¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥
Doinik Sabder Methopath
Vol - 90. Dt - 05.8.2020
২০ শ্রাবণ,১৪২৭.বুধবার
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
মহানির্বাণের অস্তরাগ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ড.সুবিমল মিশ্র
প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও চিত্রশালাধ্যক্ষ
বাংলার জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট মহীরুহ। তাঁর লোকোত্তর প্রতিভা একটি পূর্ণ শতাব্দীকে ধরে রেখেছে । তাঁর সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত কাজ এবং সমস্ত অনুভূতি সেখান থেকে রস সংগ্রহ করে অনন্তের ঊর্ধ্বলোকে পাতা মেলেছে।
বাংলার একান্ত নিজস্ব কবি , আজ বিশ্বকবি ।
গীতায় বলা হয়েছে - " জাতস্যাই ধ্রুবোন্মৃতু ধ্রবং জন্ম মৃতস্য চ " অর্থাৎ শরীর ধারণ করলেই তার ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী । গীতার মৃত্যু সম্বন্ধে জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ তত্ত্বও রবীন্দ্রচিত্তকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। মায়ের মৃত্যু বিদায়, জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন -
" প্রভাতে উঠিয়া মা'র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম (১০.০৩.১৮৭৫) তখনো সে কথাটাই সম্পূর্ণ
অর্থ গ্রহণ করিতে পারিলাম না । -
সেদিন প্রভাতে আলোকে মৃত্যুর যে রূপ
দেখিলাম তাহা সুখদ্যুতির মতোই প্রশান্ত
ও মনোহর।' "
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী, ভাতৃজায়া কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কবিকে গভীরভাবে শোকাহত করেছিল। কিন্তু সে শোকেও তিনি উদার শান্তি লাভ করেছিলেন । কবির এই সময়কার উপলব্ধির কথা , অনুভবের কথা তাঁর দার্শনিক চেতনায় কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল , তা উল্লেখ করা যেতে পারে -
" এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা
পাইলাম তেমনি সেই ক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি লাভ করিলাম। জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য দূরত্বের প্রয়োজন, মৃত্যু
সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়েছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের যে ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তা বড় মনোহর।"
মাত্র ৪১ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীকে হারিয়েছেন। তারপর একে একে কন্যা - পুত্র -জামাতা - পিতাকে হারিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে ভয়ঙ্কর ছিল না। দার্শনিক স্নিগ্ধতায় ছিল পূর্ণ। একটি গানে তিনি লিখেছেন -
" যদি মৃত্যু নিকট হয়, তবু নাহি ভয়, নাহি ভয় ।জন্ম জয় ব্রম্ভের জয়।
আনন্দ চিত্ত মানে আনন্দ সর্বকাজে
আনন্দ সর্বকালে দুঃখ-বিপদ জানে
আনন্দ সর্বলোক মৃত্যু বিরহে শোকে
জয় জয় আনন্দময়। "
উপনিষদের ভাবলোক থেকে কবি আহরণ করেছিলেন - আনন্দ উপলব্ধি . তাই তাঁর দুঃখ-শোক , মৃত্যু , বেদনার অনুভবের মধ্যেই নিহিত থাকে আনন্দের ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে মৃত্যু যখন উপনীত হয় কবি র জীবন প্রান্তে, সেসময় কবি কিভাবে ধীরে ধীরে দুঃসহ বেদনাকে আত্মস্থ করেছিলেন - তা আমরা দেখব।
১৯৪০ এর আগস্ট থেকে ১৯৪১ এর ৭ ই আগস্ট পর্যন্ত কবি কম-বেশি এক বছর বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ১৯৪০ এর আগস্ট মাস। শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গলের আয়োজন শুরু হল ।পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী তখন কালিম্পং। তাঁকে কবি একটি পত্র লিখলেন -
বৌমা,
তোমাদের বাড়িটা দেখি শূণ্য হাঁ হাঁ
করছে; না আছো তুমি না আছে রথীন - প্রধান ব্যক্তি যে আছে সে হচ্ছে নাথু -
আজ রাত্রে দেবতা যদি প্রসন্ন থাকেন তাহলে গ্রন্থাগারে প্রাঙ্গণে বর্ষামঙ্গল হবে । সকালে বৃক্ষরোপণ হয়ে গেছে। আমার শরীরে ভালো-মন্দর জোয়ার-ভাটা চলছিল। সম্প্রতি ভালো আছি .....
...... বাবামশায় ।
২৫ শে সেপ্টেম্বর কবি কালিম্পং-এ। ২৬ শে সেপ্টেম্বর আবার শরীর খারাপ হল। সেদিন মৈত্রেয়ী দেবী শহর থেকে এলেন । তাঁকে শোনালেন কবিতা এবং তাঁর নতুন লেখা পাণ্ডুলিপি "ল্যাবরেটরী " গল্পের পাণ্ডুলিপি পড়ে নিতে বললেন । কবিকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানালেন তিনি কিডনির অসুখ" য়ুরিমিয়া" তে আক্রান্ত। ২৭ শে সেপ্টেম্বর দার্জিলিং থেকে সাহেব ডাক্তার এলেন। ভেতরে ভেতরে বিষক্রিয়ার জন্য মাঝেমাঝে অচেতন হয়ে পড়ছেন। ২৮ শে সেপ্টেম্বর কলকাতার তিন ডাক্তারের দল কালিম্পং এ পৌছলেন. তাঁরা হলেন জ্যোতিবাবু , অমিয়বাবু ও সত্যসখাবাবু। এলেন মীরা দেবী ও । সিদ্ধান্ত হল কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার। কলকাতায় এলেন কবি।
আটজন ডাক্তার মিলে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠিত হল এবং সেবা কর্মের জন্য নন্দিতা কৃপালিনী , অমিতা ঠাকুর, রানী মহালানবিশ, মৈত্রেয়ী দেবী ও রানী চন্দ প্রমুখরা।
পুজো সংখ্যা "আনন্দবাজার পত্রিকা" তাঁর বিখ্যাত গল্প ' ল্যাবরেটরী 'প্রকাশিত হল। ১৯৪০ এর অক্টোবর-নভেম্বর এ তিনি কলকাতায় রইলেন . শরীর মোটামুটি চলছে। ১৯৪১ এর মে পর্যন্ত প্রায় একই রকম।
৩০ শে জুলাই কবির দেহে হল অস্ত্রোপাচার । জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে কবিকে দেখতে এলেন । অপারেশনের পরদিন- ৩১ শে জুলাই , ১৯৪১ কবির অবস্থা গুরুতর অবনতি হলো। পরে কিছুটা স্থিতিশীল, কবি তরল খাদ্য গ্রহণ করলেন। ৩ আগষ্ট রবিবার ও ৪ আগষ্ট সোমবার অবস্থা আরও সঙ্কটজনক হয়ে উঠলো। ৫ আগষ্ট অবস্থা অপরিবর্তিত থাকল। কবি কোমায় চলে গেলেন।সবই বুঝতে পারলেন বিদায় লগ্ন সমাগত সেই সময়টার অবস্থা প্রতিমা দেবী এভাবে বর্ণনা করেছেন -
" আজ শ্রাবণ পূর্ণিমার রাত। আকাশ স্তব্ধ , রাখিবন্ধনের লগ্ন। সন্ধ্যা থেকেই সকলে জানতো আজকে তাঁর জীবন সংশয় - সুধাকান্ত কবি ও রানী এসে বললে," বৌদি চলুন' । বুঝলাম কেন এ ডাক ! কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই। পা যেন আর সরে না। তাদের সঙ্গে চলে গেলুম ঘরের দিকে, বুঝলাম মহাপুরুষ আজ মহাপ্রয়াণর পথে...... যে মৃত্যুকে তিনি শত বৃহৎ পরে কত গভীর করে অনুভব করেছেন , আজ তারই সঙ্গে মিলনের দিন এসেছে এগিয়ে ..... তাঁর শেষ নিঃশ্বাস কমে এসে থামল। সকলের মনের মধ্যে মুহূর্তের জন্য অসীমের অনুভূতি নিবিড় রূপ নিলো । বৃহস্পতিবার ৭ আগষ্ট ১২ টা ১০ মিনিটে গুরুদেবের নির্লিপ্ত আত্মা দেহবন্ধন থেকে মুক্তি পেল।
পরাদিন 'আনন্দবাজার পত্রিকা' র ( ২৩ শে শ্রাবণ শুক্রবার) সম্পাদকীয়তে লেখা হলো ..
" জানি এই পৃথিবীতে কাহাকেও অনন্তকাল ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই তথাপি অর্ধ শতাব্দী ও ঊর্ধ্ব কাল এই জাতি যাহার জীবনে, জীবন লাভ করিয়াছে, যাহার কাছে আশা, আনন্দ ও গান শুনিয়াছে, যাহার জীবনের সঙ্গে জাতির জীবন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, তাঁহার তিরোভাবের সংবাদ মুহূর্তমধ্যে দেশের উপর শোকের গভীর ছায়া ঘনায় আসিয়াছে। তাঁহার অভাবে বাঙালির চিত্তে যে সিংহাসন শূন্য হইল তাহা পূর্ণ হইবার সম্ভাবনা কোথায় ? ..... হতভাগ্য জাতির বহু ভাগ্যে এই অভ্রভেদী ব্যক্তিত্বের আবির্ভূত হইয়াছিল। এই সৌম্যকান্তি আনত নেত্র আঁখি আর কোথাও দেখা যাইবে না। হয়তো স্বদেশের কল্যানের জন্য যেখানে যে কর্মের সূচনা তিনি করিয়া গিয়াছেন, কালক্রমে তাহাও একদিন ম্লান হইয়া পড়িবে। কিন্তু তাঁহার সাহিত অনন্তকালের বক্ষে অক্ষয় হইয়া থাকিবে ।কবি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু নাই."
------------------০০০০০----------------
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment