জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
============✓✓✓✓✓✓==========
Doinik Sabder Methopath
Vol -146. Dt - 30.9.2020
১৩ ই আশ্বিন, ১৪২৭. বুধবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় মানভূম জেলার রোপো গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। ১৯৫৭ সালে কলকাতার মনীন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষায় অনার্স সহ পাশ করেছিলেন। ঐ বছরেই ভারতীয় গননাট্য সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকে তিনি নাটক রচনা ও অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৫০ থেকে ৫৪-এই পাঁচ বছরে ৯টি নাটকে নির্দেশনা ও অভিনয় সূত্রে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ তে লিখেছেন মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক 'সংঘাত'। ২ বছর পরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। এই সংঘে ১৫টি নাটকে অংশ নেন তিনি। ১৯৬০ সালে ২৯ শে জুন প্রতিষ্ঠা করেন 'নান্দীকার'। প্রায় ৪০টি নাটকে নির্দেশক বা অভিনয় অথবা উভয় ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। তিন পয়সার পালা নাটকে নির্দেশনা ওসঙ্গীত পরিচালনার জন্য তিনি সুনাম অর্জন করেন। সেতু বন্ধন, সওদাগরের নৌকা তার রচিত নাটক। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ এ নান্দীমুখ নামে নামে এক নতুন নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এদের বিখ্যাত নাটক পাপপুণ্য।
অজিতেশ ১৯৬৫ সালে ছুটি চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে মোট ৬৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিংহ পরিচালিত হাটে বাজারে সিনেমায় অভিনয় করে সকলের নজর কাড়েন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অজিতেশ ১৩ অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে কলকাতায় মারা যান। তিনি আকস্মিকভাবে মারাা যান।
==≠=============================
বিশেষ প্রতিবেদন -
================================
জানা অজানা অজিতেশ
সম্রাট মুখোপাধ্যায়
ঝাঁকড়া চুলের এক রোগা ছেলে, মায়াভরা দুটো চোখ নিয়ে এ’শহরে এসে দারিদ্রকে হারিয়ে হয়ে উঠেছিলেন মঞ্চের সম্রাট। ব্যক্তিজীবনেও নিয়মকানুন চুরমার করে দিয়েছিলেন। এরকমই এক শারদ অবকাশে চলেও গিয়েছিলেন হঠাৎ। এক স্মৃতিকথার প্রকাশে তাঁকে ফিরে দেখা। নানা অজানা কথায়।
বুঝতে পেরেছিলেন কি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, যে সে বছর ১৪ অক্টোবরের পরে আর তাঁর জীবনে কিছু পড়ে নেই? না’হলে তাঁর সেই খাতা, যাতে লেখা থাকত অন্তত মাসখানেকের আগাম কর্মসূচির ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’, আর কিছু লেখেননি কেন সেখানে ১৪ অক্টোবরের পর!
১৪ অক্টোবর, ১৯৮৩। সেবার পড়েছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী। আর সেদিনই চলে গেছিলেন তিনি এ’পৃথিবী ছেড়ে। ভোররাতে। এক নিদারুণ হার্ট অ্যাটাকে। মাত্রই দু’সপ্তাহ পার হয়েছে তখন, ৫০ বছরের জন্মদিন পূর্ণ হবার। খবর পেয়ে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের ছেলেরা সাত–আটজন ডাক্তারে ভরিয়ে দিয়েছিল ঘর। কিন্তু ততক্ষণে পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে।
উড়ে যাবার বা পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে এই মহানটের শেষ বলা কথাটি ছিল, ‘আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।’ কথাগুলি ডাক্তার আসার আগে যাঁর হাতের মুঠি ধরে অজিতেশ বলে যাচ্ছিলেন, তিনি রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়। অজিতেশের জীবনের শেষ এক যুগের জীবন–সঙ্গিনী। সমাজের অনুশাসন ‘তোয়াক্কা’ না করে যাঁর সঙ্গে অজিতেশের ঘর বাঁধা ও সহবাস। বেলেঘাটার সিআইটি রোডের দু–কামরার এক ফ্ল্যাটে। বাগবাজার–এর বাড়ি (যে বাড়িতে প্রতিবেশী ছিলেন অজিতেশ আর রত্না) ছেড়ে আসা ইস্তকই এই বাড়িই ছিল অজিতেশের আমৃত্যু বাসভূমি। পি ৮৩এ, সিআইটি রোড, কলকাতা–১০। অজিতেশের শেষ ঠিকানা।
সেতুবন্ধনে
‘অজিতেশের শেষ ঠিকানা’— ঠিক এই নামেই সম্প্রতি একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ পেয়েছে রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যার অনেকটাই প্রকৃত–প্রস্তাবে এক দিনলিপি।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ‘জীবন্ত–আগুনের–স্বরলিপি’র সঙ্গে দিনযাপনের দিনলিপি, যা রত্না লিখেছিলেন ডায়েরিতে। সেই সময়েই। একান্তই নিজস্ব স্মৃতিধারণের উপায় হিসাবে। সময় কাটাতেও কিছুটা। সেই ডায়েরি রত্নাদেবীর এক আত্মীয়সূত্রে শঙ্খবাবু (ঘোষ), শমীকবাবুর (বন্দ্যোপাধ্যায়) হাত ঘুরে অবশেষে প্রকাশ পেয়েছে। মুখবন্ধ লিখেছেন শমীকবাবু। প্রকাশ করেছে ‘থীমা’। মাঝপথে থেমে যাওয়া ডায়েরিকে পরে লিখে অবশ্য আবার সম্পূর্ণ করেছেন রত্নাদেবী। আর সেই বই জুড়ে কত যে না–জানা কথা। যার উন্মোচন এই প্রথম বোধহয়। তার ভেতর প্রেম–দাম্পত্য–অভাব–মৃত্যু— এসবেরও অতি–ব্যক্তিগত আখ্যান যেমন, তেমনই উঠে এসেছে অজিতেশের প্রথম জীবনে দারিদ্র–কণ্টকিত লড়াই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য। নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য। আবার এসেছে তাঁর নানা নাটকের তৈরি হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর নেপথ্য–বৃত্তান্তও। যেসব নাটক ভেবেও করা হয়নি নানা–সময়ে, আছে তার হদিশও। মৃত্যু যে কতকিছু কেড়ে নিয়ে যায়!
এ বই যেন আগাগোড়া নানা অনুন্মোচিত–অজিতেশের নতুন করে প্রকাশ পাওয়া।
হে সময়, উত্তাল সময়
নাটক করতে এ’শহরে আসেননি অজিতেশ। যাঁর নাম তখন অজিত, শুধু অজিত, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। শহরে এসেছিলেন পড়াশুনা করতে। কলেজে। শ্যামবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে ইংরেজি অনার্স–এর ছাত্র অজিত সেসময়। নিজের বাইরের জগতের বই পড়া দিয়ে ছাত্রাবস্থাতেই যে চমকে দিতে পারে কলেজের ডাকসাইটে অধ্যাপকদের। প্রিয়ও হয়ে উঠতে পারে শিক্ষক তথা সহপাঠীদের কাছে। কালো, বেশ রোগা, ঈষৎ গ্রাম্য চেহারা, মাথাভরা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, পরনে ঈষৎ মলিন ধুতি–জামা, কিন্তু চোখ দুটোর দিকে কারোর নজর গেলেই তাকে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে। এত গভীরতা সেখানে। আর প্রাণচাঞ্চল্য। প্রতিটা কথা বলেন আশ্চর্য উত্তাপে।
সে উত্তাপের জোগান কিন্তু আসে শুধু নাটক থেকে নয়। কলেজ জীবনেই নাটকের সূত্রপাত অজিতেশের ঠিকই, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বে, তাঁর চিন্তায় আগুন ঠেসে দেয় রাজনীতি। কলেজ তথা কলেজের বাইরে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী তখন অজিত। এতটাই যে কলেজের স্টুডেন্টস ফেডারেশন ছেড়ে তিনি একসময় হয়ে উঠেছেন দমদমে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির লোকাল কমিটির সম্পাদক। শুধু গণনাট্য সংঘ নয়, করেন শ্রমিক সংগঠনও। ইউনিট গড়তে পাড়ি দেন নতুন নতুন কারখানায়।
আর থাকেন? একেবারেই ‘শ্রেণিচ্যুত’ হবার মতো এক পরিবেশে। রাজাবাজারের ভেতরে এক বস্তিতে। যে খোলার চালের ঘরে বাস, তার দেওয়ালের সবদিকেই স্পঞ্জের মতো ছ্যাঁদা, ছাদ দিয়ে জল পড়ে, চারপাশে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ, পাশেই টিবি রোগীর বাস, এজমালি পায়খানা। ইলেক্ট্রিসিটির কথা ভাবাও এখানে স্বপ্ন! খাওয়া? কোনওদিন অর্থাভাবে এমনও— ‘পনেরো পয়সা দিয়ে রাজাবাজারের ফুটপাথ থেকে দুটো রুটি আর রুটির সঙ্গে ফ্রি হিসাবে মেলা গরুর নাড়িভুঁড়ির ছেঁচকি।’ তারপর পেটের জ্বলুনি কমাতে পাঁচ পয়সা দিয়ে পাতিলেবু কিনে রাস্তার জলে ধুয়ে খাওয়া। এক সময় কলেরা হয়েছে। বস্তির লোকেরা আইডি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছে।
সম্বল বলতে টিউশনি। আর গল্প লিখে একটি পত্রিকা থেকে কিছু পয়সা পাওয়া। গল্প বলতে সেই পত্রিকার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সংস্কৃত গল্পের অনুবাদ। বোঝাই যাচ্ছে ইংরেজি অনার্সের ছাত্র অজিতেশ ভালরকম সংস্কৃতও জানতেন। এই গল্পগুলোর একসঙ্গে করা ‘ফাইল’ রত্না জানাচ্ছেন তাঁর কাছে আছে, যা কখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পরেও অজিতেশ কিছু কিছু গল্প লিখেছেন। সেগুলো মৌলিক। লিখেছিলেন একটি উপন্যাসও। নাম ‘ভালো লেগেছিল’।
পাশ পেপার ছিল বাংলা আর ইকোনমিক্স। তা ফাইনাল ইয়ারে ইকোনমিক্স পরীক্ষার দিন হাতে একটাও পয়সা নেই খাবার মতো। রাতে না ঘুমিয়ে, ভোর থেকে উঠে পড়ে, বেলা এগারোটা অবধি পড়ে, অর্থনীতির বইটা পুরনো বইয়ের দোকানে বেচে দিলেন অজিত। তারপর সেই পয়সার খানিকটায় পাইস হোটেলে ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিতে ঢুকে পড়লেন হলে।
এসবের মাঝেই মাঝে মাঝে ‘পলাতক’ হতেও হত। কখনও বিপক্ষ দলের গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচতে। কখনও আবার পুলিশের হাতে পড়া থেকে বাঁচতে। পার্টির একটা মিটিং–এ উত্তর কলকাতায় কমল বসুর বাড়িতে আলাপ হয়েছিল জ্যোতি বসুর সঙ্গে। অনেক বছর পরে। তখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহু দূরের বাসিন্দা অজিতেশ। অভিনয়ই একমাত্র কাজ। সিনেমা করছেন। পরিচিতি বেড়েছে। বোম্বে আর বাংলার অভিনেতাদের প্রদর্শনী এক ক্রিকেট ম্যাচ। উদ্বোধন করতে এসেছেন জ্যোতিবাবু। মুখ্যমন্ত্রী তখন। শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় জ্যোতিবাবু অজিতেশের হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, ‘আমরা তো পূর্ব–পরিচিত, তাই না?’
সেইসব নানা রঙের দিন
অথচ সাধের এই পার্টির সাংস্কৃতিক সেলের সঙ্গেই একসময় বিরোধ তৈরি হল! ‘নান্দীকার’ তখনও কোনও নিবন্ধীকৃত গ্রুপ থিয়েটার নয়। বরং ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’–এর ‘নান্দীকার’ শাখা। নাটক বাছা হল ইতালীয় নাট্যকার পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন দ্য সার্চ অফ অ্যান অথর’। বন্ধু রুদ্রপ্রসাদের অনুবাদে যা দাঁড়াল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। প্রযোজনা প্রায় তৈরি। মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু গণনাট্য নেতৃত্বের একাংশ আপত্তি তুললেন মূল নাট্যকার সূত্রে। লিইউজি পিরানদেল্লো ছিলেন মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সমর্থক। ফলে তার লেখা নাটক কোনওভাবেই সমাজতান্ত্রিক শিবির সংলগ্ন কোনও দল করতে পারে না। করা উচিত নয়। যুক্তি দিল নেতৃত্ব। পাল্টা যুক্তি দিলেন অজিতেশ ও ‘নান্দীকার’, যে এ নাটকে বঞ্চিত মানুষদের ভাঙাচোরা জীবনেরই কথা। তবু নেতৃত্ব অনড় রইলেন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে। অনড় থাকলেন অজিতেশও। ফলে নাটক রইল। ‘নান্দীকারও থাকল। শুধু গণনাট্যের শাখা হিসাবে আর থাকল না। আর এই এক নাটক সূত্রেই বোঝা গেল এসে গেছেন বাংলা মঞ্চে উত্তর–উৎপল–শম্ভু যুগের আধুনিকতার নতুন ভগীরথ। যিনি একের পর এক বিদেশি নাটকের (চেকভ–পিন্টার–ইউনেস্কো–ব্রেখট মায় তলস্তয়) স্থানীকরণে ভরিয়ে দেবে বাংলা নাটকের মঞ্চ। ইংরেজি অনার্সের ছাত্রটি অধ্যাপনায় নয় মঞ্চের মাধ্যমে ইয়োরোপীয় আধুনিক নাটকের দীক্ষা দেবে বাঙালিকে।
কিন্তু সেখানেও বিতর্ক। ১৯৬৪ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতায় তৈরি হল ‘ব্রেখট সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’। প্রথম সভাপতি সত্যজিৎ রায়। আর এর মুখপত্র ‘এপিক থিয়েটার’–এর তৃতীয় সংখ্যায় এই সোসাইটির সভ্যবৃন্দের বয়ানে একটি বার্তা বেরোল, যাতে লেখা কয়েকটি কথা, ‘... ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর বুকে দুষ্টব্রণ। সমাজতন্ত্রেই সামাজিক সমস্ত শক্তির পূর্ণ বিকাশ। সংগ্রামী মানুষে বিশ্বাসী সমস্ত বিদেশি নাট্যকার আমাদের নাট্য আন্দোলনের দোস্ত। পিরানদেল্লো, ইয়োনেস্কো, বেকেট, পিন্টার অসবর্ণ এই বিচারে আমাদের নাট্য আন্দোলনের দুশমন।’ অর্থাৎ এই বিচারে অজিতেশ চলে গেলেন শত্রুশিবিরে এক খোঁচায়! অনেকেরই ধারণা এই তীব্র বয়ানটি তৈরি করেছিলেন এই সোসাইটির প্রাণপুরুষ উৎপল দত্ত।
এর কয়েক বছর পরে অজিতেশও ব্রেখটের নাটক করেন। ‘তিন পয়সার পালা’। উৎপলবাবুর ভাল লাগেনি। ‘অব্রেখটীয়’ লেগেছিল সে প্রযোজনা। এরপর ‘ভালোমানুষ’। এবারও সমালোচনাবিদ্ধ অজিতেশ ওই শিবির থেকে। অবশ্য পাল্টা উদাহরণও আছে, উৎপল–নাট্যের সমালোচনা অজিতেশই আগে করেন। সে নাটক ছিল ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এর বাইরেও কথা আছে। পার্টি নির্বাচনের সময় অজিতেশকে বলেছিল পথনাটক করতে। তিনি পাল্টা বলেন, ‘পেটে বালিশ বেঁধে অতুল্য ঘোষ সাজা তাঁর কাজ নয়।’ এমন মন্তব্য নিঃসন্দেহে উৎপল দত্তের মতো পথনাটক করা ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’দের ক্ষুব্ধ করবেই।
কিন্তু সামনাসামনি কেমন ছিল দু’জনের সম্পর্ক? রত্নার এই বইতে তার একটা মজাদার মুহূর্ত পাচ্ছি। একবার দু’জনের দেখা রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে। অজিতেশের সঙ্গে রত্না। রত্নাকে অজিতেশ বললেন উৎপলবাবুকে প্রণাম করতে। রত্না বললেন, ‘উনি তো প্রণাম নিতে পছন্দ করেন না।’ তবু অজিতেশের কথায় রত্না প্রণাম করলেন। উৎপলবাবুও অস্বস্তি বোধ করলেন। অজিতেশ কিন্তু বুঝিয়ে দিলেন তিনি উৎপলবাবুকে কতটা শ্রদ্ধা করেন।
অসমাপ্ত পাপপুণ্য
রত্না ছিলেন অজিতেশের এক সহপাঠী তথা ‘নান্দীকার’ সঙ্গীর স্ত্রী। দলের ভাঙনের সময়েও এই নাট্যকার–অভিনেতা বন্ধু অজিতের দিকেই ছিলেন। পরে তাঁদের দুই বন্ধুর সংসারেই ভাঙন ধরল যখন ১৯৭২–এর ২২ মার্চ রাতের বেলায় অজিতেশ আর রত্না নিজেদের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন পথে। শুধু মাত্র ভালবাসার টানে। শুরু করলেন একসঙ্গে থাকা। সেই বেলেঘাটার বাড়িতে। যেখানে অজিতেশ রত্নাকে বলেছিলেন, ‘প্লিজ, জানলা দরজায় পেলমেট লাগিয়ে লম্বা লম্বা পর্দা ঝুলিয়ে আকাশটাকে ঢেকে দিও না।... যেন ঘরের মাঝখানটাতে দাঁড়িয়েও দেখতে পাই বাইরের পৃথিবীটাকে।’ আর এই পর্দাহীন ঘরটা থেকেই বেরিয়েছিল অজিতেশের দেহ শেষযাত্রায়। একদিন যে অজিতেশ অন্যভাবে বাঁচতে চেয়ে কোলিয়ারি ছেড়ে এসেছিলেন এ’শহরে। রত্নার তখন মনে পড়েছিল একসময় দীর্ঘদিন পয়সার অভাবে এই বাড়িতে তাঁরা কোনও চেয়ার কিনতে পারেননি। কোনও অতিথি এলে চেয়ার ধার করে আনতে হত প্রতিবেশীদের ঘর থেকে।
রত্না বিচ্ছেদ পেয়েছিলেন স্বামীর কাছ থেকে। অজিতেশ পাননি। অজিতেশের মা আর বোনেদের বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি তাঁর বিপক্ষে গিয়েছিল। আর সেদিন দুপুরে রত্না দেখেছিলেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাঁকে কাঁদতে। অবিকল যেভাবে মঞ্চে তখন কাঁদতেন ‘পাপপুণ্য’ করতে গিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা উচ্চতর আদালতে গিয়েছিল। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই তো চলে যান তিনি। সন্ধেবেলা পেশাদার মঞ্চে অভিনয় সেরে এসে। ‘এই অরণ্য’ নাটকে।
ভেবেছিলেন পেশাদার মঞ্চেই আবার ফিরিয়ে আনবেন একটি বড় মাপের নাটক তৃপ্তি মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে। হল না। ভেবেছিলেন দ্রোণাচার্য আর শকুন্তলার গল্পের আধুনিক ব্যাখ্যায় নাটক লিখবেন। হল না। সব ছেড়ে চলে গেলেন সেই মানুষটি, যিনি একই সঙ্গে ছিলেন সম্রাট ও সন্ন্যাসী।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও
রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়
------------------------------------------------
সংগৃহীত তথ্য
- উইকিপিডিয়া
- আজকাল পত্রিকা
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment