তাঁর মুখ । ঠোঁটা হাসি ।
ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন , 'তুই যেদিন নিজেকে চিনতে পারবি সেদিন তোর এই দেহ আর থাকবে না ।'

স্বামীজি বলেছিলেন , 'তাঁর চল্লিশ পেরোবে না ।'

বয়েস ঠিক উনচল্লিশ বছর পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন ।
পরের দিন ভোরবেলা ।
একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত‚ বিভূতি-বিভূষিত‚ বিবেকানন্দ ।

তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট ।
তাঁর পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন ।
তাঁর প্রসারিত ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি ।
তাঁর চোখদুটি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ‚ অর্ধনিমীলিত‚ অন্তর্মুখী‚ অক্ষিতারা ।

নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন ।
স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস করছেন ।
তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা ।

স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে ।
পা-দুখানি পুবে‚ গঙ্গার দিকে ।
শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা‚ ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে । আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে বিশুদ্ধ বেদনা ।
অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন‚ পুড়ছেন তিনি ।
এই বেদনার সমুদ্রে তিনি একা ।

নির্জনবাসিনী নিবেদিতা ।
বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায় ।

সাহিত্য কর্ম : 

জীবদ্দশায় প্রকাশিত
সঙ্গীতকল্পতরু (১৮৮৭, সহলেখক বৈষ্ণবচরণ বসাক)
কর্মযোগ (১৮৮৮)
রাজযোগ (১৮৯৬ [১৮৯৯ সংস্করণ])
বেদান্ত ফিলোজফি: অ্যান অ্যাড্রেস বিফোর দ্য গ্র্যাজুয়েট ফিলোজফিক্যাল সোসাইটি (১৮৯৬; বাংলা অনুবাদে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত)
লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া (১৮৯৭, বাংলা অনুবাদে ভারতে বিবেকানন্দ)
বর্তমান ভারত (মার্চ, ১৮৯৯), উদ্বোধন
মাই মাস্টার (১৯০১, দ্য বেকার অ্যান্ড টাইলর কোম্পানি, নিউ ইয়র্ক; বাংলা অনুবাদে মদীয় আচার্যদেব)
বেদান্ত ফিলোসফি: লেকচার্স অন জ্ঞানযোগ (১৯০২)
মরণোত্তর প্রকাশিত
১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা

ভক্তি-প্রসঙ্গে
ভক্তিযোগ বা সর্বোচ্চ ভক্তি
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (১৯০৯)
দেববাণী (১৯০৯)
নারদ ভক্তিসূত্র – অনুবাদ
পরাভক্তি
প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত
জ্ঞানযোগ
রাজযোগ (১৯২০)
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী সঞ্চয়ন
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (দশ খণ্ড)
কমপ্লিট ওয়ার্কস অব স্বামী বিবেকানন্দ (নয় খণ্ড)

                         স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী বলেছিলেন, "বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম ও ভারতকে রক্ষা করেছিলেন।" বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন "আধুনিক ভারতের স্রষ্টা"। মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন, বিবেকানন্দের রচনা তার "দেশপ্রেম হাজারগুণ" বৃদ্ধি করেছিল। বিবেকানন্দ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীঅরবিন্দ, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বাঘা যতীন প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অলডাস হাক্সলি, ক্রিস্টোফার ইশারউড, রোম্যা রোলাঁ প্রমুখ বুদ্ধিজীবীকে বিবেকানন্দের রচনা অনুপ্রাণিত করেছিল। বিবেকানন্দের মৃত্যুর বহু বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারবিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যা রোলাঁকে লিখেছিলেন, "ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দের লেখা পড়ো। তার মধ্যে সব কিছুই ইতিবাচক। নেতিবাচক কিছুই নেই।" রোম্যা রোলাঁ লিখেছেন, "তার লেখাগুলি মহান সঙ্গীতের মতো এবং পঙ্‌ক্তিগুলি বেটোফেন শৈলীর মতো। চিত্তাকর্ষক ছন্দগুলি হ্যান্ডেল কোরাসের কুচকাওয়াজের মতো। আজ ত্রিশ বছর পরেও তাঁর বাণীগুলিকে স্পর্শ করলে আমার শরীরে বৈদ্যুতিক আঘাতের মতো শিহরণ জাগে। এই মহানায়কের মুখ থেকে যখন এই জ্বলন্ত শব্দগুলি উচ্চারিত হয়েছিল, তখন নিশ্চয় অনেকে এই শিহরণ অনুভব করেছিলেন!"।
                       বিবেকানন্দের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে জামশেদজি টাটা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, যা ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রথম সারির গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়।বিদেশে বিবেকানন্দ প্রাচ্যবিদ ম্যাক্স মুলার ও বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এরা দুজনেই তার বৈদিক শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ভারতে তার জন্মদিন ১২ জানুয়ারি পালিত হয় জাতীয় যুব দিবস (ভারত) হিসেবে। অন্যদিকে, ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে বিবেকানন্দ বিশ্বধর্ম মহাসভায় তার বিখ্যাত 'শিকাগো বক্তৃতা' উপস্থাপন করেছিলেন বলে ১১ সেপ্টেম্বর তারিখটি 'বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব দিবস' হিসেবে পালিত হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের অর্থ মন্ত্রক ভারতের আর্থনৈতিক পরিবেশে বিবেকানন্দের শিক্ষা ও মূল্যবোধের গুরুত্বের উপর আলোকপাত করেন। তদনীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ১০০ কোটি টাকার "স্বামী বিবেকানন্দ ভ্যালু এডুকেশন প্রজেক্ট" অনুমোদন করেন। এই প্রকল্পে যুবসমাজকে প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ রচনা, আলোচনা ও পাঠচক্রে যুক্ত করা এবং বিবেকানন্দের রচনাবলি একাধিক ভাষায় প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০১১ খ্রস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ট্রেনিং কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "স্বামী বিবেকানন্দ রাজ্য পুলিশ আকাদেমি"। ছত্তিসগড়ের রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পালটে রাখা হয়েছে "ছত্তিসগড় স্বামী বিবেকানন্দ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়"।২০১২ সালে রায়পুরের বিমানবন্দরটির নামও পালটে রাখা হয়েছে "স্বামী বিবেকানন্দ বিমানবন্দর। 

১);ওঠো , জাগো এবং লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।”
২)কোনো বড় কাজই কঠোর পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার ছাড়া হয় নি।”
৩)সারাদিন চলার পথে যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হও, তাহলে বুঝবে তুমি ভুল পথে চলেছ।
এমন কাজ করে চলো যে তুমি হাসতে হাসতে ৪)মরবে আর জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে।”

৫. “আমি বিশ্বাস করি যে, কেউ কিছু পাওয়ার উপযুক্ত হলে জগতের কোনো শক্তিই তাকে বঞ্চিত করতে পারে না।”

৬. “যখন আমাদের মধ্যে অহংকার থাকে না, তখনই আমরা সবথেকে ভালো কাজ করতে পারি, অপরকে আমাদের ভাবে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করতে পারি।”

৭. “মনের মতো কাজ পেলে অতি মূর্খও করতে পারে। যে সকল কাজকেই মনের মতো করে নিতে পারে, সেই বুদ্ধিমান। কোনো কাজই ছোট নয়।
যা পারো নিজে করে যাও, কারও ওপর আশা বা ভরসা কোনোটাই কোরো না।”

৮  “সাহসী লোকেরাই বড় বড় কাজ করতে পারে।”

:৯. উঁচুতে উঠতে হলে তোমার ভেতরের অহংকারকে – বাহিরে টেনে বের করে আনো, এবং হালকা হও … কারণ তারাই ওপরে উঠতে পারে যারা হালকা হয়।”
১০. “মস্তিস্ককে উচ্চ মানের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে পূর্ণ করো, দিবারাত্র এগুলোকে তোমার সামনে রেখে চলো, এগুলোর থেকে মহান কাজ বেরিয়ে আসবে।”

১১. “যে রকম বীজ আমরা বুনি, সে রকমই ফসল আমরা পাই। আমরাই আমাদের ভাগ্য তৈরী করি, তার জন্য কাউকে দোষারোপ করার কিছু নেই, কাউকে প্রশংসা করারও কিছু নেই।

১২ সেবা করো তাৎপরতার সাথে। দান করো নির্লিপ্ত ভাবে। ভালোবাসো নিঃস্বার্থভাবে। ব্যয় করো বিবেচনার সাথে। তর্ক করো যুক্তির সাথে। কথা বলো সংক্ষেপে।

১৩. “প্রবিত্র ও নিঃস্বার্থ হতে চেষ্টা কোরো, তার মধ্যেই রয়েছে সমস্ত ধর্ম।”

১৪.  “শুধু বড়ো লোক হয়ো না … বড় মানুষ হও। 
=============∆∆∆∆∆∆∆∆==========




শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ।‌ একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। Dt -26.11.2024. Vol -1059. Tuesday. The blogger post in literary e magazine.

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়   (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ — ২৯ মে ১৯৭৭)  একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ.  মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্...