Monday, 31 August 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
          বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন
              (বিশেষ আলোচনা সংখ্যা)
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
            Doinik sabder methopath
              Vol - 116. Dt - 01.9.2020
               ১৫ ভাদ্র, ১৪২৭. মঙ্গলবার
============!!!!!!!!!!!!!!!!!!!===========


হাংরি আন্দোলনের ইশতাহার বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে ভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেয়া তাঁদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি । আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ।



আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি

মলয় রায়চৌধুরী হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে , অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তিনি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন । তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । সেকারণে মলয় রায়চৌধুরীকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে মনে করা হয় । হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স।তাঁরা বললেন, “ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত ।” তঁরা বললেন, “এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠিও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্তবাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক ননগদনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষ্মণিয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।



আন্দোলনের প্রসার

১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল করঞ্জাই এবং করুণনিধান মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রকর । সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়, রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত, সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।

মুখপত্র


হাংরি আন্দোলনের লেখকগণ। ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে: শৈলেশ্বর ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ বাসুদেব দাশগুপ্ত, ডেভিড গার্সিয়া এবং সুবিমল বসাক।
হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন । যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল । কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন । এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন । বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন । হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা । কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা এতি হাসিক ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কেন না অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সংগ্রাহকদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি । কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র বহু চেষ্টায় গোটা দশেক সংগ্রহ করতে পেরেছেন । ঢাকা বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সঙগ্রহ করতে পেরেছেন । ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন । সেগুলো হল, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃ সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত এষণা, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি দি ওয়েস্ট পেপার । পত্রিকাগুলোর প্রতিটি সংখ্যা সংরক্ষণের প্রয়াস করার প্রয়োকন, মনে হয়, তাঁরা করেননি । কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি মাত্র কয়েকটি সংখ্যা সংগ্রহ করতে পেরেছে । বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় থাকাকালীন ইংরেজি বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করে স্ট্যনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন বলে বিদেশী গবেষকদের সৌজন্যে এগুলোর অবস্হান জানা যায় । সত্তর দশকের শেষাশেষি আন্দোলনটিকে পুনরায় জীবিত করার যখন অসফল প্রবাস করা হয়েছিল, তখন অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন জিরাফ, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন কনসেনত্রশান ক্যাম্প, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন আর্তনাদ, এবং অন্যান্যরা ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবট, ধৃতরাষ্ত্র ইত্যাদি ।

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা

সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষার্ধে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয় । বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন । এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যাব, সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । শ্মশান, গোরস্তান,ভাটিখানা,আওড়া ও শেয়ালদা স্টেশনে তাঁরা কবিতা পাঠের আয়োজন করতেন;’মুখোশ খুলে ফেলুন লেখা জীব-জন্তু, দেবতা, দানবের মুখোশ পাঠাতেন মন্ত্রী, সমালোচক, প্রশাসকদের; কবিদের সমালোচনা করতেন বিবাহের কার্ডে; তৎকালীন মানদণ্ডে অশ্লীল স্কেচ ও পোস্টার আঁকতেন ও বিলি করতেন; একটি গ্রন্হের দাম রাখতেন লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি.বি. সিল ।বাণিজ্যিক পত্রিকায় গ্রন্হ রিভিউ করার জন্য জুতোর বাক্স পাঠাতেন কিংবা শাদা কাগজ পাঠাতেন ছোটগল্প নামে । তাঁদের রচনায় প্রশাসন ও মিডিয়াকে আক্রমণ করতেন ।বেনারস এবং কাঠমান্ডু গিয়ে সাহিত্য সম্পর্কহীন হিপিনীদের সঙ্গে মাদকসেবন এবং যৌন যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়ে সেখানকার সংবাদপত্রে শিরোনাম হতেন । পেইনটিং প্রদর্শনী করে শেষ দিন প্রতিটি ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিতেন । এই সমস্ত অসাহিত্যিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তাঁরা দাবী করতেন যে অচলায়তনকে ভাঙা যাবে । অবশ্য তাঁদের অনুকরণে পরবর্তীকালে বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এসেছেন বাংলা সাহিত্যে, যদিও সাহিত্যের বাইরে তাঁরা অন্য কাজ করেননি। কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের কার্যকলাপে প্রশাসন অচিরে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হল ।

হাংরি আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ

১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ান পিনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবেছিল । তাঁরা হলেন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় , সুভাষ ঘোষ , শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক । এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেপতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয় । মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হব চোর-ডাকাতদের সঙ্গে । মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান । অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করেন । লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপতর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারাল । ১২০বি ধারাটি ছিল ষড়যন্ত্রের, এবং সেকারনে প্রত্যেক হাংরি আন্দোলনকারী সম্পর্কে ডোসিয়ার খুলে ফেলেছিলেন কলকাতা গোয়েন্দা বি্ভাগ । গ্রেপতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল । বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পান্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি ।

হাংরি মোকদ্দমা

হারি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত । ১২০বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে নিয়ে কেবল ২৯২ ধারায় চার্যশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয় । মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । তাঁদের সাক্ষ্যের কারণে নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান । কিন্তু মোকদ্দমাটির কারণে হাংরি আন্দোলনকারীদের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সুবিমল বসাকের হিন্দি ভাষায় দখল থাকায় ভারতের অন্যান্য ভাষার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় তাঁদের রচনা ও কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। হাংরি আন্দোলনকারীরা তা-ই চাইছিলেন। পশ্চিম বাংলার ট্যাবলয়েডগুলোতে তাঁদের নিয়ে রসালো সংবাদ, এমনকি জনতা (৯.১০.৬৪), দৈনিক যুগান্তর(৭.৮.১৯৬৪ সুফী), আনন্দবাজার( ৮.৯.৬৪ চন্ডী লাহিড়ী) ও স্টেটসম্যান (২০.১২.৬৪ রবি) পত্রিকায় দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল । দৈনিক যুগান্তর-ই তিন দিন প্রধান সম্পাদকীয় (১৯.৭.৬৪, ৭.৯.৬৪, ১৫.৪.৬৫) লিখেছিল ; লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর। আমেরিকার টাইম পত্রিকায় ( নভেমবর ১৯৬৪) তাঁদের ফোটো এবং সংবাদ প্রকাশিত হবার ফলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার পত্রপত্রিকা তাঁদের সংবাদ ও রচনা প্রকাশ করার জন্য কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠায় । ভারতবর্ষে তাঁরা সমর্থন পেয়ে যান প্রতিষ্ঠিত লেখকদের। সাময়িক দুর্ভোগ হলেও হাংরি মকদ্দমা তাঁদের সাপে বর হয় । অনিল করনজাই ললিতকলা একাডেমীর পুরস্কার পান। অমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবিলেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে আকল্পনীয়। কলকাতায় এই ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: “ইহা কি বেহুদা পাগলামি?” (দর্পণ, ১.৫.৬৪), “দেবদূতেরা কি ভয়ংকর” চতুষ্পর্ণা (পৌষ, ১৩৭০), “সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?” (অমৃত, শ্রাবণ ৮, ১৩৭১), “হা-ঘরে সম্প্রদায়” (১.১০.৬৪), “কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা” (জনতা, ৪.৯.৬৪), “পুলিশি বেটন কি শিল্প বিচার করবে?” (দর্পণ, ২৭.১১.৬৪), “Erotic Lives & Loves of Hungry Generation” (Blitz, 19.9.64), “Middlebrows Thrive on New Kind of Writing” (The Statesman, 30.12.64), ” Not By Poetry Alone” (NOW, 20.11.64)।

হাংরি আন্দোলনের অবদান

হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে । অতএব যে কয়েকটি ক্ষেত্রে গবেষকরা একমত সেগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে ।

(১). পত্রিকার নামকরণ : হাংরি আন্দোলনের পূর্বে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, পূর্বাশা, অরণি কৃত্তিবাস, অগ্রণি, শতভিষা,উত্তরসূরী, ধ্রুপদী, সংবেদ, ক্রান্তি, চতুরঙ্গ ইত্যাদি । হাংরি আন্দোলনকারীরা যে-ধরণের নাম রাখার চল করলেন তা বৈপ্লবিক । ফলে তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপুল পরিবর্তন ঘটল । যেমন, কৌরব, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, ঢ়পের কাগজ, আমি আর লীনা হঁটে চলেছি, ক্ষেপচুরিয়াস, দিল্লী হাটার্স ইত্যাদি । (২) সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গ থেকে সাহিত্যক্ষেত্রে আগমন, যা কবিতা, কৃত্তিবাস, শতভিষা, ধ্রুপদী ইত্যাদি পত্রিকায় দৃষ্টিকটুভাবে অনুপস্হিত থাকতো । হাংরি আন্দোলন প্রথম যৌথভাবে প্রন্তিকের ডিসকোর্সকে স্হান করে দিল । (৩). পাঠবস্তুতে মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির প্রচলন ,বিশেষ করে প্রদীপ চৌধুরী, ফালগুনী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা-বিশেষ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায়, স্তবক ও পঙক্তি উপর-নিচ রদবদল করে পড়া যায় । একই প্রক্রিয়া গদ্যে এনেছেন সুভাষ ঘোষ, সমীর রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায় ও সুবিমল বসাক । (৪). মনস্হিতি প্রকাশকালীন অব্যয় শব্দ কবিতায় প্রয়োগ; যেমন ওঃ, আঃ, আহ, আআআআআআআহ‌,, উঃ, শ্যাঃ, ফুঃ, হাহ ইত্যাদি, বিশেষ করে মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী ও ফালগুনী রায়- এর কবিতায় । (৫). পাঠবস্তুতে অনুক্রমহীনতা প্রয়োগ : বাক্যবুননে লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তিফাটল প্রয়োগ যা দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখের কবিতার বৈশিষ্ট্য । সত্তর দশকের পর পশ্চিম বাংলায় এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে । (৬). গুরুচণ্ডালী শব্দগঠন ও বাক্য প্রয়োগ যা হাংরি আন্দোলনকারীদের পূর্বে নিষিদ্ধ ছিল বর্তমানে আকছার হয়ে গেছে । (৭). ভঙ্গুর বাকপ্রতিমা প্রয়োগ । হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতায় একটি ছবি সম্পূর্ণ গড়ে ওঠার আগেই তা মিলিয়ে গিয়ে আরেকটি ছবি ভেসে ওঠে । বাংলা কবিতায় এটি এখন প্রতিষ্ঠিত শৈলী । (৮). যৌন চিত্রকল্প, অশ্লীল শব্দ, গালমন্দ, নিচুতলার অভিব্যক্তি যা পাঁচের দশক পর্যন্ত পাঠবস্তুতে নিষিদ্ধ ছিল তার যথেচ্ছ প্রয়োগের সূত্রপাত করে গেছেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । (৯). তাঁদের পাঠবস্তুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিস্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন যে সেগুলো “সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক” । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর” করেছেন তাঁরা, এবং “যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যান” । আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি. দে মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন বিষয়ে ৩৫০ পৃষ্ঠার গবেষণার জন্য পিএচ.ডি. সন্মান দ্বারা ভূষিত হয়েছেন ।

সিনেমায় হাংরি আন্দোলন

বাইশে শ্রাবণ ফিল্মটির পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় । এই ছবিতে গৌতম ঘোষ (সনামধন্য চিত্রপরিচালক) একজন হাংরি আন্দোলনকারী কবির অনবদ্য আভিনয় করেছেন। মেইন স্ট্রিম বাংলা ফিল্মে ইতোপূর্বে হাংরি আন্দোলন নিয়ে কোনও কাজ হয়নি। ২০১১ বর্ষে হাংরি আন্দোলনের ৫০ বছর উপলক্ষে এই ফিল্মটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

কয়েকটি বহুচর্চিত ইশতাহার

‘কবিতা সম্পর্কিত প্রথম ইংরেজি ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১)’ ।
Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger.

Poetry is an activity of the narcissistic spirit. Naturally, we have discarded the blankety-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not resurrect itself in an orgasmic flow, but words come up bubbling in an artificial muddle. In the prosed-rhyme of those born-old half-literates, you must fail to find that scream of desperation of a thing wanting to be man, the man wanting to be spirit.

Poetry of the younger generation too has died in the dressing room, as most of the younger prosed-rhyme writers, afraid of the satanism, the vomitous horror, the self-elected crucifixion of the artist that makes a man a poet, fled away to hide in the hairs.

Poetry from Achintya to Ananda and from Alokeranjan to Indraneel, has been cryptic, short-hand, cautiously glamourous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.

‘ কবিতা বিষয়ক প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১)’ ।
কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয় , অতিপ্রজ অন্ধবল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনো অর্থ বের প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানবিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা, কারণ কবিতা ব্যতীত কী আছে আর জীবনে । মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয় ।

কবিতা থাকা সত্ত্বেও, অসহ্য মানবজীবনের সমস্তপ্রকার অসম্বদ্ধতা । অন্তর জগতের নিষ্ঠুর বিদ্রোহে, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তিতে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হয় কবিতা । উঃ, তবধ মানবজীবন কেনএমন নিষ্প্রভ । হয়তো, কবিতা এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁদের অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এই সঙ্কটের নিয়ন্ত্রক ।

কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মৌহমুক্তির প্রতি ভয়ংকর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খঙাচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । এমনকি প্রত্যাখ্যাত পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের পথরূপেও কবিতার ব্যবহার এখন হাস্যকর । ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পুর্ণরূপে আরণ্যকতারবর্বরতার মথ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধতার মথ্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তরজগতের গুপ্তধন । কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায় ।

ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নূ বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে ‘সচেতনভাবে বিহ্বল’ হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তূ কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্ষে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তিরশক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতৌ অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে ।

মুক্তি বিষয়ক ১৪-বিন্দু ইশতাহার (১৯৬২)
১.আমার সম্পুর্ণ অহং-এর খাঁটি আবিষ্কার । ২. কবিতা চলাকালীন আমাকে এবং আমার সমস্ত কিছুকে যতরকমভাবে পারা যায় উপস্হিত করা । ৩. কবিতায় আমাকেঠিক সেই মুহূর্তে আটক করে ফাঁস করা যখন আমি কোনো না কোনো কারণে ফেটে পড়েছি, আর আমার ভেতর দিকতা বেরিয়ে পড়েছে । ৪. নিজস্ব অহং দিয়ে প্রতিটি মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ, তারপর স্বিকার আধবা প্রত্যাখ্যান । ৫. সমস্তকিছুকে বস্তু মনে করে আরম্ভ, এবং প্রত্যেকটিকে নাড়িয়ে দেখে নেওয়া যে তা প্রাণবন্ত কি না । ৬. সামনে এসে পড়া ব্যাপারকে হুবহু গ্রহণ না করে তার প্রত্যেকটি দীক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা । ৭. পদ্যছন্দ ও গদ্যছন্দ উভয়েরই অবলুপ্তি ঘটিয়ে একটা সহজসরল নিজস্ব শৈলীর ব্যবহার যা ধাঁ করে ঢুকে যাবে যাকে জানানো হচ্ছে তার মেজাজে । ৮. কথা বলার সময়ে যে ধরণ, মাপ আর ওজনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, কবিতাতেও অবিকল তাই । ৯. কথা বলার সময়ে শব্দের ভেতরে যে ধ্রণের ধ্বনি পুরে দেয়া হয়, কবিতাকে সেই ধ্বনিতে আরও চাঁচাছোলা করে উদঘাটন করা । ১০. পাশাপাশি দুটি শব্দের এতাবতকালের আঁতাত ধাক্কা দিয়ে ভেঙে দেয়া এবং তদ্বারা অসবর্ণ ও অবৈধ শব্দ এবং বাক্য তৈরি । ১১. কবিতায় আজ পর্যন্ত ব্যবহৃত সমস্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান, আর বাইরের কোনো রকম ঘুষ না নিয়ে কবিতাকে নিজেই মৌলিক হতে দেয়া । ১২. কবিতাই মানুষের সর্বশেষ ধর্ম, সে ব্যপারটা খোলাখুলি স্বীকার করা । ১৩. তীরের মতো বয়ানে অতিষ্ঠ অস্তিত্ব, বিবমিষা, বিরাগ আগাগোড়া তীব্রভাবে জানানো । ১৪. অন্তিম প্রাতিস্বিকতা ।

‘রাজনীতি বিষয়ক ইশতাহার (১৯৬৩)’
১.প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের আত্মাকে রাজনীতিমুক্ত করা হবে । 
২. প্রাতিস্বিক মানুষকে বোঝানো হবে যে অস্তিত্ব প্রাক-রাজনৈতিক । 
৩. ইতিহাস দিয়ে বোঝানো হবে যে, রাজনীতি আহ্বান করে আঁস্তাকুড়ের মানুষকে, তার সেবার জন্যে টানে নান্দনিক ফালতুদের । 
৪. এটা খোলসা করে দেয়া হবে যে গান্ধীর মৃত্যুর পর এলিট ও রাজনীতিকের মধ্যে তুলনা অসম্ভব । ৫. এই মতামত ঘোষণা করা হবে যে রাজনৈতিক তত্ব নামের সমস্ত বিদগ্ধ বলাৎকর্ম আসলে জঘন্য দায়িত্বহিনতা থেকে চাগিয়ে ওঠা মারাত্মক এবং মোহিনী জোচ্চুরি । 
৬. বেশভার মৃতদেহ এবং গর্দভের লেজের মাঝামাঝি কোথাও সেই স্হানটা দেখিয়ে দেয়া হবে যেটা বর্তমান সমাজে একজন রাজনীতিকের ।
 ৭. কখনও একজন রাজনীতিককে শ্রদ্ধা করা হবে না তা সে যেকোনো প্রজাতি বা অবয়বী হোক না কেন । 
৮. কখনো রাজনীতি ধেকে পালানো হবে না এবং সেই সঙ্গে আমাদের কান্তি-অস্তিত্ব থেকে পালাতে দেয়া হবে না রাজনীতিকে ।
 ৯. রাজনৈতিক বিশ্বাশের চেহারা পালটে দেওয়া হবে ।

বিখ্যাত কয়েকটি হাংরিয়ালিস্ট কবিতা (১৯৬১-১৯৬৫)

উৎপলকুমার বসু রচিত পোপের সমাধি
মলয় রায়চৌধুরী রচিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’
শক্তি চট্টোপাধ্যায় রচিত সীমান্ত প্রস্তাব: মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আবেদন
বিনয় মজুমদার রচিত একটি উজ্জ্বল মাছ
ত্রিদিব মিত্র রচিত হত্যাকাণ্ড
সমীর রায়চৌধুরী রচিত হনির জন্মদিন
ফালগুনী রায় রচিত মানুষের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই
সুবোধ আচার্য রচিত মড়ক
প্রদীপ চৌধুরী রচিত চৌষট্টি ভুতের খেয়া
শেলেশ্বর ঘোষ রচিত ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা
শম্ভু রক্ষিত রচিত আমি স্বেচ্ছাচারী
দেবী রায় রচিত উন্মাদ শহর
সুবিমল বসাক রচিত হাবিজাবি
করুণানিধান মুখোপাধ্যায় রচিত ক্ষুৎকাতর সানপাকু
আলো মিত্র রচিত মাতাল অনুভব ।
বিকাশ সরকার রচিত ভৎর্সনার পাণ্ডুলিপি
অরণি বসু রচিত ভূমিকা
রাজা সরকার রচিত কিছু কালো ফুল ও তার ক্ষত
জীবতোষ দাশ রচিত সুন্দর ভোর
অরুণ বণিক রচিত শারীরিক অভিযান
অরুণেশ ঘোষ রচিত একরাত্রির আকাশ
নির্মল হালদার রচিত হারয়ে যাওয়া
অবনী ধর রচিত ওয়ান শট।

কয়েকটি বিখ্যাত হাংরিয়ালিস্ট গদ্য -(১৯৬১-১৯৬৫)

সুবিমল বসাক রচিত ছাতামাথা
সমীর রায়চৌধুরী রচিত স্মৃতির হুলিয়া ও প্রতুলের মা ওমলেট অবধি
ফালগুনী রায় রচিত কাঠের ফুল
বাসুদেব দাশগুপ্ত রচিত বমনরহস্য
সুভাষ ঘোষ রচিত আমার চাবি
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় রচিত বিজনের রক্তমাংস ।

আরো পড়ুন -

The Searchlight, dated 11.6.1967.(Supplement on Hungry Generation), edited by Subhas Chandra Sarkar. Patna.
বনতুলসী কা গন্ধ । ফণিশ্বরনাথ রেণু । রাজকমল প্রকাশন, নেতাজী সুভাষ রোড, দিল্লি । (১৯৮৮) ।

Salted Feathers Hungryalist Issue edited by Dick Bakken and Lee Altman. 3206 N.E., 12th, Portland, Oregon, USA. (1967).

Intrepid Hungry Generation Issue edited by Allan De Loach. Intrepid Press, 297 Oakmont Ave, NY, USA. (1968).

City Lights Journal edited by Lawrence Ferlinghetti. City Lights, Columbus Ave, SF, USA (1963).

City Lights Journal edited by Lawrence Ferlinghetti. City Lights. Columbus Ave. SF. USA (1966).

Klactoveedsedsteen Hungryalist Issue edited by Carl Weissner. Heidelberg, Germany. (1966).

নন্দনতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাধ ও রবিন্দ্রনাথের নান্দনিক ঐতিহ্যের চক্রবৃদ্ধি । ড. বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলা বিভাগীয় প্রধান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । বাংলা আকাদেমি পত্রিকা, কলকাতা । (১৯৯৭) ।
সম্পাদকীয় । শিবনারায়ণ রায় । জিজ্ঞাসা পত্রিকা । রেনেসঁস পাবলিশার্স । কলকাতা । (কার্তিক-পৌষ, ১৯৯১ ) ।

Hungry Generation by Nissim Ezekiel. Indian P.E.N., Marine Lines, Mumbai. (1987) .

একালের গদ্যপদ্য আন্দোলনের দলিল । সত্য গুহ । অধুনা পাবলিশার্স, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা । (১৩৭৫) ।

যুবযন্ত্রণা ও সাহিত্য । ড. অলোকরজ্ঞন দাশগুপ্ত । শারদীয় বসুমতী, বসুমতী পাবলিশার্স । বৌবাজার, কলকাতা । (১৯৬৮) ।

হাওয়া ৪৯” হাংরি আন্দোলন সংখ্যা । সমীর রায়ছোধুরী সম্পাদিত । হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, বাঁশদ্রোনী, কলকাতা ৭০০০৭০ । (মাঘ, ১৪১২) ।
হাংরি আন্দোলনের ইশতাহার । এবাদুল হক সম্পাদিত । আবার এসেছি ফিরে প্রকাশনী, ভগবানগোলা, মুর্শিদাবাদ । (১৪১৪) ।

হাংরি সাক্ষাতকারমালা । অজিত রায় সম্পাদিত । মহাদিগন্ত প্রকাশনী, কলকাতা ৭০০১৪৪ । (১৯৯৯) ।
মিলন হাংরি আন্দোলন সংখ্যা । বিশ্বজিৎ নন্দী সম্পাদিত । মিলন প্রকাশনী, ধুরা, মেঘালয় ৭৯৪০০১ । (২০০৭)

বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ । জ্যোতির্ময় দত্ত লিখিত । দেশ সাহিত্য সংখ্যা । কলকাতা । (১৩৭৫) ।
সুহৃদ পরিষদ ও বঙ্গ সাহিত্য বক্তৃতা । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । মেদিনীপুর । (১৩৭১) ।

কামুর দর্শন ও হাংরি জেনারেশন । ড. সোমা বীরা লিখিত । অণিমা পত্রিকা । বড়বাজার, কলকাতা । (১৯৬৫) ।

কবিতার নববর্ষ । মোহিত চট্টোপাথভায় লিখিত । সত্ত্বর পত্রিকা । কলকাতা । (১৩৭৫) ।

হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন । ড.উত্তম দাশ প্রণীত । মহাদিগন্ত প্রকাশনী, কলকাতা ৭০০১৪৪ । (১৯৮৬) ।

ক্ষুধিত প্রজন্ম ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ড.উত্তম দাশ প্রণীত । মহাদিগন্ত প্রকাশনী । কলকাতা ৭০০১৪৪ । (১৯৯৫)

উত্তরপ্রবাসী (হাংরি জেনারেশন বিশেয সংখ্যা ) । গজেন্দ্রকুমার ঘোয সম্পাদিত । সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ । বক্স ২০৬১, এস ৪৪৫-০২. সুরটে ২, সুইডেন ।

হাংরি আন্দোলন ও দ্রোহপুরুষ-কথা । ড. বিষ্ণুচন্দ্র দে । সহযাত্রী, ৮ পটুয়াটোলা লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯ ( ২০১৩ )

চন্দ্রগ্রহণ বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা । প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত । ৭ বরদাকান্ত রোড, কলকাতা ৭০০ ০৩০ ( অকটোবর ২০১৪ )


################################


Sunday, 30 August 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                       সংগ্রহযোগ্য বই 
                                 এবং
                            আলোচনা
==========!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!============
                   Doinik Sabder Methopath
                     Vol - 116. Dt - 31.8.20
                  ১৪ ভাদ্র, ১৪২৭. সোমবার
############@@@@@@@@########

লো ল্যান্ড (নাবাল জমি) - ঝুম্পা লাহিড়ী ।বাংলা অনুবাদ - পৌলোমী সেনগুপ্ত।

Saturday, 29 August 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥
                    অনু গল্প সংখ্যা
                          পর্ব -৩
*************!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!**************
              Doinik Sabder Methopath
               Vol -115. Dt - 30.8.2020
                 ১৩ ভাদ্র, ১৪২৭. রবিবার
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

 ঈশ্বর   
 জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 

-- বিদ্যাসাগর কে মা ?  জেঠুরা নাম করছে? -- প্রশ্ন সন্টুর।
অবাক চোখে তাকিয়ে মায়ের উত্তর, উনি ঠাকুরের মতো,খুব ভালো মানুষ। 
একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত না কুলুঙ্গি থেকে মলিন বর্ণপরিচয়টা এনে ছেলের হাতে দেন।
-- মা এই বইটা তুমি সন্ধেবেলা পড়ো না! 
-- হ্যাঁ বাবা।আমি এর থেকে পড়া শিখি,তুমিও শিখবে।
ছবিটা দেখে সন্টু জিজ্ঞেস করে,এটা কার ছবি? 
-- ইনি বিদ্যাসাগর।এই বইটি ইনিই লিখেছেন। -- বলে মা ভক্তিভরে ছবিটি নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ছেলের মাথায় ঠেকান।
ছেলে ভক্তিতে চোখ বন্ধ করে বলে,ঠাকুর ঠাকুর,আমাদের ভালো করো।
-----------------/------------
সামাজিক 
সুব্রত ঘোষ -দিল্লি 


মেছোপুকুর বুজিয়ে প্রোমোটারের মাল্টিস্টোরি বিল্ডিং গণেশদের
একতলা স্যাঁৎস্যাঁতে বাড়িটাতে অন্ধকার নামালো । ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার
বাবা টিবি ধরিয়ে ন’মাস জাল ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে গেলো ।সমাজসেবী
মধুবন্তীকে গণেশ দেখলো ।বাবার চিকিৎসার জন্য চেকটা মধুবন্তী গণেশকে
দিলো বাবা মর্গে ঢোকার পর ।চেকটা নিয়ে গণেশ আগে ব্যাঙ্কে ছুটলো ।
ম্লানমুখে মধুবন্তীও চাইলো চেকের টাকাটা গণেশকে বাঁচাক ।

*********"""*******************
অপ্রত্যাশিত
কলমে - শ্রীলিম 
রচনা- ২৯ ভাদ্র ১৪১৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
স্থান - বালিয়াপুর, আসানসোল। 
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""

     রেলের কামরায় বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আকাশের ক্ষীণ চাঁদটি দেখতে দেখতে যাচ্ছি। এমন মনে হল চাঁদ যেন আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। শশীকলাটি একবার ডুব দিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে, ঐতো ঐখানেতে ভেসে উঠল। যেখানটাতে কালো মেঘের মাঝখানটাতে স্বচ্ছ শুভ্র নীলাকাশ দেখা যাচ্ছে। সত্যিই রাতটা কী মধুর, আমার তনু-দেহে কী পুলকই না রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। আমাকে বার বার ডেকে আলতো আবেশে জড়িয়ে জড়িয়ে উতলা করে তুলছে।

     কামরার দিকে চেয়ে দেখি একটা শোরগোল পড়ে গেছে। কী হল, ব্যাপারটা কী ? বুঝতে একটু সময় লাগল। দেখলাম দু’জন অতিরিক্ত মেদবহুল আর একটার দেহে মেদের ক্ষীণ আভাসটুকু নেই; তারা টিকিট চেক করতে উঠেছে। যাদের কাছে টিকিট নেই, তাদের তো এই গরমে ঘাম ঝরছেই; এই ঘটনাতে একটু বেশি ঘাম বিগলিত হতে শুরু করেছে। আমার টিকিট করাই ছিল, অতএব আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত রইলাম।

     হঠাৎ দেখি, যারা টিকিট চেক করছে তারা একজনের সাথে বচসা করছে। আমি উৎসুক মনে সবকিছু চোখ দিয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। মন বলছে দেখিই না কী হয় ব্যাপারটা। আমি দেখলাম টিকিট চেকারবাবু বলছে, “তোমার টিকিট নাই, অতএব তোমাকে জরিমানা ভরতে হবে।” অপরদিকে ঐ ব্যক্তিটি চুপচাপ ছিল। দেখলাম তার মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং এক চিলতে হাসি দেখা গেল। সে বলল, “আমি জরিমানা দিচ্ছি কিন্তু তার আগে আপনারা আপনাদের পরিচয় পত্র দেখান।” তাদের কাছে এই প্রশ্ন একেবারেই অপ্রত্যাশিত কিন্তু তাতেই তিনজনের মুখ অমাবস্যা রাতের ঘন কালো ছায়ায় ছেয়ে গেল।
------------/------------

পানার ভিড়ে 
খুকু ভূঞ্যা


ছাই দিয়ে থালা মাজছে বধূ। ডোবার জল ভরে আছে শ্যাওলায়।যতই হাত দিয়ে পানা ঠেলছে মূহূর্তেই ভরে যাচ্ছে।
কতদিন সে মুখ দেখেনি জলের আয়নায়। আঁচলে ধরেনি জলচাঁদ।যতবার খালি মনটাকে পুবের দিকে ঘোরাতে চেয়েছে, বেড়ে গেছে মেঘ।
পানা সরাতে সরাতে নদী হওয়া হোলো না।
ভাঙা ঘাটে ধুতেই থাকে জন্মের ক্ষতচিহ্ন--
-----------/------------

বাড়া কমা 
তপনকান্তি মুখার্জি 


মনে বৃষ্টির ঝড় তুলে আমার ফ্ল্যাটে এলো পুরোনো বান্ধবী । সন্ধ্যায় ও যখন চলে গেল , একগোছা যুবতী বেলা ফেলে রেখে গেল ফ্ল্যাটে। আনন্দে আমি সারাঘর ছুটে বেড়ালাম এলোমেলো পদক্ষেপে । ক্লান্ত হয়ে বসলাম । রাত বাড়ল । বয়সও বাড়ল একদিন । আবার বয়সটা কমেও গেল বেশ কিছুটা । 
'----------------/---------------

সাদা কালো 
 কাজী সামসুল আলম 


শর্মা সাহেব, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, এক নম্বরের ঘুষ খোর, আগাম টাকা না পেলে একটিও বিল ছাড়েন না। এরকম অফিসার ডিপার্টমেন্টে আগে কোনো কন্ট্রাক্টর দেখে নি, সবাই একে চামার শর্মা বলেই ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। আজ চারদিকে হৈ চৈ, হিন্দি সনমার্গ পত্রিকায় শর্মা সাহেবের ছবি ও খবর বেরিয়েছে। হেডিং দিয়েছে  "গরীবো কা মসিহা" ।  বিহারে নিজের এলাকায় গরীব ছাত্র ছাত্রীদের বইপত্র সহ পড়ার সমস্ত খরচ দেন । এজন্য তিনি পত্রিকাতে বিজ্ঞাপনও দেন। 
--------------/-----------

চাঁদ
শুভ্রাশ্রী মাইতি

মেয়েটা কোন আমলা,বৈজ্ঞানিক বা বিমানসেবিকা হতে চায়নি কোনদিন।
ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষিকাও নয়।
এমনকি জনপ্রিয় মডেল,সিনেমার লাস্যময়ী নায়িকা বা টিভি সিরিয়ালের পরিচিত মুখ হওয়ার কোন বাসনাও তার হয়নি কখনো। 
  সে শুধু চাঁদ হতে চেয়েছিল।
  ঝকঝকে নির্মল আকাশে চকচকে পূর্ণিমার চাঁদ।শুধু শরীরে নয়,মনেও।
           চাঁদ বোধহয় শুনেছিল সে কথা মন দিয়ে।
      তাই আজ নির্জন পথের ধারে তার বিবস্ত্র শরীর ঘিরে হিংস্র জান্তব উল্লাসের নারকীয়তা।
একইরকম জ্যোৎস্না ঢেলে চাঁদ একেবারে নির্বাক,নিশ্চুপ সীমাহীন উদাসীনতায়।
           মেয়েটা বোধহয় সত্যিই ভুলে গিয়েছিল,চাঁদ হতে গেলে,শুধু আলো নয় কলঙ্কের কালো দাগগুলোকেও শরীরে মেখে নিতে হয় মুখ বুজে।
--------------/-------------

জয়ী  
 পার্থ সারথি চক্রবর্তী 


 পোডিয়ামে উঠতে গিয়ে চোখে জল শিবানির!দেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনাজয়ী প্যাডলার।কঠিন পরিশ্রমের ফল। কিছুদিন আগেও জীবনে ছিল ঝড়। হঠাৎ বাড়িতে খানতল্লাসি। কার মিথ্যা অভিযোগে! সুযোগসন্ধানীরা অবশ্য নখ-দন্ত শানিয়েছে যথারীতিই। তবে ঈশ্বরে ভরসা ছিল তার।মাটির মেয়ে কখনো দেশবিরোধী কাজ করতে পারেনা! কালের নিয়মে সে কালিমামুক্ত! আজ দেশের গর্ব!
তুমুল হাততলিতে সম্বিত ফিরল.....
------------/-------------

কলির ইংরেজ পুত্র
সমরেশ সুবোধ পড়িয়া


বাপমায়ের থেকে বারো বছর আলাদা করে চব্য চষ্য লেহ্য পেয় খাদ্য খাওয়া একমাত্র ছেলে সূর্য এখন বাপের শ্রাদ্ধের পরে মায়ের পেনশন দাবি করলো৷ বিজলী, জল ও পুকুর বন্ধ করে মাকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে মাকে বলে; তোমার কোন্ গোঁসাই তোমাকে বাঁচাবে, দেখবো৷

সূর্যের ছেলে ইংরেজী জানে৷ বিচারক নগেন ও রতিকান্তকে জেলের ভয় দেখাচ্ছে সূর্য৷
------------/----------

 জোঁকের মুখে নুন !
   গোবিন্দ মোদক 


          স্বপনবাবু পেশায় উকিল। তাঁর অকাট্য যুক্তি-জালে বাঘা-বাঘা প্রতিপক্ষও কুপোকাত হয়। ইদানিং স্বপনবাবু খেয়াল করেছেন সবজি-বিক্রেতার সঙ্গে প্রায়ই হেসে হেসে কথা বলে তাঁর গৃহিণী। স্বপনবাবু এবিষয়ে কটাক্ষ করতেই গৃহিণীর ছোবল -- "ও ! আমার বেলায় যতো দোষ ! আর তুমি যখন কাজের মেয়েটার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলো, তখন ?" জোঁকের মুখে নুন পড়ে যেন !
-------------/-----------

আত্মহত্যার রহস্য
মতিলাল দাস 

হঠাৎ একদিন মেয়েটা ছেলেটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত আনন্দ, কত উচ্ছ্বাস, কত আশা এপার্থিব জীবনে। জোছনারাতের মায়াময় পূর্নিমায় আনন্দে দোল খাওয়া মনের তরীখানা বয়ে যায় সুখ সমুদ্রে।  দিন যায় দিনের মত রাত আসে অন্ধকার নিয়ে, মনটা অল্পদিনেই বিষিয়ে ওঠে।  তারপর একদিন কাকডাকা ভোরে চারিদিকে হৈচৈ। সবাই দেখল মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।
---------------/-----------

 আশ্রয়   
ডাঃ নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 

বৌদি যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন দাদা  একমাত্র ভাইটিকে, তাঁর পাশে দাঁড়াতে বললেন। 
সনাতন দাদা শুভাননের লাঠি হয়ে  দাদার ভাড়া বাড়ীতে এলেন।আটষট্টির  সনাতনের ঠিকানা 
বদল এই নিয়ে পঞ্চমবার। সতেরো বছর বয়সে  কয়েকমাসের ব্যাবধানে 
পিতৃ- মাতৃহীন। মানুষটি কোন আত্মীয়র ঘরে চিরস্থায়ী আশ্র‍য় পাননি । সাত বছর পর আজ দাদা চলে গেলেন। সনাতন শ্মশান থেকে ফিরে তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে।  হয়তো আশ্র‍য়ের খোঁজে।।
-------------/------------
চুরি  
 দীপক জানা 

বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বিশুর। কারখানা বন্ধ। জানেনা কেউ। রামরাজাতলাতে ছেঁড়া পোষাকটা পরে ভিক্ষেতে বেরোয়। দীর্ঘ লকডাউন। বাড়ি ফেরা হয়নি বহুদিন। রাত কাটে দোকানের শেডের নীচেই। ভিক্ষেও মেলেনা তেমন। 
    ঘুম ভাঙছে। উঠতে ইচ্ছে করছেনা। জ্বর, গলা ব্যথা। মাথার নীচে টাকায় হাত বাড়ায়। চমকে ওঠে। নেই। মোবাইলটাও। দমকা কাশিতে লুটিয়ে পড়ে।
--------------/------------

মায়ের জিজ্ঞাসা
জন্মেঞ্জয় সাহু


অমিতাভ তার বিধবা বৃদ্ধা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এল। মা পরে ফোনে তাকে বললেন , " আমি  আমার এই রক্তমাংসের ছোট্ট শরীরের গর্ভে অনেক কষ্টে তোকে ধারণ করলাম এবং জন্ম দিয়ে বড় করলাম। আর তুই তোর ইট-কাঠ-পাথরের অনুভূতিহীন এতবড় বাড়িটাতে আমার  বুড়ো শরীরটাকে ধরাতে ও বাড়িতেই আমাকে মরতে দিতে পারলি না ? "
-------------/---------

দলিল 
রজত দাস


একসঙ্গে যাতায়াত হয় তাই মুখোমুখি হয়েছে অনেক বেশি। পৈতৃক দোতলা পাকাপোক্ত মাটির বাড়ি। শেষ পর্যন্ত বাবা মা'র মৃত্যুর পর থেকে বেশ কিছু অশান্তি নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বউ দের ও দিন শুরু হয় গলাবাজি করে।
    ছোটো খাটো অশান্তি আলোচনা সভায় মিটেছে কিন্তু মতানৈক্য তাদের শত্রু করে তুলেছে।
    শেষ পর্যন্ত বাস্তুজমি ভাগ করে অর্ধেক হলো। রেজিস্ট্রেশন দলিল স্বাক্ষর করে তারা এখন আলাদা।
  একবছর পর পুরাতন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে ছোটো ছেলে। 
  পুরাতন ভিটে ছেড়ে চলে ঘাঁটি গড়তে হবে অন্যত্র। দুই ভাইয়ের ভরসা এবার বাড়ি বানানোর জন্য আবাস যোজনার সরকারি সাহায্য।
    ভ্রাতৃত্বের ঐতিহ্য ও ভেঙে যায় চোখের সামনে পুরনো বাড়িটার মতো।
------------/-----------

বৃষ্টি ধারা
  দেবাশিস চক্রবর্ত্তী

আজ রাতের আকাশে কোনো তারার দেখা নেই । আকাশ ঢেকে আছে একরাশ প্রসুতি মেঘে । যে কোন মুহুর্তে ঐ মেঘ প্রসব করবে বৃষ্টি ধারাকে । সেই মেঘের সন্তানকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে লালন করবে প্রকৃতি ।
          জানলার গরাদ ধরে নিদহারা বৃদ্ধা শ্রাবণী ভাবে তাঁকে একলা ফেলে যাওয়া সন্তানের কথা । চোখে তাঁর অবিরাম বৃষ্টিধারা ।
----------/------------

টবভাঙ্গা বনসাই
শ্যা ম সু ন্দ র ম ন্ড ল 


সমাজটবে রক্তিম একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। শিল্পী পৃথিবীবাধা ঠেলে তাকে গ্রহণ করে। তার সংকল্প , রক্তিমকে সূর্য করবেই। কিন্তু রক্তিমের শেকড়গুলো তাকে রক্ত না দিয়ে অচল রাখার ফন্দিতে শিল্পীপীড়ন করতে থাকে। অথচ শিল্পীর এই অপমানে রক্তিম নির্বিকার। শিল্পী ক্যানভাসে নদী হয়,তবুও ভাসে না,ভালোবাসা আঁকে অক্লেশে। একদিন শিল্পীপীড়নে বানভাসি জল ছুঁতেই রক্তিমের তীব্র লালেই গুটি কেটে বেরিয়ে আসে লাল প্রজাপতি।
--------------/-------------

 গাত্রবর্ণ
বিশ্বনাথ পাকড়াশি


আজই সিজারিয়ান হবে কৃষ্ণার। কেবিনের বিছানায় শুয়ে উদ্বেগের ছড়্ বিছড়।
    কৃষ্ণা, আসলে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। আর উজ্জ্বল বেজায় ফর্সা। নেহাত আই.টি. সেক্টরে কর্মরতা পাত্রী, তাই বিয়ের সময় মিইয়ে গিয়েছিল আপত্তির ঝড়। তবু...
        অপারেশন শেষের দিকে। নার্স বললেন, ফুলের মত একটা মেয়ে হয়েছে আপনার।
        আচ্ছন্ন গলায় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, কালো হয়নি তো?
------------/-------------

শিক্ষার আলো
 সুকান্ত আচার্য্য


ব্যাস্ত রাস্তা, লোকজন যে যার নিজের তাগিদে ছুটছে। ছেলেটি আপন মনে ছেঁড়া কাগজ, প্লাস্টিক বোতল, আরও নানা ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটি খবর কাগজের টুকরোয়  দেখতে পেলো লেখা আছে, ' শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বলবে'। প্রখর রোদে আকাশের দিকে চেয়ে ছেলেটি মনে মনে বলল," ঘরে ঘরে নাকি শিক্ষার আলো জ্বলবে, কিন্তু যাদের পেটে খিদের আগুন জ্বলে, তাদের ঘরে কিভাবে শিক্ষার আলো জ্বলবে!"
---------------/----------

হকার
নন্দিনী সরকার


"পাতি লেবু তিনটে দশ, তিনটে দশ।"
রাত আটটার হাওড়া ব্যান্ডেল লোকালে ফেরি করা ছেলেটার থেকে কিনে নিল বিনীতা। কালকে সকালেই লাগবে।
"পাঁচ টাকায় এক প্যাকেট, পাঁচ টাকায় এক প্যাকেট বাদাম ভাজা"
শুনতে পেয়ে বুড়ো দাদুর কাছ থেকে চার প্যাকেট বাদাম ভাজা কিনল বিনীতা ওর আর ওর মায়ের জন্য।

এর ঠিক এক সপ্তাহ পর থেকে সব লোকাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনীতা এখন বাসে আর টোটো করে কাজে যায়।

 ভদ্রকালী বাজারে পরশু সকালে ট্রেনের ঐ ছেলেটাকে লেবু বিক্রী করতে দেখেছে। খুব রোগা হয়ে গেছে। আর সেই বুড়ো দাদু কি আর বাদাম ভাজা বিক্রী করতে পারছে? মনে মনে ভাবতে থাকে শ্রমজীবী হাসপাতালে আয়ার কাজ করা বিনীতা যার এই ভাবে যাতায়াত করতে খরচ বেশি হচ্ছে আর খুব কষ্ট করে নিজের আর মায়ের খরচ চালাতে হচ্ছে।
------------/-----------
কৃষ্ণকলি                              
রাজীব ঘাঁটী

সেদিন হঠাৎ করেই ঝিমঝিম বৃষ্টি শুরু হল। হঠাৎ দেখি একটি মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের আম গাছটার নীচে এসে দাঁড়াল।মুখে মাস্ক পরা তার উপর ওড়না দিয়ে মুখটা ঢাকা।স্বাভাবিক উচ্চতা,সুঠাম চেহারা মানে ঐ জানলা দিয়ে যেটুকু নজরে আসে।হাতে ডায়রী কলম নিয়ে তখন বৃষ্টির গন্ধ মাখতে মাখতে এলোমেলো ভাবনা গুলোকে সাজিয়ে প্রশ্রয় দেবার চেষ্টা করছি।কেন জানিনা ওড়নার আড়ালে থাকা মুখটা ক্রমশ আমায় টানতে লাগলো। বৃষ্টি বাড়লো । এই করোনায় আমাদের বাড়িতে কাউকে আপ্যায়ন করে বসানো হচ্ছে না । অন্যমনস্ক হতেই  দেখি মেয়েটা নেই। ভাবলাম কি নাম হতে পারে মেয়েটার ,মুখটাও দেখলাম না,একটা প্রেমের কবিতা ততক্ষনে ডাইরী বন্দী। হঠাৎ কথার গুঞ্জন কানে আসতেই বসার ঘরে গেলাম । দেখি ঐ মেয়েটা গল্প জমিয়েছে আমার পরিবারের সাথে। আমাকে দেখে বললো নমস্কার। আমি আপনাকে চিনি,আপনার কবিতা আবৃত্তি করি। আমি তো হতবাক । ভালো করে দেখলাম মেয়েটিকে  শ্যামলা রঙের মেয়েটি অতি সুন্দর। যেন রবিঠাকুরের সৃষ্ট কোন চরিত্র। এক নজরেই কেমন যেন ভালো লেগে যায়। সঙ্কোচ কাটিয়ে 
জিজ্ঞাসা করলাম আপনার নাম ?
ও বললো কৃষ্ণকলি।
--------------/----------
অনুভূতি
 অঞ্জন কুমার দাস


বোষ্টমের খঞ্জনী আজ ও বাজে । কিন্তু না মনের মাঝে রাধাকৃষ্ণ দেখা যায় না । ভোর রাতে মহালয়া আজ ও শোনে কিন্তু তেমন রোমাঞ্চ আর জাগে না। কেন? উত্তর খুঁজে পায় না সুমন। দশ বছর বয়সে বাবা মা কে হারিয়ে ফেলে সে। বুড়ি পিসি চোখে র জল ফেলে বলত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠ বাবা। আরো দশটা বছর কাটিয়ে সুমন সত্যি বড়ো হয়েছে । কিন্তু অনেক কিছু ই হারাতে  হয়েছে তাকে । তার মধ্যে অন্য অনুভূতি।
--------------/-------------
কিস্তিমাত
শ্রাবণী বসু

ক্ষমতাকে দাবা ভেবে আমাদের বোড়ে বানিয়ে ভোগের পাতে তুলেছিলেন - আপনি,রাজা।

আপনাকে পিতৃতুল্য ভেবে সম্মান দিয়েছি।আশ্রয় চেয়েছি। 
বিনয়কে দুর্বলতা ভেবে ঠোঁট ডুবিয়েছেন আমাদের কুমারীত্বে।

সম্পর্কগুলোকে যারা কলুষিত করে ,আপনি তাদের মধ্যে একজন।

চেয়ে দেখুন ,আপনার চারপাশে  দাঁড়িয়ে  আমরা ছককাটা দাবার ওপর। 
আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি - আপনি।

একঘরও সরার উপায় নেই।

-----/ --------------
হাত ধরে সখা নিয়ে চলো...
বিষ্ণুপদ জানা

   ' এসেছে শরৎ হিমের পরশ' ছোট্ট মিতা বইয়ের পড়া পড়তে পড়তে মাকে বলে - গ্রামে মামার বাড়িতে শরতের শোভা ....
     নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ..অরুণ আলোর অঞ্জলি... শাপলা শালুক পদ্মের শ্যামল হাসি... মাঠে মাঠে সবুজ ধানের যৌবন ...
     অমিতের হাত ধরে যান্ত্রিক শহুরে জীবন । 
ফি বছরের মত এবারও শ্যামল শালুক শাপলা .. মায়ের মুখ ....দেখা হবে না জেনে, মনটা বিষিয়ে ওঠে তার।
    তেতলার ছাদে শান বাঁধানো পরিতক্ত জলাধার  ... ফুটে উঠেছে ..একটি নীল শাপলা শালুক..

       অজান্তে অমিতের এমন উদ্যোগ ...

    নিরুতাপ গৃহবন্দী জীবনের পড়ন্ত বিকেল .. হাতে হাত ..সিঁড়ি ভেঙে.. শ্যামল শাপলা মুখ দেখবে বলে..
      রিংটোন বেজে ওঠে....
       -  হাত ধরে সখা নিয়ে চলো...

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
 


Friday, 28 August 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                   আলোচনা পর্ব
                    বই ও বই পড়া

¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶
                Doinik Sabder Methopath
                  Vol - 114. Dt - 29.8.20
                   ১২ ভাদ্র, ১৪২৭. শনিবার
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

            সরস উক্তি :

১) বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয় না।
         -    সৈয়দ মুজতবা আলী
২) একটি ভালো বই হলো বর্তমান ও চিরকালের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু।
-টুপার

৩) বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান।
-সুইফট

৪) পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের একচোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত্ ঘোঁত্ করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কি? প্রথমতঃ বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি।
— সৈয়দ মুজতবা আলী

৫) যদি বইটা হয় পড়ার মতো তা কেনার মতো বই।
— জন রাসকিন

৬)বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এটি হচ্ছে পাঠকের ভুল। বই লেখা জিনিসটা একটা শখমাত্র হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বই কেনাটা শখ ছাড়া আর কিছু হওয়া উচিত নয়।
— প্রমথ চৌধুরী

৭)  বই বিশ্বাসের অঙ্গ, বই মানব সমাজকে টিকাইয়া রাখিবার জন্য জ্ঞান দান করে। অতএব, বই হইতেছে সভ্যতার রক্ষাকবচ।
— ভিক্টর হুগো

৮) বই লেখাটা নিষ্পাপ বৃত্তি এবং এতে করে দুষ্কর্ম থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
— বার্ট্রান্ড রাসেল

৯) একবার যার পড়ার নেশা লেগেছে, সেকি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও তা ছাড়তে পারবে?
—মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন

১০) ছাপাখানার কল্যাণে আজকাল ভাল বই খারাপ বই একইভাবে সজ্জিত হইয়া বাহির হয়। তৃতীয় শ্রেণির পুস্তকও সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে এবং বিজ্ঞাপনের কৌশলে প্রথম শ্রেণির পুস্তকের পাশে সমগৌরবে স্থান পায়।
—বনফুল

১১) যে বই পড়েনা,তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মেনা।
-পিয়ারসন স্মিথ

১২) গৃহের কোনো আসবাবপত্র বইয়ের মতো সুন্দর নয়।
-সিডনি স্মিথ

১৩) কতকগুলো বই সৃষ্টি হয় আমাদের শিক্ষা দেবার জন্য নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই কথা জানানো যে, বইগুলোর স্রষ্টারা কিছু জানতেন।
— গ্যেঁটে

১৪) বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না, কোনদিন মনোমালিন্য হয় না।
— প্রতিভা বসু

১৫) আইনের মৃত্যু আছে কিন্ত বইয়ের মৃত্যু
নেই।
-এনড্রিউ ল্যাঙ


 বই পড়া :

                           বই আলোচনা, গ্রন্থ সমালোচনা, পুস্তক পর্যালোচনা যে নামেই ডাকি না কেন,  মূলত যে বিষয়টি এদের উদ্দেশ্য - তা হলো কোন একটি বইকে পাঠকের সামনে প্রত্যাশা অনুযায়ী উপস্থাপন করা। তা ব্যক্তিগত ইচ্ছাধীন যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মমাফিক। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভেদে বই আলোচনা সমালোচনা সম্পর্কে নীতিমালা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে সকলেই নিজ নিজ প্রয়োজন ও অবস্থান অনুযায়ী একটি বইকে পাঠকের সামনে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে চায়। এ জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়ম কখনই কোন বইয়ের সম্পূর্ণ পরিচিতিকে বিবৃত করতে পারে না; সকলের চাহিদাকে তৃপ্ত করতে পারে না। নির্দিষ্ট নিয়মাবলী আংশিক পরিচিতিকেই উপস্থাপন করে মাত্র। তবে পুস্তক পর্যালোচনার প্রধান প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে বলা যায় -

'সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ' বা 'নিবিড় অধ্যায়নমূলক কাজ শুরু করার আগে বই হাতে নিয়ে যা করণীয় বলে মনে হয় -  
  • শিরোনামঃ                                             বই হাতে নেয়ার আগেই চোখে পড়ে তার শিরোনাম। তাই নামটি ভাল করে পড়া। একটু চিন্তা করা । শিরোনাম পড়ে কিছু কি বোঝা যাচ্ছে? শিরোনামটি কি কোন কিছু বলতে চাচ্ছে? শিরোনামটি একটি মাত্র শব্দ নাকি শব্দগুচ্ছ নাকি বাক্য দিয়ে তৈরি? শিরোনামে তো মূল ভাবটি অন্তর্নিহিত থাকে।
  • প্রচ্ছদঃ                                             বইয়ের প্রচ্ছদটার দিকে মনোযোগ দিয়ে হয়।  বইয়ের নামের সাথে প্রচ্ছদের কোন মিল বা অমিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি না? প্রচ্ছদ হিসেবে কোন বিমূর্ত চিত্র নাকি কোন ফটোগ্রাফ ব্যবহার করা হয়েছে? রঙের ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় আছে কী?
  • প্রথম পাতাঃ                                       বইয়ের প্রচ্ছদ উল্টানোর পর প্রথম পাতাটি আসে। এখানে বইয়ের নাম/ শিরোনাম, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক বা সংকলকের নাম থাকবে। পাতার নিচে থাকবে প্রকাশনীর নাম।
  • প্রিন্টার্স লাইনঃ।                                  প্রথম পৃষ্ঠাটির বিপরীত পাতায় থাকে 'প্রিন্টার্স লাইন'। এখানে আবারও বইয়ের নাম, লেখকের নাম,  প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম, প্রকাশকের পরিচিতি, প্রকাশনীর নাম, প্রকাশকাল, কততম সংস্করণ, মূল্য, যোগাযোগের ঠিকানা ইত্যাদি থাকে।
  • উৎসর্গঃ                                             এরপর সাধারণত থাকে উৎসর্গ। বইটি কারও উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে কী না? কোন সম্মানিত মৃত ব্যক্তি, প্রিয় ব্যক্তিত্ব, পিতামাতা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যে কারও উদ্দেশ্যে লেখক বইটিকে উৎসর্গ করতে পারেন।
  • ভূমিকা/ মুখবন্ধঃ                                বইয়ের এই অংশে লেখক বইটি লেখার পটভূমি, উদ্দেশ্য, কার্যবিবরণ ইত্যাদি উল্লেখ করে থাকেন। লেখক যা কিছু এবং যতটুকু বলতে চেয়েছেন তা বইয়ে কতটুকু সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে তার বর্ণনা দেন। বইটি কোন শ্রেণীর পাঠকের জন্য লেখা লেখক সে বিষয়ে নিজের মনোভাব এখানে ব্যক্ত করেন। লিখিত বইটির বিষয়, আলোচনার পরিধি, কার কার নিকট থেকে উপকৃত হয়েছেন, কীভাবে উপকার নিয়েছেন ইত্যাদির বিবরণ এখানে থাকে। মুখবন্ধটি আদ্যোপান্ত পাঠ করে আপনার কাছে এমন কি মনে হয় যে, লেখকের আরও কিছু স্বীকার করা উচিত ছিল? একাধিক সংস্করণ বা মুদ্রণ হলে প্রত্যেক সংস্করণের জন্য স্বতন্ত্র ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয়। লেখক সে কাজ করেছেন কি?
  • সূচি :                                                   একটি বইয়ের বিভিন্ন আলোচ্য বিষয় এই অংশে সাজানো থাকে। এই সূচীপত্র দেখে বইটির আলোচ্য বিষয়ের ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ইত্যাদি বোঝা যায়। বইয়ের বিভিন্ন অংশ বা পরিচ্ছেদের নাম কী, কততম পৃষ্ঠায় কোন অংশ রয়েছে, তা এখান থেকে চট করে দেখে নেয়া যায়। তাই কোন বই পাঠ শুরু করার আগে 'সূচীপত্র' পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।
  • বইয়ের অবয়বঃ বইয়ের আকার, পৃষ্ঠার মান, পৃষ্ঠাসংখ্যা, বাঁধাই ইত্যাদি দেখে নেওয়া দরকার।
  • অনেক বইয়ের শেষে গুরুত্বপূর্ণ শব্দের তালিকা, নির্ঘন্ট, পরিশিষ্ট, ছক, ছবি, সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ সংযুক্ত থাকতে পারে। সেগুলো দেখে নেয়া অবশ্য কর্তব্যের মধ্যেই পরে।


                               এবার বইটি পাঠ করা শুরু করা যেতে পারে।  হাতের কাছে খাতা ও কলম প্রস্তুত অবস্থায় রাখতে হবে। চেয়ার টেবিলে বসে
 পড়া বা বিছানায় শুয়ে পড়া - খাতা কলম সংগ্রহ - । বইটি পাঠ করতে করতে যা কিছু আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করবে তা লিখে ফেলা , কোন শব্দ, কোন বাক্য বা কোন অনুচ্ছেদ (প্যারাগ্রাফ) পৃষ্ঠা নম্বরসহ লিখে নেওয়া। 
 আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো -
  • ধরণ/ শ্রেণীঃ                                        বইটি শিল্পসাহিত্যের কোন রীতির প্রতিনিধিত্ব করছে-  তা অনুভব ক রা। এটা সাহিত্য, দর্শন,  ভূগোল, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, বিজ্ঞান নাকি শিশুতোষ কোন বই?
  • দৃষ্টিকোণঃ                                       লেখকের দৃষ্টিকোণ বোঝার চেষ্টা - তিনি কোন অবস্থানে নিজেকে রেখে বইটি লিখেছেন? কোন শ্রেণীর পাঠককে উদ্দেশ্য করে বই রচনা করেছেন?
  • উদ্ধৃতিঃ।                                            বইটির কোন বাক্য বা অনুচ্ছেদ কি আপনার ভাল লেগেছে, মনে অনুরণন তুলেছে, চিন্তায় আলোড়ন তুলেছে? তাহলে সেই অংশটুকু সঙ্গে সঙ্গে খাতায় উর্ধ্বকমার মধ্যে লিখে ফেলা । পাশে ব্রাকেটের মধ্যে পৃষ্ঠা নম্বর লিখতে ভোলা যাবে না।
  • লেখকের ভঙ্গীঃ                                  লেখক কী প্রথামতো, নাকি গল্পের মতো আত্মজীবনীর ভঙ্গীতে বইটি লিখেছেন? যে শ্রেণীর পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখা তাদের জন্য উপযোগী হয়েছে কী?
  • ভাষাঃ                                                 বইয়ের ভাষা কি সহজ, সরল, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল, সাবলীল নাকি অস্পষ্ট, জটিল, অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারে ভারাক্রান্ত।
  • পাদটীকা:                                           বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোতে পাদটীকা বা ফুটনোট ব্যবহার করা হয়েছে কি না? উল্লেখযোগ্য টীকাসমূহ পৃষ্ঠার পাশের কলামে অথবা পৃষ্ঠার নিচে ব্যবহার করা হয়। কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে? পাদটীকাতে উল্লেখ করা তথ্য মূল প্রবন্ধের কোন শব্দ বা বাক্য বা সিদ্ধান্তকে যথাযথ উদাহরণ, বিশ্লেষণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কী? ফুটনোটে উল্লেখিত তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য? ফুটনোটে ব্যবহৃত তথ্যগুলোর উৎস ঠিকমতো উল্লেখ করা হয়েছে কি?
  • ম্যাপ, ছবি, ছক ইত্যাদি ব্যবহার করে আলোচ্য গ্রন্থটিকে পাঠকের নিকট অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে কী না? সেগুলো রঙিন নাকি সাদাকালো; ছাপানোর মান স্পষ্ট নাকি দুর্বোধ্য তা খেয়াল করা।
  • বানানের বিষয়ে লেখকের অবস্থান কীরূপ? তিনি কি তাঁর বইটিকে বানানবিভ্রাটমুক্ত রাখতে পেরেছেন? বানানরীতি হিসেবে তিনি কোন নিয়মকে গ্রহণ করেছেন?
  • লেখক তার ধারণাটিকে কি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে পেরেছেন? কোথাও অস্পষ্ট মনে হচ্ছে না তো? যদি হয়, তাহলে কেন এরকম মনে হচ্ছে বলে মনে করেন?
  • বইয়ে প্রদত্ত ভাষ্য কতটা নিখুঁত? কোন অতিশয়োক্তি বা অসম্পূর্ণতা আপনার চোখে পড়ছে কী?

                  এবার বইয়ের,  পর্যালোচনা - সমালোচনা - বিশ্লেষণ বা আলোচনা লেখার কাজটি শুরু করা যেতে পারে। বইটি পড়তে পড়তে খাতাতে যে বিষয়গুলো টুকে নিয়েছেন, সেগুলো একবার দেখে নিন, মাথায় গেঁথে নিন। এই অংশটি কিছুটা সৃষ্টিশীল।  এখানে আলোচ্য বইয়ের বিষয় সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের গভীরতা, মানবিক বোধ, শব্দভান্ডার, বাক্য গঠনে সামর্থ, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ইত্যাদির পরিচয় থাকবে।
  • আলোচনাটির একটি নাম ভাবুন। নামটি প্রথমে দিতে না পারলেও লেখা শেষ করে দিতে পারেন। একটি উপযুক্ত নাম আপনার আলোচনাটিকে পরিচিতি দেবে; অতএব সাবধানে, সুচিন্তিতভাবে নাম পছন্দ করুন। একটি মাত্র শব্দ, দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে তৈরি শব্দবন্ধ অথবা পুর্ণাঙ্গ একটি বাক্য আপনার সমালোচনাটির শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। নামচয়নে আপনার চিন্তার মৌলিকতা ও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটান।
  • আলোচ্য বইটির শিরোনাম, লেখকের নাম, প্রকাশকাল, প্রকাশনী, পৃষ্ঠাসংখ্যা, প্রকাশের তারিখ, প্রকাশের স্থান, কততম প্রকাশ বা মুদ্রণ বা সংস্করণ, মূল্য, ISBN এই তথ্যগুলো উল্লেখ করুন।
  • প্রথম বাক্যটিকে আকর্ষণীয় করে লিখুন। শুরুতেই হয়তো কাঙ্ক্ষিত বাক্যটি মাথায় আসবে না। সেজন্য অপেক্ষা করুন। সম্পূর্ণ সমালোচনা লিখে শেষ করার পর প্রথম বাক্যটিকে পুনর্লিখন করতে পারেন।
  • আপনার বলার ভঙ্গী পাল্টাবেন না। অর্থাৎ নির্মোহ বা আড্ডা/ বৈঠকী যে ভঙ্গিতেই শুরু করুন না কেন তা বজায় রাখুন।
  • বইটি আমাদের কী শিক্ষা দেয়। বইটির নিবিড় পাঠ আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয়, তার ব্যাখ্যা দিন।
  • সমস্ত বইটির একটি সারসংক্ষেপ উল্লেখ করুন। বইটি একাধিক অনুচ্ছেদ বা অধ্যায়ে বিভক্ত থাকলে প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের সারমর্ম আলাদা আলাদাভাবে বর্ণনা করুন। সারসংক্ষেপ বলতে মূলভাবকে বোঝানো হচ্ছে। একেবারে কয়েক লাইনের সারাংশ হলে হবে না।
  • লেখকের রচিত অন্য কোন বইয়ের সাথে আলোচ্য বইটির ভাষা, বিষয়বস্তু, উপস্থাপন ভঙ্গী ইত্যাদির তুলনা করতে পারেন।
  • একই বিষয়ে অন্য লেখকের লিখিত বইয়ের সাথে আলোচ্য বইটির তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে।
  • একই বই হয়তো অন্য কেউ আলোচনা করেছেন। তার আলোচনার সাথে আপনার নিজের আলোচনা কতটা স্বাতন্ত্রমণ্ডিত  ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তার উল্লেখ করতে পারেন।
  • আপনি জীবনে যতগুলো বই পড়েছেন, তার মধ্যে এই বইটির অবস্থান কোথায়, কেমন লেগেছে, কেন লেগেছে তার বর্ণনা দিতে পারেন।
  • লেখক সম্পর্কে তথ্য দিন। তার সাহিত্যিক জীবন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মজীবন, মানবিক বৈশিষ্ট্য, দার্শনিক বোধ ইত্যাদির উল্লেখ করতে পারেন।
  • যে পাঠক আপনার করা বিশ্লেষণটি পড়ছে, তার বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি ভাবুন। তার চোখ দিয়ে নিজের লেখাটি আরেকবার পড়লে ভালো।
  • বইটি কোন বয়সের বা কোন মানসিকতার পাঠকদের উপযোগী করে রচিত তা উল্লেখ করতে পারেন। তাহলে আপনার আলোচনা পড়ে পাঠকের বই বেছে নিতে সুবিধা হবে।
  • বইটি কি আপনি অন্যদের পড়তে বলবেন? উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তাহলে কেন অন্যদেরও এই বই পড়া উচিত তা উদাহরণসহ বর্ণনা করুন। নেতিবাচক হলে তারও ব্যাখ্যা দিন।
  • কোন বইয়ের কোন একটি মাত্র উপাদান হয়তো আপনাকে আকৃষ্ট করেছে; সেটাকেই আলোচ্য করে তুলতে পারেন।
  • লেখক এবং লেখকের বই- এই বিষয়দুটোকে সংক্ষিপ্তাকারে উপসংহারে উল্লেখ করুন। সার্বিক বিবেচনায় বইটি সম্পর্কে সংক্ষেপে দুই একটা কথা উল্লেখ করে সমাপ্তি টানুন।
  • প্রথম লিখনে বানান, বাক্য, শব্দচয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থেকে যেতেই পারে। তাই লিখিত আলোচনাটি কয়েকদিন ফেলে রাখুন। দু'চারদিন পর নিজের লেখাটি আবার পড়ুন। কোথায় সংশোধন করতে হবে, তা নিজেই বুঝতে পারবেন। কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আপনজনকে আপনার লেখা আলোচনাটি পড়তে দিতে পারেন। সে আপনার দুর্বলতা অন্যকে জানাবে না। কিন্তু  ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে আপনার রচনাবৈশিষ্ট্যকে আরও নির্ভুল, মার্জিত করে তুলতে পারবে।

গ্রন্থ আলোচনার এই ধাপগুলোর প্রত্যেকটি মেনে চলতে হবে এমন কোন কথা নেই। শুধু খেয়াল
,রাখত  হবে  আপনার আলোচনা যেন বই পরিচিতিতে পর্যবসিত না হয়। এই নির্দেশনামূলক লেখাটিতে কোন বই সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে যে বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন তা উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি ইচ্ছে করলে এর মধ্যে যে কোনটি বাদ দিতে পারেন অথবা এখানে উল্লেখ করা হয়নি এমন কোন বিষয় আপনি নিজের থেকে বিশ্লেষণ বা বর্ণনা করতে পারেন। আপনার চিন্তার মৌলিকতাকে আড়াল করে রাখবেন না; বরং তার চর্চা করুন।

কোন বিখ্যাত লেখকের বই আলোচনা করতে গিয়ে দ্বিধা বোধ করবেন না। অনেক বিখ্যাত লেখকের খুব সাধারণ মানের বই আছে। আপনি নির্ভার মনে সমালোচনা লিখতে থাকুন। হয়তো দেখা যাবে, আপনি যে বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন, তা লেখকের মাথায় আসেইনি। ব্যক্তিগতভাবে জানাশোনা আছে, কারও প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা বা ঘৃণা আছে, এমন কারও বই সমালোচনা না করা উচিত। কারণ আপনার ব্যক্তিগত আবেগের স্পর্শ লেখাটিকে একপেশে একঘেয়ে করে তুলতে পারে। আপনার লেখার গ্রহণযোগ্যতা তখনই বাড়বে, যখন নির্মোহ অবস্থান থেকে আলোচনা করতে পারবেন। নৈর্ব্যক্তিক হওয়া ততোটা সহজ নয়। চর্চা করুন। ধীরে ধীরে ব্যক্তিনিরপেক্ষ অবস্থান কোনটা তা বুঝতে পারবেন। পাঠক হিসেবে নিজের কথা ভাবুন। কোন বিশেষ ধরণের বই কি আপনি বেশি পছন্দ করেন? উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান বা রোমান্টিক, রহস্যগল্প, গোয়েন্দাগল্প, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, শিশুসাহিত্য কোন একটি বিষয়ে কি আপনি বেশি আগ্রহী? তাহলে প্রাথমিকভাবে শুধু সেই বইগুলো নিয়েই আলোচনা শুরু করে দিন। ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে বিশ্লেষণ সামর্থ তৈরি হোক; আলোচনা সমালোচনায় দক্ষ হয়ে উঠুন। তারপর না হয় প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

পরিশেষে বলি - গ্রন্থ সমালোচনা করার জন্য আপনার জানার পরিধি, চিন্তাসামর্থ, বিশ্লেষণ দক্ষতা, ভাষাজ্ঞান, পাঠাভ্যাস ইত্যাদিই যথেষ্ট। কোন নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে আটকে রাখা অনুচিত। কুয়োর ব্যাঙের মতো নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে বিচরণ না করে নিজের স্বাধীনচেতনাকে অর্গলমুক্ত করুন। মোদ্দাকথা আপনি যে বইটির আলোচনা করছেন, সেই বইটি সম্পর্কে অন্যকে উৎসাহী করে তোলার মধ্যেই রয়েছে আপনার রচনাসামর্থের কৃতিত্ব।




  বই∆∆∆∆ বই ∆∆∆∆ বই ∆∆∆∆ বই ∆∆∆∆