¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বীরবল প্রমথ চৌধুরী
সন্তু কুমার মাইতি
স্নাতকোত্তর বাংলা
, মেধাবী ছাত্র
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
Doinik Sabder Methopath
Vol -92. Dt - 07.08.2020
২২ শ্রাবণ, ১৪২৭. শুক্রবার
=================================
( ০৭.০৮.১৮৬৮- ০২.০৯.১৯৪৬)
পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার অন্তর্গত হরিপুর গ্রাম। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ও মাতা মগ্নময়ী দেবী। জমিদার পরিবারের এই সন্তান যেমন মেধাবী ছিলেন তেমনি মন ও মননে মেজাজী। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাই ।রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩ - ১৯৬০) সঙ্গে শুভ পরিণয় । সেই সূত্রে তিনি ঠাকুর বাড়ির জামাই। জন্ম ৭ই আগস্ট ১৮৬৮. পড়াশোনা করেছেন কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং পরে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক স্তরে দর্শন বিভাগে পাস করে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর হন ।পরে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে যান। ব্যারিস্টারি পাস করে এসে চাকুরী না গ্রহণ করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন । জীবনের বেশ কিছুদিন তিনি আইনজীবীও ছিলেন। অধ্যাপক কবি প্রাবন্ধিক দক্ষ সম্পাদক ,এই প্রমথ চৌধুরী তাঁর শ্রেষ্ঠ জীবন কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে" জগত্তারিণী " পুরস্কার লাভ করেন। ২ রা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ সালে তিনি মারা যান।
বাংলা গদ্য সাহিত্যে, প্রমথ চৌধুরী প্রাবন্ধিক ভাষা শিল্পী ও ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক হিসেবে যেমন স্মরণীয় তেমনি সবুজপত্র সম্পাদক হিসেবেও তাঁর কৃতিত্ব মহাকালের আধরে সুরক্ষিত । যে মুখের ভাষা বা কথা হুতোম বা স্বামী বিবেকানন্দ প্রচলন করেছিলেন সাহিত্যে, বীরবল তাকেই প্রাণ দিয়েছিলেন। আর এই প্রাণ প্রতিষ্ঠার মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল শব্দ নিয়ে খেলার অদ্ভুত ঝোঁক সবচেয়ে কম কথায় সবচেয়ে গভীর বিষয় ভাব ভাবনা প্রকাশ করার অনায়াস নিপুণতা ।হালকা চালে নিরস্ত্র তথ্যে প্রসন্ন উপস্থাপনা রঙ্গ মুখরতা সৃষ্টি, সাধু রীতির কৃত্রিমতা, আড়ষ্ঠতা থেকে সাহিত্যিক গদ্য কে মুক্তি দিতে তিনি চলিত ভাষারীতির পক্ষে শুধু জোরদার সাওয়ালি করেননি, নিজে লিখেছেন ও। মুখের কথায় ও লেখার গদ্যের মধ্যে সাধ্য সাধন প্রতিষ্ঠা করেছেন ।সাহিত্যিক গদ্যের চলিত রীতির সর্বাত্মক সাফল্য এনেছেন। পাশাপাশি এ ও প্রমাণ করেছেন চলিত গদ্য মানে আখড়ার বুলি নয়, তার সৃষ্ট মনের মৌখিক ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্যের সমন্বয়ে গড়ে তোলা শিল্পরূপ। চলিত রীতির মধ্যে যে ভাষার সম্পন্ন শক্তিকে আত্মস্থ করা যায়, তার যথাযথ তাৎপর্য ব্যবহার। এমনকি মুখের ভাষার একেবারে জীবন্ত উত্তপ্ত চঞ্চলতা টুকু ধরে রাখা সম্ভব । সম্ভব ব্যক্তিত্বের ও উষ্ণতার স্পর্শ লাভ। তা তিনি প্রমাণিত করেছেন নিজের লেখনশৈলী মধ্য দিয়ে। সবুজ পত্র রচনা সাহায্যেও আপন মেজাজের বুদ্ধিদীপ্ত যোগ্যতা অর্জন করেন। মৌলিক ঝকঝকে ভাষায় তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন সমকালের শুধু নয় বর্তমান চলিত রীতির এক প্রতিষ্ঠান। চলিত ভাষার আমদানিও ব্যবহার প্রসঙ্গে তাঁর রসসিক্ত মন্তব্য - " ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে। কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়। "আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য - "ইস্পাতের ছুরি "বলে অভিহিত করেছিলেন।আসলে তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও জ্ঞান তাঁর রচনাকে এমনতর করে তুলেছিল।
প্রথম চৌধুরীর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে -
কাব্যগ্রন্থ:
সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯) ও পদচারণ (১৯২০);
গল্পগ্রন্থ:
চার ইয়ারি কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯), ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭), নীল লোহিত (১৯৩৯), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯), সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪), দুই বা এক (১৯৪০);
প্রবন্ধগ্রন্থ:
তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), নানাকথা (১৯১১), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), দুই ইয়ারির কথা (১৯২১), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০) এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৫২-১৯৫৩)।
সম্পাদনা :
সবুজপত্র ( ২৫ শেষ বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দ)
ছদ্মনাম - বীরবল।
সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব বীরবল থাকলেও রবীন্দ্র প্রেরণা অন্তরালে ছিল তা বোঝা যায়। সবুজপত্র সবুজপত্র নয় তারুণ্যের জয়গানে ছিল মুখর। কুপমন্ডুকতা নয় আন্তর্জাতিকতা ,ভাবালুতা নয় যুক্তিবাদ, আবেগ সর্বসতা নয় মননশীলতা সাহিত্যের গদ্যের বাহন হিসেবে, সাধুরীতি নয় চলিত রীতি কেবল সাহিত্য নয় ইতিহাস দর্শন অর্থনীতি অলঙ্কারশাস্ত্র রাষ্ট্রনীতি সমাজতত্ত্ব এসব নিয়ে সবুজপত্রে বুদ্ধির মুক্তি ঘটেছে। এখানে সমবেত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমথ চৌধুরী ছাড়াও অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব , মনীষার মণি- মাণিক্য। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন - " সব্যসাচী প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র তাঁর গান্ডীব। আর সবুজ সভার সভ্যরা পাণ্ডব সেনার দল।"
বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী ফারসি ছোটগল্পের আঙ্গিক রীতিকে প্রথম পরিচিত করিয়েছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত। বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব ধারায় সনেট রচনাও করেছেন। বাংলা সাহিত্যে ‘চুটকি’ সাহিত্যের প্রচার, প্রসার, বাগ্বৈদগ্ধ্য ও সুনিপুণ বিন্যাসে, চুটকির নতুনত্বে প্রমথ চৌধুরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহিত্যে সত্য অন্বেষণ ও চর্চা ছিল যেন তাঁর জীবনের ব্রত। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রমথ চৌধুরীর ভাষাদর্শের সঙ্গে সাহিত্যাদর্শের দ্বন্দ্ব ছিল। ভাষাদর্শে তিনি বিপ্লবী ও অগ্রবর্তী। কিন্তু সাহিত্যাদর্শে তিনি অতীতচারী গ্রিক, রোমান ও সংস্কৃত সাহিত্যাদর্শের উত্তরাধিকারী। তবে সাহিত্যাদর্শে তিনি প্রাণের, তারুণ্যের, যৌবনের উপাসক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের উপাসক, সামাজিক মিথ্যার শত্রু, সৌন্দর্যের ভক্ত, সাহিত্যে স্বতন্ত্র মর্যাদার সমর্থক এবং সব ধরনের নীতিশাস্ত্রের বিরোধী। বস্তুত বাংলা সাহিত্যে তিনি মানসিক যৌবনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হোক, যে প্রাণ সব বাসনামুক্ত, যে প্রাণ নিজের পথ সৃষ্টি করে নেয়।
প্রথম চৌধুরী ছিলেন একজন সত্যিকারের ভাষা শিল্পী। ভাষা নিয়ে সাহিত্য সাধনা তাঁর কাছে জীবন সাধনার নামান্তর। তিনি মনে করেন, মানব মনে দুটি আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। একটি জীবন ধারণের আকাঙ্ক্ষা, অন্যটি আত্মধারণের ও আত্মবিস্মৃতির। এ দুটির সমন্বয়েই সৃষ্টিশীল সাহিত্য সৃষ্টি হয়। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানবজীবনে যৌবনই সৃজনশীল। ব্যক্তিগত জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও জাতির সমষ্টিগত জীবনপ্রবাহে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারলে মানসিক জীবন বিনাশের আশঙ্কা থাকে না। তিনি তাঁর প্রায় রচনাতেই উল্লেখ করতেন, ‘আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও কাজে ঐক্য করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়।’ তাঁর সবগুলো রচনা বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর কথা ও কর্মের সংগতি স্পষ্ট দেখতে পাই।
No comments:
Post a Comment