পরপারে রবীন্দ্রনাথ
২২শে শ্রাবণ স্মরণে ( পর্ব- ১)
রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত বিশেষ সংখ্যা
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
Doinik Sabder Methopath
Vol - 91. Dt - 07.08.2020
২২ শ্রাবণ ,১৪২৭. শুক্রবার
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
বিশ্বকবির জীবনের শেষ কয়েকটি দিন
ড. প্রবালকান্তি হাজরা
বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক।
বিশ্বের বিস্ময়় রবীন্দ্রনাথ। এক জীবনের এত ধরনের রচনা ও এত বেশি সৃষ্টিমুখী সাহিত্য আর কারোর কলমে থেকে বেরোই নি। ভারতবর্ষের তো বটেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ তিনি, যিনি বলে
ছিলেন -
" মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ।"
তিনি ছিলেন মানবিক অনুভবের মূর্ত প্রতীক. প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখের মত মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণ আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি. তাঁর সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করি , তাঁর গানে প্রাণিত হই. প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণ এলে তাঁর মৃত্যু দিন কে ঘিরে আমাদের শোকগ্রস্ত করে, এমন মানুষকে আর কোন কালে পাব না বলে। তিনি জীবনের শেষ কয়েকটি দিন যেভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন , সেই কয়েকটি দিনের কথা আমরা জেনে নেব।
রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর তিন মাস. এই সময় কালে তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাধনায় কেটেছে ৬৭ বছর. গ্রামের উন্নতি নিয়ে ভাবনা ও রূপায়নে কাটিয়েছেন ৫০ বছর আর শিক্ষা ভাবনা ও প্রকৃত শিক্ষা বাস্তবায়নে সময় দিয়েছেন ৪০ বছর. পৃথিবীর কোন মহাপুরুষ একসঙ্গে এত ভাবে যুক্ত থাকেন নি. তাই তাঁর চিন্তা ও কর্মের ব্যাপ্তি দেখে আমরা বিস্মিত হই। তিনি ২০০০ মতো গান লিখেছেন, ৭০০০ কবিতা ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ ১২টি উপন্যাস ,শতাধিক গল্প, চল্লিশটি কাব্যনাট্য নাট্যকাব্য নৃত্যনাট্য রূপক সাংকেতিক নাটক, জীবনস্মৃতি , ভ্রমণকাহিনী, কয়েক হাজার প্রবন্ধ , হাজার পাঁচেক বিভিন্নজনকে লেখা চিঠি বিপুল সম্ভার। সত্যিই তিনি মহামানব মহাপ্রাণ বিবেকের জাগ্রত প্রহরী।
৪০ বছর বয়সে আদর্শ শিক্ষা নিকেতন গড়তে গিয়ে তিনি প্রায়ই ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন । তার ওপর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী কে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রায় সর্বস্ব দিয়ে ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়েন। সারা ভারতের নানা প্রদেশে ঘুরে ঘুরে দান সামগ্রী সংগ্রহে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন । গান্ধীজী বিড়লা গোষ্ঠী থেকে বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। তবুও বিশ্বভারতীর আর্থিক টান মেটানো যায় নি। নানাভাবে ভারতবর্ষের সর্বত্রই ঘুরে শারীরিক-মানসিক দুর্গতি বেড়েছে। ঘনঘন অসুস্থ হয়েছেন ।এমনিতে তিনি প্রায় সারা জীবন অর্শ রোগে কাহিল ছিলেন. ১৯১৩ সালে ইংল্যান্ডে অপারেশন করিও তেমন সাফল্য পাননি. ১৯১৪ সালে কিছুদিনের জন্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়েছিলেন। পরে মানসিক শক্তির জোরে এই দশা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু শেষ জীবনে অতিরিক্ত ঘোরাঘুরির কারনে১৯৩৭ সালে শান্তিনিকেতনে কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়েন। দ্রুত চিকিৎসা য় সুস্থ হলেও এই হত চৈতন্যলোক থেকে তিনি শারীরিক দুর্বল , কানে কম শোনা, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েন। হাতের লেখায় বস থামছে না। প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার, বিধান চন্দ্র রায় তাঁকে বিশ্রামের পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব অস্বীকার করে ১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি কালিম্পং গেলেন. তাঁর স্নেহের পাত্রী মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ী ,সেখানে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কলকাতায় চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে আনা হলো কিন্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরল না। দেখাশোনা করছেন নির্মলকুমারী মহালানাবিশ রানী চন্দ ছোট মেয়ে মীরা দেবী কবির বৌমা প্রতিমা দেবী প্রমুখেরা । কথায় কথায় মজা করার অভ্যাস যার ছিল অসুস্থ অবস্থাতেও সকলের সঙ্গে সেভাবে কাটাচ্ছেন তিনি। ১৯৪১ সালের ১৪এপ্রিল শান্তিনিকেতনে নববর্ষের প্রথম দিন উদযাপন অনুষ্ঠানে অসুস্থ হলেও সভ্যতার সংকট পড়লেন . সারাক্ষণ বসলেন পঁচিশে বৈশাখ পালিত হল ।কবির শেষ জন্মদিন, খুব সাধারণভাবে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার রাজদূত এসে কবিকে "ভারত ভাস্কর" উপাধি প্রদান করেন . প্রচন্ড গরম বাতানুকূল ঘরে থাকলেও কষ্ট পাচ্ছেন শরীর দুর্বল হচ্ছে চোখের দৃষ্টি ক্লান্ত প্রায় জ্বর আসে ডাক্তারের পরামর্শ করে বললেন কবিকে অপারেশন করতে হবে। কবিরাজি চিকিৎসা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আর নয়। ইন্দিরা দেবী জামাই প্রমথ চৌধুরী বুদ্ধদেব বসু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখা করতে এলেন। কয়েকদিন কবিরাজি চিকিৎসা চলছে, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড এর স্থিতি কবিকে কাবু করে দিচ্ছে । অপারেশনের কথা শুনে রানী মহলানবিশ কে বললেন - " দেখো রানী ,আমি কবি সুন্দরের উপাসক বিধাতা আমার এই দেহখানা সুন্দর করেছিলেন এখান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এই দেহখানা তেমনি সুন্দর অবস্থাতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই " । ১০ ই জুলাই কবি র মন খারাপ ।কবিরাজ কমলাকান্ত ঘোষ এলেন সবকিছু দেখে এক মাসের সময় দিলেন। ১৩ ই জুলাই নাতনির জন্মদিন জন্মদিনের দু-চার কথা তিনি লিখলেন আর বললেন আমি কি আর আজকাল লিখতে পারি বিধাতা আমার সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে।
অবশেষে ডাক্তারবাবুদের পরামর্শ অনুসারে তাঁর শরীরে অপারেশন করা হলো ৩০ শে জুলাই।কবির ঘরের পেছনের পূর্বদিকের বারান্দা ঘিরে অপারেশনের ব্যবস্থা হয়েছে। এদিন সকালে কবির মন অনেকটা নির্ভার ছিল তাই মনে মনে কবিতার কয়েকটি লাইন চলে এলো -
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী ।"
অসুস্থ অবস্থায় বৌমাকে একটি পত্র লিখলেন, ..... বাবা মশাই .....সময় সকাল দশটা . একটু পরে ডাক্তার ললিত বাবু কবি র ঘরে এসে কবিকে বললেন- আজ দিনটা ভালো। কবি শুনে চমকে উঠে বললেন আজি। এরপর সকলের দিকে চেয়ে বললেন - তা ভালো। হঠাৎ হয়ে যাওয়া খারাপ কি ! সকাল ১১ টায় স্ট্রেচারে শুয়িয়ে কবিকে অপারেশনের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল. ডাক্তার হিসেবে ললিত বাবু, অমিয় সেন, সত্যসুধা বাবু ছিলেন - বাইরে সবার মধ্যে উদ্বেগ- ডাক্তারবাবুরা বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন - অপারেশন খুব ভালো হয়েছে- শুনে সকলে স্বস্তি পেলেন । বারোটার দিকে কবিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হলো। নিজের খাটে তিনি,পাশের নির্মলকুমারী। কবি ফুঁসে উঠে বললেন - ' মিথ্যে কথা বলেছে, কোনো ব্যথা লাগবেনা বলেছিল কিন্তু আমার খুব কষ্ট লেগেছিলো এত কষ্ট হচ্ছিল যে আমি জোর করে ঠোঁট চেপে চোখ বুজে পড়েছিলাম " বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল। ৩১ শে জুলাই রাতে ভাল ঘুম হয়নি. কবির ব্যথা ও তাপমাত্রা বেড়েছে। ইউরিন কমেছে। তবে জ্ঞান আছে। পহেলা অগাস্ট দুপুর থেকে কষ্ট পাচ্ছেন কবি ।হিক্কা উঠছে। নির্মলকুমারী ছোট এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়ে চার-পাঁচবার দিতে হিক্কা কমলো। অপারেশনের সময় কলকাতায় বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন না । তিনি এলেন ও কবিকে দেখলেন ।রোগীর ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েদের বললেন বাড়ির মেয়ে রা তো কত রকম টোটকা ওষুধ জানেন, কিছু টোটকা হিক্কা কমার জন্য করে দিতে হবে। ৩ রা আগস্ট কবি র অবস্থা সঙ্কটজনক ,কিডনি কাজ করছে না। মাথা অসার। ঝিমিয়ে আছেন । ৪ ঠা অগাস্ট সকালে সামান্য খেয়েছেন , দুই একটা কথা বলেছেন । আচ্ছন্ন। একটু সুস্থ ।বৌমা প্রতিমা দেবী কবির কাছে গেলেন, কবি প্রথমে চিনতে পারেননি। কিডনি ফেল করেছে ৫ ই আগস্ট. একেবারে অচৈতন্য . সকলে ভেঙে পড়েছেন । ৬ ই আগস্ট রাত থেকে স্যালাইন চলছে অবস্থা খুব খারাপ সন্ধ্যেবেলা শান্তিনিকেতনের চিনা ভবনের অধ্যাপক কবির বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজের জপমালা বের করে ইষ্টমন্ত্র জপ করে কবি র মঙ্গল কামনা করলেন। ৭ ই আগস্ট ২২ শ্রাবণ পূর্ব দিকে মাথা রেখে কবি অচৈতন্য হয়ে আছেন রাখি পূর্ণিমা শেষ হতে চলেছে চারিদিকে ঘিরে আছে পরিজন কেউ কবির পায়ে হাত বুলাচ্ছেন কেউ মন্ত্র জপ করছেন কেউ বা তার কানে কানে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করছেন - উপনিষদের মন্ত্র। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে লোক ধরে না। সকালে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী এসেছেন মন্ত্রপাঠ চলছে- তমসো মা জ্যোতির্গময় প্রভৃতি ।শেষ রাত থেকে গাওয়া হচ্ছে ব্রহ্মসংগীত। কবি র জীবন দীপ নির্বাচিত হল দুপুর বারোটা দশ মিনিটে । তিনি পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগর সঙ্গমে বিলীন হয়ে গেলেন। সেবিকারা তাঁর পবিত্র দেহ সাদা ধুতি উত্তরীয় দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। কপালে আঁকা হলো সাদা চন্দনের তিলক গলায় রজনীগন্ধার গেরো চারপাশে রাশি রাশি সাদা পদ্ম সারাঘর ফুলের গন্ধে আমোদিত কবি র মুখমন্ডল প্রশান্ত ভেতরে ঢোকার জন্য বাহির থেকে প্রবল মানুষের ভিড়। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ভেঙে পড়েছেন। প্রশান্ত চন্দ্র অসুস্থ। সামলাবার কেউ নেই । ওখানেই কবিকে দাহ করার সব আয়োজন চলতে লাগল বিকাল তিনটার দিকে হঠাৎ একদল অচেনা লোক জোর করে ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষেই কবির দেহ নিয়ে " জয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জয় , বলে যেতে যেতে পথে বেরিয়ে পড়ে । কলকাতার রাজপথ থেকে লোকে লোকারণ্য এই দৃশ্য দেখে পরে অবনীন্দ্রনাথ একটি ছবি আঁকেন- " জনসমুদ্রে কবির দেহ শ্বেত পদ্ম ফুটে আছে। কবিকে দাহ করার জন্য নিমতলা মহাশ্মশান এ নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু ভিড়ের চাপে পুত্র ওখানে যেতে পারেননি গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে গিয়ে নৌকায় করে রথীন্দ্রনাথ যখন নিমতলা শ্মশান ঘাটে এলেন তখন কবির দাহ শুরু হয়ে গেছে । কবির মুখাগ্নি করেন তার এক নাতি মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ থাকে, পুত্র রথীন্দ্রনাথ মায়ের দাহ ও করতে পারেননি । যখন মহাশ্মশানে কবি র দাহ হচ্ছে, আকাশবাণীতে বসে কবি নজরুল ইসলাম "রবিহারা" কবিতা পাঠ করছেন -
" দুপুরে রোদের কোলে শ্রাবনের মেঘ দোলে দোলে উদাস গগন তলে -। "
বিশ্বে তথ্য ভারতের কবি, বাংলা হৃদয়ের ছবি চলে গেলেন - রেডিওতে নজরুলের কন্ঠে আরেকটি গান প্রচারিত হলো-
" ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবি রে
জাগাইও না জাগাইও না
সারা জীবন যে আলো দিল
ডেকে আর ঘুম ভাঙায়ো না।"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
কবিতায় :
বাইশে শ্রাবণ
কালিদাস ভদ্র
শ্রবণের আকাশ আজ
ঘন মেঘে কালো
সহসা নিভে গেল
উজ্জ্বল রবির আলো।
পাগলা হাওয়ার গান
থেমে গেছে তালদিঘি ঘাটে
ফটিক অমল শুধায় না আর
কোন পথে গেছে তেপান্তরের মাঠে ।
কোপাই এর জল চোখ ছল্ ছল্
জেগে থাকে রাত কত
ছাতিম তলায় আশায় আশায়
মানুষ ঘুরছে কতশত
মরণরে তুহু মম
জীবন বীণায় বাজে
বাইশে শ্রাবণ আসে আর যায়
দাড়াও তুমি নিত্য নতুন সাজে।
কবিতার মতো
কেশব মেট্যা
কোথাও গান নেই। হুম। উল্লাস।
গাছপালা কম কমছে না জঙ্গল
ভেতরে ভেতরে ঝোপঝাড়। বোঝাপড়া।
বিড়াল ঘুরছে । এদিকে ওদিকে।
যারা ঘন্টা বাঁধবে বলে বাড়ি ছেড়ে
বাইরে গেল । তারাও বিড়াল হয়ে ফিরে আসছে ।উঁকি মারছে বাঘের মতো।
কোথাও গান নেই। তাকাতে পারে না ।
কোথাও মানুষ নেই । রবীন্দ্রনাথ ভাবতে পারেন না।
তুমি কি কেবলই...
তাপস বৈদ্য
কল্পতরুর থেকে শুধু নিয়ে যাই অপরিসীম
অনন্ত সম্পদের উৎস কে পণ্যের যোগান হিসেবে
ধরে দেয়াল ঘড়ির মতো নেতিয়ে পার হই সময়
ফেরতের কোন গল্প নেই, শোধ চায় নিজস্ব হৃদয়
শ্রাবণের বর্ষা সাজে দিঘি টলমল
বুঝি না হাসি কি চোখের জল
ব্যথার গভীরে বাঁচে ভালোবাসা আরোও গাঢ় হয়ে
জাগতিক সুখ-দুঃখে গড়ে তুলি অন্ধ কারাগার আলোর ঈশ্বর তুলি মাথায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
কে করবে বিচার তা সহজাত না শুধু আরোপিত পেন্ডুলামীয় চলনে মাতি গতি আবরণ
পচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ।
স্পর্শ
দুরন্ত বিজলী
বিরহমঞ্জুরী বাজতে দূর বিলীন ,
রাঙা চোখে বেদনা টলোমল
নীল স্রোত বনানী প্রান্তর পেরিয়ে আলোর চুম্বন সমুদ্রোজ্জ্বল মুখ ।
দোদুল ঢেউ আনন্দ-উচ্ছল জানালা পথে বিছানায় রাত নামে মসৃণ আঁধার চিরে ফুল ফোটে
রবি ঠাকুরের স্পর্শ
ব্যর্থতায় জেগে ওঠার মন্ত্রধ্বনি মন্ত্র হয়ে বাজে।।
কবি গ্রাম
দেবাশিষ প্রধান
বাঁকা সেই সরু গলি দিয়ে - জল নিয়ে চলে যায় মেয়ে
নীলাকাশের ললাটে তাই কে মাখালো চন্দনের এই সাজ
সবখানেই তোমার আঁকি-বুকি কাঁদছে ভোরে বেগুড়ানের খুকি
দিঘির জলে করছে টলমল কি শোভা বজায় শালুকমল
এসবই তোমার চোখে আঁকা জীবনের পথ শুধুই আঁকাবাঁকা
কবির দেখা এমন ছবির গ্রাম এমন সবুজ সতেজ সম্মান
শুধু সেই আভূমিতল আলু তোমারে কাব্য গানে ভোলায়
আমাদের বই পড়া সেই রাত নির্ভয়ে বলতে পারি গো ঠাকুর
তুমি শুধু আমারই রবীন্দ্রনাথ।।
অনন্ত জীবন
বনশ্রী রায় দাস
ঝরছে শ্রাবণ অঝোর
ঘাটে চাল ধুতে গিয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি
জলে নেই রবি রোদ্দুরের মুখ
একটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট রক্তবর্ণ মুখমণ্ডল
জল তরঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে
নির্লিপ্তর শেষ সিড়ির কাছে
ছোট্ট ছেলেটি হাঁপিয়ে উঠেছে গন্ডির ভিতর ,
আজ কেউ গণ্ডি কাটেনি যাওয়ার পথে
অমৃতের উদ্দেশ্যে নৌক ভাসায় সৌন্দর্যের
ঘুড়ি ......উড়ান ক্রমশ মহাশূন্যে
তাম্রপাত্রে রেখেছি ধান দূর্বা অগুরু চন্দন
মৃত্যুহীন অক্ষয় পুরুষের অনন্ত জীবন মহিমা
সুরলোকে জন্ম হতে জন্মান্তরে।।
বিয়োগী শ্রাবণ
বাণী রঞ্জন দে
দূর সিন্দুর কালো মেঘ এসে
ছেয়ে ফেলে রূঢ়াকাশ
নিত্যদিনের নিরর্থ -আমি
ছুটি দিয়ে গেছে অবশেষে
পেয়ে এই অবকাশ।
ভারী কৃষ্টির অবিরল ধারা
সারাদিন ঝরে যায়
ঝাপসা স্মৃতিরা থেকে থেকে শুধু
প্রতিরোধেহীন দুসরে আঁধারে
ধুয়ে দেয় ভেসে চলে --
পড়ে থাকে কোন বাষ্পের ঘোর
চোখের আড়ালে সুদৃঢ় চক্ররেখায়
হঠাৎ ক্ষতির কোনো শেষ লেখা
যেন প্রবাহিত হতে চায়
কত সৃষ্টির কত ঘটনার
রূপকথা আঁকা সে দিনের তারা
কোনো না-পাওয়া মাথায়
আকাশে নিমেষ হারিয
কী করুন অসহায়।
সুরহারা গানের শূন্যতা তারা
বুকের ভেতর দিয়ে গেছে ভরে
তাই ঘরে ও বাহিরে ঘনবর্ষণ
ভেজায় উঠোন খুঁজে
থেকে থেকে কথা পাতায় পাতায়
টলমল ভারে ফোঁটা পড়ে পড়ে
টুপ্ টুপ টুপ মূক জানালায়।।
যা হারিয়ে যায়
বিকাশ চন্দ
নিজের ভেতর নিহিত আলোর উৎস
সবেতেই ঋদ্ধ যত মৌল অনুভব
অমৃত সত্য সব কাগজে-কলমে ভাস্বর,
স্বর্গ থেকেও নেমে আসে প্রতিদিন উপহার
কাগজে-কলমে প্রতিদিন জনম নেয় অক্ষর কথা
অবাক চোখে তাকালে ভরে যায় শূন্যতা
রোদের কিরণে মখমলে ঢেকে যায় রবির কর ।
সিন্ধুর ও বেদনা আগলে বুকে বিন্দু বিন্দু জল অরুণের ঘরে আরও তরুণতর এখন নিত্য অবসর পূর্ণ্যবতি স্রোত জানে অজস্র অক্ষর শব্দ ধারা
মানুষের কারিগর জানে তারও ঘরে আজীবন শুরু
শব্দ ভেজা ঋণ আকণ্ঠ ঋণী অপ্রতিশোধ্য খেলায় কোনো বেলায় নিভৃতে যদি স্পর্শে আসে ছোঁয়া
ঋদ্ধ শরীর জেগে আছে বুকে মায়াবী আড়ালের হাসি
ঘাম রক্ত কান্নার ঋণে স্মৃতিময় অন্ধকার হায় এখনো আগলে আছি আর না হারিয়ে যায়।।
বাইশে, অজানা জগতে
বিশ্বজিৎ রায়
বাইশ, মানেই শুধু কবিগুরু নন
মনে পড়ে আরো অনেক কবি জীবন
কালের নিয়মে যারা রেখে গেলে কাগজ-কলম
এই মাটির পৃথিবী ছেড়ে
অনেক দূরে অজানা জগতে
তাদের জন্যেও ঝর ঝর বাজে বাইশে শ্রাবণ
সেই অজানা জগতে অদ্ভুত আঁধার নেমে এলে ট্রাম রাস্তা ধরে বেরিয়ে পড়েন এক কবি
বৃষ্টিদিনে তুমুল তর্কে মাতেন
বিষ্ণু প্রেমে -নবারুণ- সুভাষ ও তিন গানের কবি বড়দের আড়াল করে মৌজাতে বসেন
তুষার তারাপদ সুনীল শক্তি একটু দূরে ও অনিতেশ ও রবি....
মেয়েদের অধিকার নিয়ে সেমিনারে বলতে চান রাজলক্ষ্মী মহাশ্বেতা মল্লিকা ও কবিতা সিংহ নেশার ঘোরে শক্তি অমিতাভকে বলেন- তুই ব্যাটা লিখিস শ্লোগান
এদের নিয়ে রাগিয়ে কড়চা কালীপ্রসন্ন সিংহ
নজরুলের গান শুনে মুগ্ধ হন দত্ত মধুসূদন
অজানা জগতে ওরা সবাই কবি কে ঘিরে থাকেন বাইশে শ্রাবণ।
বাইশে শ্রাবণ
মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়
আমরা জেনেছি আজ কি আছে কি নেই
পথ নিরিবিলি সবচুপ
শ্রাবণ তোমার স্তব্ধ চোখে কোন সময় এল
কোন সত্যি মুখ ফেরালে?
আকাশ ঈগল ছায়া দুঃস্বপ্ন যেমন
এই কি মৃত্যুর স্বর ঢেকে দেয় মেঘ গান
চিহ্ন জুড়ে রবিচ্ছায়া ঘুমোক শহর
রৌদ্র রশ্মি জ্বেলে দিই তোমার পায়ের নিচে
কেঁপে উঠি যেই মনে পড়ে তুমি নেই
চেয়ে দেখো শিথিল বায়ুতে বাইশে শ্রাবণ
প্রেম ও পূজার।।
পাওয়া
শ্রুতি নাথ চক্রবর্তী
বাইরে আমার পথ গিয়েছে হাজার দিকে
ভিতরজুড়ে একটিই পথ তোমার পানে
তারই ধারে একতারাতে লক্ষ জীবন
কাটিয়ে দেবো তোমায় পাওয়ার গানে গানে
সব চাওয়ারা সব না - পাওয়ার কাছে এসে
কাঁদবে যখন তখন বুকের পাজর ছুঁয়ে
ভৈরবীতে ভিড় দেবে সব তারার আলো
সব না -পাওয়া উঠবে পাওয়ার সুধা হয়ে।।
এক পরবাসে
সুশান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
আমাদের পঁচিশে বৈশাখ আছে
বাইশে শ্রাবণ নেই
হেমন্তের রামধনু আছে
চণ্ডালের ধর্মশোক আছে
সন্ধের শঙ্খধ্বনি আছে
বাইশে শ্রাবণ নেই
বড় দিন আছে
পহেলা বৈশাখ এবং পহেলা জানুয়ারি আছে মাঙ্গলিক রাত্রি ধ্বনি
অথবা কোরাস মিউজিক আছে
শুধু
বাইশে শ্রাবণ নেই
ছন্নছাড়া এ সময় বেঁচে আছে
নিছক উল্লাসে
এক পরবাসে
আর জলের মর্মর ধ্বনি শোনা যায় না।।
জেগে আছো
সোমনাথ রায়
গ্রীষ্ম জন্ম আর মৃত্যুর শ্রাবণ ধারায়
প্রখর উত্তাপ সয়ে রেখে গ্যাছো অবিরাম তৃষ্ণা শত বছরের ঘুম নিয়ে জেগে আছো
আজও পৃথিবীর চোখে সুখে-দুঃখে নম্র প্রতিবাদে তোমার ওপরে তবু ও অভাগারা কাঁচি নিয়ে আসে এই দেশে, শিশুদের দুনিয়ায় বন্দনার জাতীয়তাবোধে
জানিনা কোথায় কবে এর অবসান
শুধু জানি এই শ্রাবণের পরে এসে যাবে আবার বৈশাখ
নতুন প্রজন্ম মুছে দেবে হিংসা, মিলনের গানে।।
রবীন্দ্রনাথ আর শৈলেনবাবু
অমিত কাশ্যপ
শৈলেনবাবু এখন একটা শীর্ণ নদী
অশীতিপর, ধুতি-পাঞ্জাবি তে পরিপাটি যদিও
এখন হারমোনিয়াম নেই
থাকলেও অজস্র স্মৃতির চাদরে ঢাকা
তিনি নিজে নিজেই রেওয়াজ করেন
প্রভাত খুলে যায়, খোলা প্রভাতে বাগানে ঘোরেন
প্রাতঃভ্রমণ গলায় থাকে....
তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে
শৈলেনবাবুর এখন রোজই
পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment