জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
প্রেমেন্দ্র মিত্র
( ০৪.৯.১৯০৪ - ০৩.০৫.১৯৮৮)
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
Doinik Sabder Methopath
Vol -120. Dt -04.09.2020
১৮ ভাদ্র, ১৪২৭. শুক্রবার
################################
সপরিবার প্রেমেন্দ্র মিত্র
প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯০৪ সালে কাশীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র। তিনি রেলে চাকরি করতেন। মাতার নাম সুহাসিনী দেবী।
প্রেমেন্দ্র মিত্র কলকাতার সাউথ সাবার্বন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯২০) পাস করে সাহিত্য-সাধনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯২৩ সালে প্রবাসীতে ‘শুধু কেরাণী’ ও ‘গোপন চারিণী’ নামে দুটি গল্প প্রকাশিত হয় এবং গল্প দুটি নিয়ে কল্লোল পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে। ফলে সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর খ্যাতি বেড়ে যায়। সাহিত্য-সাধনার প্রথমপর্বে তিনি ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’ ছদ্মনামে লিখতেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোল (১৯২৩) পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। পরে মুরলীধর বসুর সহযোগিতায় কালিকলম (১৯২৬) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে নিজের লেখায় সাঙ্গীকরণের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক মতবাদকে সমীহ করলেও সেসব তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। সেসব মতবাদ তিনি গ্রহণ করেছেন স্বদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, গরিব ও শ্রমজীবী সমাজের প্রতি সহমর্মিতার মাধ্যমে। তিনি একটি কবিতায় বলেন: ‘আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের, মুটে মজুরের,/ আমি কবি যত ইতরের!’ রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যজগতে যে ধারার সূচনা করেছিলেন প্রথম জীবনে তার দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে তিনি তাঁর নিজের স্বতন্ত্র পথ খুঁজে পান।
১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে গোবিন্দ ঘোষাল লেনের একটি মেসে থাকার সময় ঘরের জানলার ফাঁকে একটি পোস্টকার্ড আবিষ্কার করেন। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার মনে দুটো গল্প আসে। সেই রাতেই গল্পদুটো লিখে পরদিন পাঠিয়ে দেন জনপ্রিয় পত্রিকা প্রবাসীতে। ১৯২৪ সালের মার্চে প্রবাসীতে 'শুধু কেরানী' আর এপ্রিল মাসে 'গোপনচারিণী' প্রকাশিত হয়, যদিও সেখানে তার নাম উল্লেখ করা ছিল না। সেই বছরেই কল্লোল পত্রিকায় 'সংক্রান্তি' নামে একটি গল্প বেরোয়। এরপর তার মিছিল এবং পাঁক(১৯২৬) নামে দুটি উপন্যাস বেরোয়। পরের বছর বিজলী পত্রিকায় গদ্যছন্দে লেখেন 'আজ এই রাস্তার গান গাইব' কবিতাটি।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য: প্রথমা (১৯৩২), সম্রাট (১৯৪০), সাগর থেকে ফেরা (১৯৫৬), ফেরারী ফৌজ (১৯৫৮), হরিণ চিতা চিল (১৯৫৯), কখনো মেঘ (১৯৬১), অথবা কিন্নর (১৯৬৫), নদীর নিকটে (১৯৭২); গল্পগ্রন্থ : পঞ্চশর (১৯২৯), বেনামী বন্দর (১৯৩০), পুতুল ও প্রতিমা (১৯৩২), মৃত্তিকা (১৯৩২), অফুরন্ত (১৯৩৫), মহানগর (১৯৩৭), ধূলিধূসর (১৯৩৮), নিশীথ নগরী (১৯৩৮), কুড়িয়ে ছড়িয়ে (১৯৪৬), সামনে চড়াই (১৯৪৭), প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৫২), সপ্তপদী (১৯৫৫), জল পায়রা (১৯৫৭), নানা রঙে বোনা (১৯৬০); উপন্যাস : পাঁক (১৯২৬), কুয়াশা (১৯৩০), মিছিল (১৯৩৩), উপনয়ন (১৯৩৩), আগামীকাল (১৯৩৪), প্রতিশোধ (১৯৪১), প্রতিধ্বনি ফেরে (১৯৬১), অন্য এক নাম (১৯৬২), পা বাড়ালেই রাস্তা (১৯৬২), পতাকা যারে দাও (১৯৬৩), স্তব্ধ প্রহর (১৯৬৩), মনুদ্বাদশ (১৯৬৪), অমলতাস (১৯৬৫), স্বপ্নতনু (১৯৬৫), দিগ্বলয় (১৯৬৭), যিনি বিধাতা (১৯৭০), সেই যে শহর রাজোলি (১৯৭২)।
সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র শরৎ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫৪), আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৬), আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), নেহেরু পুরস্কার (১৯৭৬) পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া শিশু সাহিত্য পরিষদের ভুবনেশ্বরী পদক (১৩৭৮), দেশিকোত্তম উপাধি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হরনাথ ঘোষ পদক (১৯৮১) প্রভৃতি সম্মাননা ও উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। তাঁর মৃত্যু কলকাতায়, ৩ মে ১৯৮৮।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম কবিতার বই 'প্রথমা' প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। বৈপ্লবিক চেতনাসিক্ত মানবিকতা তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।[২] প্রথম জীবনে তার ছোটোগল্পের তিনটি বই বেরোয় - 'পঞ্চশর', 'বেনামী বন্দর' আর 'পুতুল ও প্রতিমা'। মানুষের সম্পর্কের ভাঙ্গা গড়া, মনের জটিলতা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যথা বেদনার কথা প্রকাশে প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন স্বকীয়তায় অনন্য।[৩]
ঘনাদা ও পরাশর সম্পাদনা
প্রেমেন্দ্র মিত্র সৃষ্ট জনপ্রিয়তম চরিত্র ঘনাদা, গল্পবাগীশ সর্বজ্ঞানী মেসবাড়ির ঘনশ্যাম দাস আজো সব বয়েসের পাঠকদের কাছে প্রিয়। তার এই অমর চরিত্র ৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির বাসিন্দা ঘনাদা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে[৪]। এছাড়াও তিনি অনেকগুলি ছোট গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যার মুখ্য চরিত্র পরাশর বর্মা, যে পেশায় গোয়েন্দা হলেও নেশায় কবি। তার সৃষ্ট চরিত্র মামাবাবুকে তিনি বহু এডভেঞ্চার উপন্যাস ও ছোটগল্পে এনেছেন যেগুলি কিশোরদের ভেতর জনপ্রিয় ছিল।[৫]
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য সম্পাদনা
প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক যিনি নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। তার বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার শুরু ১৯৩০ সালে। রামধনু পত্রিকায় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ন ভট্টাচার্য তাকে ছোটদের জন্যে লিখতে অনুরোধ করলে 'পিঁপড়ে পুরান' কাহিনীটি লেখেন। এটিই তার প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচনা[৩]। 'কুহকের দেশে' গল্পে তার কল্পবিজ্ঞান ও এডভেঞ্চার কাহিনীর নায়ক মামাবাবুর আত্মপ্রকাশ। ১৯৪৮ সালে 'ড্র্যাগনের নিঃশ্বাস' বের হলে মামাবাবু পাঠক মহলে জনপ্রিয় হন। তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্প ও উপন্যাসের নাম নিচে দেওয়া হল:
বাম দিক থেকে) বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, তুষারকান্তি ঘোষ, প্রফুল্ল সেন,উমা রায়, অশোককুমার সরকার, রমাপদ চৌধুরী ও প্রেমেন্দ্র মিত্র
ছোটোগল্প: "কালাপানির অতলে", "দুঃস্বপ্নের দ্বীপ", "যুদ্ধ কেন থামল", "মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী", "হিমালয়ের চূড়ায়", "আকাশের আতঙ্ক", "অবিশ্বাস্য", "লাইট হাউসে", "পৃথিবীর শত্রু", "মহাকাশের অতিথি", "শমনের রং সাদা"।
বড়ো গল্প ও উপন্যাস: পিঁপড়ে পুরাণ, পাতালে পাঁচ বছর, ময়দানবের দ্বীপ, শুক্রে যারা গিয়েছিল, মনুদ্বাদশ, সূর্য যেখানে নীল।
এছাড়া আকাশবাণীর উদ্যোগে লিখিত "সবুজ মানুষ" নামে একটি চার অধ্যায়ের বারোয়ারি কল্পবিজ্ঞান কাহিনির প্রথম অধ্যায় রচনা করেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অবশিষ্ট তিনটি অধ্যায় লিখেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী ও সত্যজিৎ রায়।
চলচ্চিত্র জগৎ সম্পাদনা
পথ বেঁধে দিল, রাজলক্ষ্মী (হিন্দি), নতুন খবর, চুপি চুপি আসে, কালোছায়া, কুয়াশা, হানাবাড়ী, তাঁর পরিচালিত ছবি। এছাড়াও তিনি বহু সিনেমার কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ও উপদেষ্টা ছিলেন।
আত্মপ্রচারের অহমিকা থেকে নয়, অত্যন্ত অপরাধীর মতো সঙ্কোচভরে আমি স্বীকার করছি যে আমি অত্যন্ত কুঁড়ে...কেজো লোকেরা আমার নামে মুখ বিকৃত করে, বন্ধু-বান্ধবেরা হতাশার নিশ্বাস ফেলে, অনুরাগী যে দু’চারজন আছে তারা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ে... সম্পাদকেরা আমার কাছে সময়মতো লেখা পায় না, বন্ধু-বান্ধবেরা পায় না চিঠির জবাব। সদিচ্ছার আমার অভাব নেই— চিঠি পেলেই তার জবাব দেবার জন্য উৎসুক হই, কিন্তু লেখাটা বেশির ভাগ সময়ে মনে মনেই হয়, কলমের মুখে কাগজ পর্যন্ত পৌঁছোয় না।’’
প্রেমেন্দ্র মিত্র! ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’-এর ছোট গল্প লেখক, বুদ্ধদেব বসু-সমর সেনের সঙ্গে ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করা প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এর স্রষ্টা, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘সাগর থেকে ফেরা’র কবি। ‘পথ বেঁধে দিল’, ‘কালো ছায়া’, ‘হানাবাড়ি’র মতো ছবির পরিচালক, ‘ওরা থাকে ওধারে’র গীতিকার-চিত্রনাট্যকার, আনন্দ পুরস্কার থেকে সাহিত্য অকাদেমি, নেহরু অ্যাওয়ার্ড থেকে দেশিকোত্তমে বন্দিত সাহিত্যিক। মামাবাবু, পরাশর বর্মা বা অমর ঘনাদার মতো চরিত্রের, দুর্দান্ত বিজ্ঞান-সাহিত্যের জিয়নকাঠি যাঁর হাতে, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখতে চাইতেন না?
পড়তেন কিন্তু খুব। যাকে বলে ভোরাশিয়াস রিডার,’’ বলছেন মৃন্ময়বাবু। ওঁর বিপুল পড়াশোনার কথা লিখে গিয়েছেন লীলা মজুমদার থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৮৮ সালের ২ মে চলে গেলেন। এক মাস পর, ৪ জুনের ‘দেশ’ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন তাঁর দৃষ্টিক্ষীণতার মধ্যেও ‘অদম্য পাঠতৃষ্ণা’র কথা। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে পড়তেন, পরে মাইনে করা লোক রেখেছিলেন, যে তাঁকে বই-পত্রপত্রিকা পড়ে শোনাত। সুনীল লিখছেন প্রেমেন্দ্রের বয়ান: ‘‘না পড়ে যে পারি না! পৃথিবীটাকে এখন আর ভালো করে দেখতে পাই না, এইসব লেখাপত্তরের মধ্য দিয়েই পৃথিবীটাকে দেখি।’’ আলস্য তখন কোথায়, আবার লেখালিখির ইচ্ছে। আন্দাজে কলম ধরে, পরে ডিক্টেশন দিয়ে লিখতেন। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ সুনীলের যে কথাটি: ‘‘সাধারণত প্রবীণ লেখকরা পরবর্তী প্রজন্মের রচনা বিশেষ পড়েন না। প্রেমেনদা সব সময়ই সাম্প্রতিক সাহিত্যের খুঁটিনাটি খবর রাখতেন।’’
No comments:
Post a Comment