Saturday, 26 September 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
           জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
                         সতীনাথ ভাদুড়ী
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷$$$$$÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
            Doinik Sabder Methopath
            Vol - 143. Dt - 27.9.2020
              ১০ আশ্বিন,১৪২৭. রবিবার
========≠===©©©©©==============


" রামিয়া আর ফেরে না। অথচ ঢোঁড়াই রাত কাটিয়ে দেয় সে ফিরবে ভেবে। তবে কি পশ্চিমা এই মেয়েটাকে চেনার ভুল! বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মাফ চাইবে তার কাছে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রামিয়া বসবে উনুনে আগুন দিতে, ঢোঁড়াইয়ের জন্য ভাত রাঁধতে। না না, আজ আবার ভাত রান্না কী? স্নান করে রামিয়া বসবে গম ধুতে ছটপরবের ‘ঠেকুয়ার’ জন্য। ঢোঁড়াই ধাঙড়টুলি থেকে আনবে বাতাবিলেবু, আখ, সাওজীর দোকান থেকে আনবে গুড় আর ঠেকুয়া ভাজার তেল। উঠানে বসে রামিয়াকে নিয়ে আকাশপাতাল ভাবে ঢোঁড়াই। "
                কথাশিল্পী, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘চিত্রগুপ্ত’। ১৯০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিহারে পিতার কর্মস্থল পূর্ণিয়ায় তাঁর জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। পিতা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ছিলেন পূর্ণিয়ার আইনজীবী।

সতীনাথ পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ (১৯৩০) ও বিএল (১৯৩১) পাস করে পাটনায় ওকালতি করেন (১৯৩২-৩৯)। এরপর কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি পূর্ণিয়ার জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারি হন। ১৯৪০-৪১ ও ১৯৪২-৪৫ সালে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তিনি ভাগলপুর জেলে আটক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে কর্মপদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে সমাজতন্ত্রী দলে যোগ দেন (১৯৪৮)।১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সতীনাথ পিতার সহকর্মীরূপে পূর্ণিয়া কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। এই সময় নানাবিধ সমাজসেবামূলক কাজেও জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বলিপ্রথা ও মদের দোকানে পিকেটিং আন্দোলন। সাহিত্যচর্চা শুরু হয় এই সময়েই। বাড়ি বাড়ি বই সংগ্রহ করে পূর্ণিয়া গ্রন্থাগার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে পিতা ইন্দুভূষণের নামে গ্রন্থাগারটির নাম হয় 'ইন্দুভূষণ সাধারণ পাঠাগার'। বলা যায় প্রায় তার একক উদ্যমে বাংলা ম্যাগাজিন ক্লাব গঠন, সাহিত্যপাঠ, স্মরণশক্তি প্রতিযোগিতা, সাহিত্য আড্ডা প্রভৃতির প্রচলন হয়। এই কাজের সূত্রেই তিনি স্বনামধন্য সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করেন। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক জীবনেরও সূচনা ঘটে। গান্ধীজীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন তাকে আকৃষ্ট করে এবং গান্ধিবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পুলিশের চোখ এড়িয়ে গভীর রাতে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে সতীনাথ ভাদুড়ী প্রথমবারের জন্য কারারুদ্ধ হন।[১] ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তিনি দ্বিতীয়বার কারাবাসকালে জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেন ; এর ফলে তাকে ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হয়। এই কারাবাসকালীন সময়ই তার 'জাগরী' উপন্যাস রচনার প্রস্তুতিকাল। ১৯৪৪ সালে তিনি তৃতীয়বার কারাবরণ করেন। এই কারাবাসের সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফণীশ্বরনাথ রেণু, অনাথবন্ধু বসু ,ফণীগোপাল সেন, জয়প্রকাশ নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, অনুগ্রহনারায়ণ সিংহ প্রমুখ। ১৯৪৫ সালে তার সাড়া জাগানো উপন্যাস 'জাগরী' প্রকাশিত হয়। 'চিত্রগুপ্ত' এই সাহিত্যিক ছদ্মনামে তিনি পরিচিত ছিলেন। সতীনাথ পূর্ণিয়ার কিশোর আর তরুণদের জন্য ব্যায়ামাগার গঠন ও শনিবারের সাহিত্যবাসর পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৪৯ সালে তিনি বিদেশ যাত্রা করেন। বিদেশে থাকাকালীন সময়েই তিনি তার গ্রন্থ 'জাগরী'র জন্য বাংলাভাষায় প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫০) প্রাপ্তির সংবাদ পান। বিখ্যাত সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু তার জীবনী মূলক স্মৃতিকথা 'ভাদুড়িজি' রচনা করেন, যা হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ।

উপন্যাস রচনা -
জাগরী ১৯৪৫
চিত্রগুপ্তের ফাইল ১৯৪৯
ঢোঁড়াইচরিত মানস (প্রথম চরণ) ১৯৪৯
ঢোঁড়াইচরিত মানস (দ্বিতীয় চরণ) ১৯৫১
গণনায়ক, ১৯৪৮ (গল্পগ্রন্থ)
সত্যি ভ্রমণ কাহিনি ১৯৫১-ছোটগল্প
অচিন রাগিনী ১৯৫৪- ছোটগল্প
অপরিচিতা ১৯৫৪- ছোটগল্প
সংকট ১৯৫৭- উপন্যাস
আলোক দৃষ্টি ১৯৬৪- ছোটগল্প
অপরিচিতা ১৯৫৪- ছোটগল্প
চকাচকি ১৯৫৬- ছোটগল্প
পত্রলেখার বাবা ১৯৫৯- ছোটগল্প
জলভ্রমি ১৯৬২-ছোটগল্প
দিকভ্রান্ত ১৯৬৬,-উপন্যাস মৃত্যুর পর প্রকাশিত ।
ডাকাতের মা.

১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চ সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রয়াণ ঘটে। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে কোশীর শাখানদীর শ্মশানঘাটে তার মরদেহ ভস্মীভূত হয়ে মিশে গেল পূর্ণিয়ার মাটিতে।

"জাগরী" ও সতীনাথ -

তাঁর "জাগরী’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল আছে এর পটভূমি ও বিবেচ্য সময়ের কারণেই-- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডামাডোলে অসংখ্য পরিবারের টগবগে তরুণরা অংশগ্রহণ করে, আত্ম-বলিদান দেয়। কিন্তু লেখক সকল পরিবার থেকে একটা পরিবারকে এখানে হাজির করেছেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন যা আগস্ট আন্দোলন নামেও পরিচিত--এই উপন্যাসে ভিন্ন সুর ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

পুর্ণিয়া জেলের রাজবন্দী বিলু। আর তার বাবা-মাও পৃথক সেলে আটক রয়েছে। খুব ভোরে বিলুর ফাঁসি কার্যকর হবে। আদেশ হয়েছে, জল্লাদও প্রস্তুত। বিলুর বাবা, মা--যারা অপেক্ষা করে আছে তাদের নিজ নিজ আবেগ অনুভূতি সমেত। জেলগেটে ভাইয়ের শবদেহ নেবার অপেক্ষায় আছে নীলু--বিলুর সহোদর। এদিকে বিলু তার একাকী সেলে ভাবছে তার জীবনের অতীত স্মৃতি। মানসপটে ভেসে আসছে মা, বাবা, নীলু, জ্যাঠাইমা, সহযোদ্ধা রাজনৈতিক কর্মীদের কথা। আন্দোলনের কথা, স্বরাজের কথা।  

 "ঢোঁড়াই চরিত মানস " ও সতীনাথ -

রামচরিত্র মানস সরোবরের ন্যায় বিশাল। এর ভিতর রামকথারূপ হাঁস ঘুরে বেড়ায়।’ বাংলা সাহিত্যজগতের অন্যতম ইন্টেলেকচুয়াল শিল্পী সতীনাথ ভাদুড়ী ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ লিখতে গিয়ে যে বহুবিধ পাদটীকা ব্যবহার করেছেন তার প্রথমটিতেই পূর্বোক্ত উল্লেখটি পাওয়া যায়। 
কাজ ও রাজনীতির সূত্রে বিহার প্রদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ তাঁর হয়েছিল। সেই প্রান্তিকায়িত জনের মধ্যে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ভাবনার কী প্রভাব তার বিশ্লেষণ সতীনাথের অন্তঃকরণে স্বাভাবিকভাবেই হতে থেকেছে। একদিকে রাজা ও রাজত্বের থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্তের মানুষ ও তাদের নিজস্ব জীবনের ধাঁচ দেখছেন লেখক, অন্যদিকে নিজে যে রাজনৈতিক মতাদর্শে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত ও প্রভাবিত তার প্রভাবের স্বরূপ বুঝতে চাইছেন ওই প্রান্তিক জনজীবনে।

ফলে একদিকে তিনি ভারতের প্রাচীন মহাকাব্যের দেশকাল অতিক্রমী প্রভাব, যা কিনা অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের একটি প্রকল্প, অন্যদিকে তাঁর সমকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গান্ধী – এই দুই তিনি একটি আখ্যানের মধ্যে বুনে দিতে পেরেছিলেন। কাজটি অত্যন্ত কঠিন ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু সতীনাথের শক্তিশালী মনন একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। গান্ধীর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রামায়ণের দিকে তাঁর মনোযোগ টেনেছিল সহজে। আবার এও তিনি দেখেছিলেন যে রামায়ণের কী সর্বগ্রাসী প্রভাব লোকমানসে। ফলে সতীনাথ যে প্রকল্প নিয়েছিলেন তা যেমন আকর্ষণীয় তেমনই জটিল। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনা স্পষ্ট ‘জাগরী’-তে। বিয়াল্লিশের আন্দোলন ও ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে সক্রিয় মধ্যবিত্ত পরিবারে তার প্রভাব এই উপন্যাসের আখ্যান। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ মানুষের মধ্যে, এমনকি তারা একই পরিবারের হলেও, কী অনতিক্রম্য দূরত্ব নিয়ে আসে তা এই উপন্যাস দেখিয়েছে। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ সেরকম স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানের আখ্যান না হয়েও গভীরতর রাজনীতির উপস্থাপক। এই রাজনীতি আবহমান মানব সমাজের রাজনীতি। তাই একদিকে তা ছুঁয়ে থাকে অতীতের রামকথা অন্যদিকে হাত ধরে তার সমকালের গান্ধীবাদের। এই বিপুল বিস্তারের জন্যই ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ হয়ে ওঠে বর্তমান ভারতের ধ্রুপদী মহাকাব্যিক উপন্যাস।




=============!!!!!!!===============

No comments: