শেষলেখা : মৃত্যুচেতনা এক দিকদর্শন
গৌতম ভট্টাচার্য
কবি ও প্রাবন্ধিক
¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶
Doinik Sabder Methopath
Vol -91. Dt - 06.08.2020
২১ শ্রাবণ, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
£££££££££££££££££££££££££££££££
মৃত্যুর আগে সজ্ঞান অবস্থায় থাকাকালে মানুষ চায় প্রিয়জনদের দেখতে; শেষ কথা বলতে। এই শেষ কথা ক'টি বিবেচনায় যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেটাই বলার চেষ্টা করে . সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে তা হয় বৈষয়িক বা পারিবারিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো সাধারন মানুষ ছিলেন না , তাঁর মর্মে- মজ্জায় ছিল কাব্য । তাই তাঁর শেষ কথা কোনও বৈষয়িক মা পারিবারিক ছিলনা। তাাঁর শেষ কথায় থাকবে তত্ত্ব, জীবন সাধনার পরম উপলব্ধি বা প্রত্যয়। তাাঁর শেষ কথা ছিল কবিতা -
" তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে "
( তোমার সৃষ্টির পথ ৩০জুলাই,১৯৪১) যার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন উপলব্ধিই প্রকাশ ঘটে।
মৃত্যু সম্পর্কে অধিকাংশ ভারতীয় দর্শন যে ধারণা ব্যক্ত করেছে রবীন্দ্রনাথ ও নিজেপথে সেই সত্যে উপনীত হয়েছেন। তা এই যে, দৃশ্যত: মৃত্যু আছে - কার্যত নেই। আমরা রূপ রূপান্তর এবং জন্ম-জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে চলেছি। মৃত্যুর মধ্যেই একটা জীবনের পূর্ণতা এবং এইভাবে নানা রূপের মধ্য দিয়ে আমরা পরিনামের পথে এগিয়ে চলেছি । সুতরাং মৃত্যুভয় অকর্তব্য ।রবীন্দ্রনাথের জীবনের উপনিষদের প্রভাব কত খানি তা তাঁর রচনা, দর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা আমরা হয়তো বা উপলব্ধি করতে পারি কিন্তু গ্রহণ করতে পারিনা।
উত্তাল ঢেউয়ের মতো মৃত্যুশোক একের পর এক আছড়ে পড়েছে কবি হৃদয়েরবেলাভূমি তে । মায়ের মৃত্যু (১৮৭৫), কাদম্বরী দেবী(১৮৮৪), মৃণালিনী দেবী (১৯০২), মেজো মেয়ে রেনুকা (১৯০৩), পিতা (১৯০৫) ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ (১৯০৭) বড় মেয়ে মাধুরীলতা (১৯১৮) এছাড়া কবিকে বুক পেতে সহ্য করতে হয়েছে আরো অনেক আত্মীয়-স্বজন বন্ধু প্রিয়জনদের বিচ্ছেদ বেদনা । শমীর মৃত্যুর পরের দিন রাতে ট্রেনে আসতে আসতে কবি দেখেছিলেন-
" জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে। কোথাও কিছু কম পড়ছে তার লক্ষণ নেই "।
তিনি উপলব্ধি করলেন -" সমস্তের মধ্যে সব রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে । সমস্তের জন্য আমারও কাজ বাকি রইল।" এই গভীর উপলব্ধি থেকে আমরা বুঝতে পারি সাংসারিক সমস্যা সংকট ব্যাধি মৃত্যু শোক কবির একান্ত ব্যক্তিগত। এসবে মন অসাড় হয় না। কোনো আঘাতে তাঁকে বাইরে থেকে কাতর বা বিচলিত হতে দেখা যায় না । জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় - " তিনি জানতেন - সংসার কর্মভূমি , কর্তব্যস্থান তার অফুরন্ত চাহিদা তাঁকেই পূরণ করতে হবে।"
রবীন্দ্রনাথ " মৃত্যুঞ্জয়" কবিতা লিখেছিলেন -
' আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়
এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে । '
তিনি যে শুধু কবিতা লিখেছিলেন তা নয়, তিনি মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুকে যে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন , একটি ঘটনার উল্লেখ করলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কবির বৈঠকখানায় বঙ্গভঙ্গর আশঙ্কা এবং প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা সভা বসেছে ।বড় বড় নেতা কবি-সাহিত্যিকেরা এসেছেন সভায় । কত চিন্তাভাবনা আলাপ-আলোচনা এবং পরিকল্পনা। রাত্রিতে সভা শেষ হলো। সকলে বিদায় জানানোর জন্য কবি প্রস্তুত । কবি দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন । রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জিজ্ঞাসা করলেন - ' রবিবাবু আজ আপনার মেয়ে কেমন আছে ? একটু ভালো । কবি শান্ত ভাবে বললেন - ' সে আজ দুপুর বেলা মারা গেছে।" প্রাণাধিক কন্যার মৃত্যু শোক অতিক্রম করে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা করা যে কবির প্রাণান্তকর সংযমের কি চূড়ান্ত নিদর্শন তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
'শেষলেখা 'কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার অংশিক উল্লেখ করা হলো :
এক : সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম ----
সে কখনো করে না বঞ্চনা
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবনে
সত্যের দারুন মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে ।
(রূপনারায়ণের কুলে, ১৩মে, ১৯৪১ )
দুই :
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় ----
কে তুমি ?
পেল না উত্তর ।
( প্রথম দিনের সূর্য, ২৭ জুলাই, ১৯৪১)
তিন :
দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে,
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু --
কষ্টের বিকৃত ভান ,লাশের বিকট ভঙ্গি যত
অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা তাহার
শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি - মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে ।
(দুঃখের আঁধার রাত্রি, ২৯জুলাই, ১৯৪১)
চার :
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
( পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে)
লোকান্তরিত হওয়ার স্বল্প কয়েকদিন পূর্ব পর্যন্ত এবং প্রাক মুহুর্তে যে মৃত্যু ভয় নেই একথাটি স্পষ্ট হয়েছে । বরং 'প্রথম দিনের সূর্য ' কবিতায় সন্ধ্যার অনুষঙ্গে উত্তর না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যুবরণের মানসিক প্রস্তুতি প্রতিফলিত হয়েছে । তাঁর কবি মানসকে সাধারণের গোচরে এনেছেন এবং তাঁর পরিণতি প্রতিভার দার্শনিক সুলভ উপলব্ধি ও শেষ পর্যন্ত বিবৃত করে এসেছেন যার সংক্ষেপ করলে এইভাবে বলা যায় যে -
" সৃষ্টি সত্য ,জীবন সত্য, মানুষ অধিকতর সত্য।" কারণ দুঃখের মূল্যে এবং ত্যাগময় সামাজিক সামঞ্জস্য স্থাপনে তাঁর আত্মলাভ রূপ চরম প্রাপ্তি ঘটে। ' রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠিলাম ; জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়' শেষ রচনার দুটিতে ও তেমনি সৃষ্টির অন্তরে যে একটি বিশেষ নৈসর্গিক ও মানবিক শক্তির লীলা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, দুঃখ ও সুখ, আঘাতও আনন্দ সমানভাবে যার দান , তাক সম্যকরূপে স্বীকার ও বরণ করেই মুক্তির আনন্দ লাভ করা যায়।
অরূপানুভূতির পর্যায়ে উপলব্ধ এই সত্যটি বিচিত্রভাবে কবি শেষপর্যন্ত অনুসরণ করেছেন। এই কাব্য দার্শনিক উপলব্ধির পূর্বসূত্ররূপে কবির সুগভীর মর্মপ্রীতি , মানবপ্রীতি ও সমাজ জীবনের মূল্যবোধ গ্রন্থিত। জীবনের মাঝে পূর্ণের স্বরূপ সন্ধান না করে বা অসীম হতে বিমুর্ত হয়ে সীমার মাঝে অন্তর গ্লানি আর দুঃখের ভার নিয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুরই নামান্তর বলে কবি মনে করেন ।জীবনের মলিন অস্তিত্বকে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি একাধারে মহাজীবন হে মহামরণ শরণ নিতে চান । কবির ভাষায় - " সে যে জগতের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত নয়, তার যে একটি স্বকীয় প্রতিষ্ঠা আছে। মৃত্যুর শিক্ষায় ওই কথাটি অনুভব করতে পারলুম। ..... যে ব্যক্তি চিরজীবন ওই আমার ওপরই সমস্ত জিনিসের প্রতিষ্ঠা করতে চায় ; সেই বালির ওপরে ঘর বাঁধে । মৃত্যু যখন ঠেলা দেয় তখন সমস্তই ধুলায় পড়ে ধুলিস্যাৎ হয়। আমি বলে যে কাঙ্গাল টা সব জিনিসকেই মুঠোর মধ্যে পেতে চায়, মৃত্যু কেবল তাকেই ফাঁকি দেয় ; তখন সে মনের খেদে সমস্ত সংসারকেই ফাঁকি বলে ভাবে কিন্তু সংসার যেমন তেমনই থেকে যায় , মৃত্যু তার গায়ে আঁচড়টি কাটতে পারে না। যেখানে অহম্ সেইখানেই কেবল মৃত্যুর হাত পড়ে, আর কোথাও না।""
অহম্ = মৃত্যু = ছোট আমি
সংসার = সত্য = বড় আমি
কবির মৃত্যুচেতনা থেকে দিকদর্শন হলো এইযে , স্বার্থপরতা, জড়তা, ভীরুতর জীর্ণ জীবনের বোঝা বহন মৃত্যুর নামান্তর । সীমার বাঁধন ছিড়ে বহুর মাঝে আপনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য , মানব
কল্যাণে সংসারকে যথাসাধ্য দান করার জন্য তথা নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে নিঃশেষে নিবেদন করার ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে কবির মৃত্যুচেতনায় ।কবি বহুবার ছোট আমি থেকে বড় আমি হয়ে ওঠার সাধনার কথা বলেছেন। অসীমকে সীমার মধ্যে উপলব্ধির কথা বলেছেন । তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেখানে অহং সেখানেই কেবল মৃত্যুর হাত পড়ে আর কোথাও না। ---
সংসারকে দিলেই সত্যকে দেওয়া হবে। অহম্ কে দিলে মৃত্যুকে দেওয়া হবে। সংসার কে যা দেবো তা সংসার রাখবে। অহম্ কে যা দেব অহম্ শত চেষ্টাতেও রাখতে পারবেনা। কালজয়ী বিপুল সাহিত্য রচনা ও মানবকল্যাণকর নানা ধরনের কর্মযজ্ঞে আজীবন মগ্ন থেকে দান করেছেন সংসারকে। এই নিত্য ফলে ভাগ বসাতে পারবে না মৃত্যু।
বছর মাঝে আমি = জীবন = মানবকল্যাণে নিঃস্বার্থ নিবেদন
দুঃখ + মৃত্যু =জীবন = জীবনের মাঝে পূর্ণের স্বরূপ সন্ধান
জীবন - মৃত্যু নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ
জীবন ও মৃত্যু নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। মৃত্যুতেই যেহেতু এক জীবনের পরিপূর্ণতা, সেইহেতু মৃত্যু বরণীয়, বর্জনীয় নয়। মৃত্যুই মানবীয় দুঃখের চরম রূপ। দুঃখ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনকে পেতে হবে । তাই তিনি স্পষ্টাক্ষরে লিখতে পারেন -
" অনায়াসে যে পেয়েছে ছলনা সহিতে
যে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার। ""
No comments:
Post a Comment