!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
বাঙালির সংস্কৃতিতে ঝুলন একাদশীর গুরুত্ব।
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
Doinik Sabder Methopath
Vol - 84. Dt - 30.7.2020
" কৃষ্ণ ভুলি যেই জীব অনাদি বহির্মুখ। অতএব মায়া তারে দেয় সংসারদুঃখ।। " শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট রয়েছে। তাই মায়া তাকে এ জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে। পরম করুণাময় ভগবান কৃষ্ণস্মৃতি জাগরিত করতে মায়াগ্রস্ত জীবের কল্যাণে বেদপুরাণ আদি শাস্ত্রগ্রন্থাবলী দান করেছেন। ভক্তি হচ্ছে ভগবানকে জানার ও ভগবৎ প্রীতি সাধনের একমাত্র সহজ উপায়। শাস্ত্রে যে চৌষট্রি প্রকার ভক্ত্যাঙ্গের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একাদশী ব্রত সর্বোত্তম। স্বরূপ : শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ আদি নবধা ভক্তির পরই দশম ভক্ত্যাঙ্গরূপে একাদশীর স্থান। এই তিথিকে হরিবাসর বলা হয়। তাই ভক্তি লাভেচ্ছু সকলেই একাদশী ব্রত পালনের পরম উপযোগীতার কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। একাদশী তিথি সকলের অভীষ্ট প্রদানকারী। এই ব্রত পালনে সমস্ত প্রকার পাপ বিনষ্ট, সর্বসৌভাগ্য ও শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধান হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আট থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত যেকোন ব্যক্তিরই ভক্তিসহকারে পবিত্র একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য পালন : সঙ্কটজনক অবস্থা বা জন্মমৃত্যুর অশৌচে কখনও একাদশী পরিত্যাগ করতে নেই। একাদশীতে শ্রাদ্ধ উপস্থিত হলে সেইদিন না করে দ্বাদশীতে শ্রাদ্ধ করা উচিত। শুধু বৈষ্ণবেরাই নয়, শিবের উপাসক, সূর্য-চন্দ্র-ইন্দ্রাদি যেকোন দেবোপাসক, সকলেরই কর্তব্য একাদশী ব্রত পালন করা। দুর্লভ মানবজীবন লাভ করেও এই ব্রত অনুষ্ঠান না করলে বহু দুঃখে-কষ্টে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করতে হয় । অহংকারবশত একাদশী ব্রত ত্যাগ করলে যমযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। যে ব্যাক্তি এই ব্রতকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, জীবিত হয়েও সে মৃতের সমান। কেউ যদি বলে “একাদশী পালনের দরকারটা কি?” সে নিশ্চয় কুন্তিপাক নরকের যাত্রী। যারা একাদশী পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শনির কোপে তারা বিনষ্ট হয়। একাদশীকে উপেক্ষা করে তীর্থ স্থান আদি অন্য ব্রত পালনকারীর অবস্থা গাছের গোড়া কেটে পাতায় জল দানের মতোই। মাহাত্ম্য : একাদশী কে বাদ দিয়ে যারা দেহধর্মে অধিক আগ্রহ দেখায়, ধর্মের নামে পাপরাশিতে তাদের উদর পূর্ণ হয়। কলহ-বিবাদের কারণেও একাদশী দিনে উপবাস করলে অজ্ঞাত সুকৃতি সঞ্চিত হয়। পুণ্যপ্রদায়িনী সর্বশ্রেষ্ঠ এই ব্রত শ্রীহরির অতি প্রিয়। একাদশী ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয়, অশ্বমেধ, রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞদ্বারাও তা হয় না। দেবরাজ ইন্দ্রও যথাবিধি একাদশী পালনকারীকে সম্মান করেন। একাদশী ব্রতে ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়। অনাহার থেকে হরিনাম, হরিকথা, রাত্রিজাগরণে একাদশী পালন করা কর্তব্য। কেউ যদি একাদশী ব্রতে শুধু উপবাস করে তাতে বহু ফল পাওয়া যায়। শুদ্ধ ভক্তেরা এই দিনে একাদশ ইন্দ্রিয়কে শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করেন। একাদশীতে শস্যমধ্যে সমস্ত পাপ অবস্থান করে। তাই চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সুজি, সরিষা আদি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য একাদশী দিনে বর্জন করা উচিত। নির্জলা উপবাসে অসমর্থ ব্যক্তি জল, দুধ, ফল-মূল, এমনকি আলু, পেপে, কলা, ঘিয়ে বা বাদাম তেল অথবা সূর্যমুখী তেলে রান্না অনুকল্প প্রসাদ রূপে গ্রহণ করতে পারেন। রবিশস্য (ধান, গম, ভুট্রা, ডাল ও সরিষা) ও সোয়াবিন তেল অবশ্যই বর্জনীয়। নিয়মাবলী : ভোরে শয্যা ত্যাগ করে শুচিশুদ্ধ হয়ে শ্রীহরির মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। শ্রীহরির পাদপদ্মে প্রার্থনা করতে হয়, “হে শ্রীকৃষ্ণ, আজ যেন এই মঙ্গলময়ী পবিত্র একাদশী সুন্দরভাবে পালন করতে পারি, আপনি আমাকে কৃপা করুন।” একাদশীতে গায়ে তেল মাখা, সাবান মাখা, পরনিন্দা-পরচর্চা, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, দিবানিদ্রা, সাংসারিক আলাপাদি বর্জনীয়। এই দিন গঙ্গা আদি তীর্থে স্নান করতে হয়। মন্দির মার্জন, শ্রীহরির পূজার্চনা, স্তবস্তুতি, গীতা-ভাগবত পাঠ আলোচনায় বেশি করে সময় অতিবাহিত করতে হয়।এই তিথিতে গোবিন্দের লীলা স্মরণ এবং তাঁর দিব্য নাম শ্রবণ করাই হচ্ছে সর্বোত্তম। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের একাদশীতে পঁশিচ মালা বা যথেষ্ট সময় পেলে আরো বেশি জপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একাদশীর দিন ক্ষৌরকর্মাদি নিষিদ্ধ। একাদশী ব্রত পালনে ধর্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ আদি বহু অনিত্য ফলের উল্লেখ শাস্ত্রে থাকলেও শ্রীহরিভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেম লাভই এই ব্রত পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভক্তগণ শ্রীহরির সন্তোষ বিধানের জন্যই এই ব্রত পালন করেন। পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বৈষ্ণবস্মৃতিরাজ শ্রীহরিভক্তিবিলাস আদি গ্রন্থে এ সকল কথা বর্ণিত আছে। বছরে ছাব্বিশটি একাদশী আসে। সাধারণত বার মাসে চব্বিশটি একাদশী। এইগুলি হচ্ছে- ১. উৎপন্না একাদশী - ২. মোক্ষদা একাদশী ৩. সফলা একাদশী , - ৪. পুত্রদা একাদশী ৫. ষটতিলা একাদশী - ৬. জয় একাদশী ৭. বিজয়া একাদশী - ৮. আমলকী একাদশী ৯. পাপমোচনী একাদশী - ১০. কামদা একাদশী ১১. বরুথিনী একাদশী - ১২. মোহিনী একাদশী ১৩. অপরা একাদশী - ১৪. নির্জলা একাদশী ১৫. যোগিনী একাদশী - ১৬. শয়ন একাদশী ১৭. কামিকা একাদশী - ১৮. পবিত্রা একাদশী১৯. অন্নদা একাদশী - ২০. পরিবর্তিনী বা পার্শ্ব একাদশী ২১. ইন্দিরা একাদশী - ২২. পাশাঙ্কুশা একাদশী ২৩. রমা একাদশী - ২৪. উত্থান একাদশী কিন্তু যে বৎসর পুরুষোত্তমাস, অধিমাস বা মলমাস থাকে, সেই বৎসর পদ্মিনী ও পরমা নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়। যারা যথাবিধি একাদশী উপবাসে অসমর্থ অথবা ব্রতদিনে সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণে অসমর্থ, তারা এই একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করলে অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন।
একাদশীর আবির্ভাব
পদ্মপুরাণে একাদশী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। একসময় জৈমিনি ঋষি তাঁর গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে গুরুদেব! একাদশী কি? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? একাদশী ব্রত করলে কি লাভ? একাদশী ব্রত না করলে কি ক্ষতি? এ সব বিষয়ে আপদ তখন বলতে লাগলেন-সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করলেন। মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হল। পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ-গুরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা-স্ত্রীহত্যা, দুই বাহু-গোহত্যা পাপ, গ্রীবা-ধন অপহরণ, গলদেশ-ভ্রুণহত্যা, বক্ষ-পরস্ত্রী-গমন,উদর-আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি-শরণাগত বধ, কোমর-আত্মশ্লাঘা, দুই উরু-গুরুনিন্দা, শিশ্ন-কন্যা বিক্রি, মলদ্বার-গুপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা-পিতৃহত্যা, শরীরের রোম-সমস্ত উপপাতক।এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হল। পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্ত্যের মানব জাতির দুঃখমোচন করবার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন গরুড়ের পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের মন্দিরে। ভগবানকে যমরাজ উপযুক্ত স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন। যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি। প্রশ্ন করলেন-এ আর্তক্রন্দন কেন? যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্ত্যের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযাতনা ভোগ করছে। সেই যাতনার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন-আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্মদোষে দুষ্ট হয়ে নরক যাতনা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদগতির ব্যবস্থা করব। ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথি রূপে এক দেবীমুর্তিতে প্রকাশিত হলেন। সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুন্ঠ ধামে গমন করল।
শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ট এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত। কিছুদিন পরে ভগবানের সৃষ্ট পাপপুরুষ এসে শ্রীহরির কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থনা জানাতে লাগল-হে ভগবান! আমি আপনার প্রজা! আমাকে যারা আশ্রয় করে থাকে, তাদের কর্ম অনুযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি। কেননা একাদশী ব্রতের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকুন্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে।
হে ভগবান, এখন আমার কি হবে? আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব? সবাই যদি বৈকুন্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কি হবে? আপনি বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে ক্রীড়া করবেন? পাপপুরুষ প্রার্থনা করতে লাগল- হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে ক্রীড়া করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দুর করুন। একাদশী তিথির ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন, আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি। মানুষ, পশুপাখী, কীট-পতঙ্গ, জল-স্থল, বন-প্রান্তর, পর্বত-সমুদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয় স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
ভগবান, এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত ককোটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় পেতে পারছি না। আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্থান প্রদান করুন। পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীহরি বলতে লাগলেন- হে পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করো না। যখন একাদশী তিথি এই ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে আবির্ভুত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্য মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। তা হলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না।
এইভাবে জগৎ-সংসারে একাদশী ব্রত পালন হয়ে আসছে। একাদশীর মধ্যে ঝুলন একাদশী গুরুত্ব বাঙালির জীবনে ও সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভক্তি ভাবনার সঞ্চার ঘটিয়েছে। তাই বৈষ্ণব ধর্ম অবলম্বী ভক্তদের অন্যতম অ্যাক্টিভ একাদশী। বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাবিত মানুষজনের বাড়িতে বাড়িতে তুলসী মঞ্চে একাদশী তিথিতে পূজা অর্চনা হরিনাম সংকীর্তন বাতাশা হরিলুট সহ জানান বিষয় ভক্তদের মনে পুণ্য অর্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ জীবনে প্রতিপালিত এই নিয়ম নীতি ভাত সামাজিক রীতিনীতির অন্যতম ধারক বাহক। সমাজে যারা বিধবা তাদের এই একাদশী নির্জলা পুণ্যব্রত। সাহিত্যে সংস্কৃতিতে এর উল্লেখ আমরা প্রত্যক্ষ করি। "সোনার তরী" কাব্যগ্রন্থে ঝুলন কবিতা রবীন্দ্রনাথ সেই পূর্ণ্যব্রত একাদশীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। ঝুলন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা নিশীথ বেলা!
সঘন বরষা গগন আঁধার
হের বারিধারে কাঁদে চারিধার,
ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে
ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন শয়ন
করিয়া হেলা,
রাত্রি বেলা!
ওগাে পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কি কল্লোল!
দে দোল্ দোল্!
পশ্চাৎ হতে হাহা করে’ হাসি’
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি’
যেন এ লক্ষ বক শিশুর
অট্ট রোল!
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্ট গােল!
দে দোল্ দোল্!
আজি জাগিয়া উঠিয়া পরাণ আমার
বসিয়া আছে
বুকের কাছে।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
ধরিছে আমার বক্ষঃ চাপিয়া,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে
হৃদয় নাচে,
ত্রাসে উল্লাসে পরাণ আমার
ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে!
হায়, এতকাল আমি রেখেছিনু তারে
যতন ভরে
শয়ন পরে।
ব্যথা পাছে লাগে, দুখ পাছে জাগে
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসর-শয়ন করেছি রচন
কুসুম থরে,
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে
গােপন ঘরে,
যতন ভরে।
কত সােহাগ করেছি চুম্বন করি
নয়ন পাতে
স্নেহের সাথে।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয় নাম মৃদু মধুভাষে,
গুঞ্জর তান করিয়াছি গান
জ্যোৎস্না রাতে,
যা কিছু মধুর দিয়েছিনু তার
দুখানি হাতে
মেহের সাথে!
শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরাণ
আলস রসে,
আবেশ বশে।
পরশ করিলে জাগে না সে আর
কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার
নিশি দিবসে;
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ
মরমে, পশে
আবেশ বশে।
ঢালি’ মধুরে মধুর বধূরে আমার
হারাই বুঝি,
পাইনে খুঁজি!
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে,
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম
হয়েছে পুঁজি!
অতল স্বপ্ন-সাগরে ডুবিয়া
মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি!
তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে
নূতন খেলা
রাত্রি বেলা!
মরণ দোলায় ধরি রসিগাছি
বসিব দুজনে বড় কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া
মারিবে ঠেলা,
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে
ঝুলন খেলা,
নিশীথ বেলা!
দে দোল্ দোল্!
দে দোল্ দোল্!
এ মহাসাগরে তুফান তােল্!
বধূরে আমার পেয়েছি আবার
ভরেছে কোল!
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয় রোল!
বক্ষ শােণিতে উঠেছে আবার
কি হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার
কি কল্লোল!
উড়ে কুন্তল উড়ে অঞ্চল,
উড়ে বনমালা বায়ু চঞ্চল,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী
মত্ত বােল!
দে দোল্ দোল্!
আয় রে ঝঞ্ঝা, পরাণ বধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন
বসন খােল্!
দে দোল্ দোল্!
প্রাণেতে আমাতে মুখােমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয় লাজ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে
ভাবে বিভোল!
দে দোল্ দোল্!
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ
দুটো পাগােল!
দে দোল্ দোল্!
(সোনার তরী । ১৫ চৈত্র, ১২৯৯।)
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
====≠==========!!!!!!!!!!!!!!!============
No comments:
Post a Comment