∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
জন কীটস্
=================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -177. Dt- 31.10.2020
১৫ কার্তিক,১৪২৭.শনিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
"Beauty is truth, truth beauty,-that is all
Ye know on earth, and all ye need to know."
কীটসেরর জন্ম লন্ডনে, ১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর। পিতা টমাস কীটস ছিলেন ভাড়াটে ঘোড়ার আস্তাবলের কর্মচারী, পরে সেই আস্তাবলের মালিকের কন্যা ফ্রান্সিস জেনিংসকে বিয়ে করে সেই ব্যবসার মালিক হয়ে যান। কীটস’রা ছিলেন চার ভাই, এক বোন। তার এক ভাই ছোট বেলাতেই মারা যায়। কীটসের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো না। তিনি এনফিল্ডের একটি নামকরা স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করান। সেখানে প্রধান শিক্ষকের ছেলে চার্লস ক্লার্কের সাথে কীটসের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। ক্লার্ক ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি ও সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি কীটসকে কল্পনা ও কাব্যের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ছোটবেলায় কীটসের অবশ্য পড়াশুনায় মন ছিলো না। তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির আর মারকুটে স্বভাবের। তবে স্কুলে এসে ক্লার্কের সান্নিধ্যে তিনি এলিজাবেথিয়ান কবি স্পেন্সার ও শেক্সপিয়ারের কাব্য ও নাটকের সাথে পরিচয় লাভ করেন। চ্যাপম্যান অনুদিত হোমারের ইলিয়াড-এর সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটে। এডমন্ড স্পেন্সার-এর ‘দ্যা ফেইরী কুইন’ পড়ে প্রথম তার মনে কাব্যসৃষ্টির অনুপ্রেরণা জাগে।
১৮০৪ সালের এপ্রিলে, কীটস আর তার ছোটভাই জর্জকে স্কুলে রেখে ফেরার পথে তাদের বাবা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মাথার খুলিতে আঘাত পান। এই আঘাতই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কীটসের বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। এর দু’মাস পর তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু এ বিয়ে সুখের না হওয়ায় তিনি ফিরে আসেন ও চার সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে চলে যান। ১৮১০ সালের মার্চে কীটসের মা যক্ষ্ণা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন কীটসের বয়স ১৪। রোগশয্যায় কীটসের সেবা ছিলো তুলনাহীন। এভাবেই ক্রমে নিঃসঙ্গ হতে থাকে কীটসের বেড়ে ওঠার দিনগুলো। দিদিমা কীটসকে স্কুল ছাড়িয়ে হ্যামন্ড নামক একজন চিকিৎসকের অধীনে শিক্ষানবিশ নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পরেই কীটস ডাক্তার হ্যামন্ডের সাথে ঝগড়া করে শিক্ষানবিশী ছেড়ে দিয়ে লন্ডন ফিরে আসেন। এখানে সেন্ট টমাস হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ধরে হাতে-কলমে ডাক্তারি শিখেন। কিন্তু এসব কীটসের জন্যে ছিলো না। তার ভাবুক মন কাব্যের মায়াময় জগতে ছুটেই চলতে থাকে অবিরত। ১৮১৪ সাল থেকে তার কাব্য রচনার শুরু।
১৮১৭ সালে ডাক্তারি ছেড়ে পুরোপুরি কাব্যের জগতে নিমগ্ন হন কবি। এ সময় কবি জন হ্যামিল্টন রেনল্ড, চিত্রশিল্পী সেভার্ণ, সমালোচক হ্যাজলিট, কোলরীজ, ল্যাম্ব, শেলীসহ প্রমুখ গুণী ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন কীটস। খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সুন্দর বন্ধুচক্র গড়ে ওঠে তার। লন্ডনের দিনগুলি তার ভালো কাটছিলো না। ভাই জর্জ আর টমকে নিয়ে কীটস হ্যাম্পস্টেডে চলে আসেন। তার এই নতুন আবাস থেকে কবি লে হান্ট, কোলরীজ ও তার বন্ধুদের অন্যান্যদের বাড়ি কাছাকাছিই ছিলো। এ সময় কীটসের ছোট ভাই টম যক্ষ্ণায় পড়েন। কীটস আর জর্জ দুই ভাই মিলে দিনরাত সেবা করতে থাকেন ছোট ভাইয়ের। এই সংস্পর্শকালীন সময়েই কীটসের ভেতর সংক্রমিত হয় রাজরোগ যক্ষ্ণার বীজ। সেই দিনগুলোতে যক্ষা ছিলো দুরারোগ্য। পরবর্তী শতাব্দীতে এসে যক্ষ্ণার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়। ১৮১৮ সালের ১ ডিসেম্বর টম কীটস মারা যান।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর কীটস তার পুরোনো আবাস ছেড়ে একই এলাকায় বন্ধু চার্লস ব্রাউনের নতুন তৈরি বাড়ি ‘ওয়েন্টওয়ার্থ প্লেস”-এ চলে আসেন। এখানেই কীটস রচনা করেন তার ৫/৬টি বিখ্যাত ‘ওড’ (Ode)। ‘Ode to a Nightingale’, ‘Ode on a Grecian Urn’, ‘Ode on Melancholy’ প্রভৃতি তার সুবিখ্যাত Ode। কীটসের প্রতিভার সম্যক স্ফুরণ ঘটেছে তার Ode-গুলোর মধ্যে। কীটস যদি শুধু Ode-গুলোই রচনা করতেন, তবু ও ইংরেজি সাহিত্যের মর্যাদাসম্পন্ন একজন কবি বলে পরিগণিত হতেন। তার সমস্ত হৃদয়-মন ছিলো সৌন্দর্যের নন্দলোকে আবদ্ধ। তার সকল সৃষ্টিকর্মে তিনি সৌন্দর্য ও মাধুর্যের পূজারী ছিলেন। তবে তার বিশেষত্ব শুধু সৌন্দর্যের বর্ণনায় ছিলো না, ছিলো প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে বের করার সক্ষমতার মধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ বস্তুগুলোর মধ্যে তিনি পেয়েছেন সৌন্দর্য, বিষণ্নতাকে বলেছেন সৌন্দর্যের পরিপূরক। তার কাছে প্রকৃতির মাঝে লুক্কায়িত এই নিগূঢ় সৌন্দর্যের অস্তিত্ব ছিলো মহান সত্য। আর তাই তিনি বলেছেন, “Beauty is truth, truth beauty”। সৌন্দর্যের মধ্যে একটা সুগভীর শান্তির ভাবও আছে। এই শান্তভাবের মধ্যেও রয়েছে বিষণ্ণতা। এই বিষণ্ণতা এসেছে কবিমনে স্বল্পায়ু জীবনের নশ্বরতার চিন্তা থেকে, মানব নিয়তির নিস্ফলতা বোধ থেকে। তবুও পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে সৌন্দর্যের যে রূপ-মাধুরী তিনি সম্ভোগ করেছেন, তাকেই চিরন্তন করে রেখে গেছেন তার Ode-গুলোর মধ্যে দিয়ে।
কীটস অনেকগুলো সনেটও লিখেছেন। সনেটগুলোর মাঝে কবি মনের ছোট ছোট ভাবগুলো মুক্তোর মতো ঝলমল করে উঠেছে। এখানেও রয়েছে সেই আদিম সুকুমার কল্পনার বিস্ময়করতা, নির্জন প্রকৃতির আসঙ্গ লিপ্সার আর্তি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি আর গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তার ছোঁয়া।
১৮১৯ সালে ফ্যানি ব্রাউনির সাথে কীটসের পরিচয় হয়। ফ্যানি তার বিধবা মায়ের সাথে ওয়েন্টওয়ার্থ প্লেসের অপর অংশে এসে ওঠে। ফ্যানির নামের সাথে কীটসের বোন ও মায়ের ডাকনামের মিল ছিলো। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। কীটস ফ্যানিকে বই ধার দিতেন। প্রায়ই তারা একসাথে পড়তেনও। শান্তশিষ্ট মেয়েটির মাঝে নিজের নিঃসঙ্গ অংশটির পরিপূর্ণতা খুঁজে পান কবি। অনিবার্যভাবে ফ্যানির প্রেমে পড়ে যান কীটস। নিজের লেখা অসম্পূর্ণ সনেট ‘ব্রাইট স্টার’ তিন ফ্যানিকে দেন। আমৃত্যু কীটস ফ্যানির বাগদত্তা ছিলেন। তাদের বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। ১৮২০ সালেই কীটসের মধ্যে যক্ষ্ণার সমূহ লক্ষণ সাংঘাতিকভাবে ফুটে উঠতে থাকে। যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে ফ্যানির সাথে তার শারীরিক স্পর্শের সুযোগও বন্ধ হয়ে যায় তার। তারা কাঁচের জানলার দু’পার থেকে একে অপরের সাথে কথা বলতেন, পত্র আদান-প্রদান করতেন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কীটসের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে তিনি ইটালীতে বন্ধু জোসেফ সেভার্ণের কাছে চলে যান। সেখানে রোমে একটি বাসা নেন তিনি। কিন্তু হাওয়া বদল করেও তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। ঘন ঘন রক্তবমি হতে থাকে। একদিন রক্তবমি করার পরে তিনি বলেন, “এই রক্ত আমি চিনি, এ উঠে এসেছে সোজা আমার ধমনী থেকে। এই রঙ আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না।” বেঁচে থাকাটা তার জন্য একসময় দুঃসহ হয়ে ওঠে। একটা সময় বারবার তিনি বলতে থাকেন, “আমার এই মৃত অস্তিত্ব আর কতদিন চলবে?”
১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক জীবনকাল সমান নিঃসঙ্গতার দিনপঞ্জী, অপূর্ণ প্রেমকে পূর্ণ করার আমৃত্যু বাসনা আর এক মাত্রাহীন শারীরিক কষ্ট নিয়ে চিরসুন্দরের এই কবি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রোমের প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রিতে কবিকে দাফন করা হয়। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার সমাধি ফলকে কোনো নাম বা তারিখ লিখা হয়নি। শুধু লিখা হয়েছে, “এখানে এমন একজন শায়িত, যার নাম লিখা হয়েছিলো জলের ধারায়।” ('Here lies One Whose Name was writ in Water.') নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন কীটস।
কীটস ছিলেন রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি। তার সমসাময়িকরা সকলে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক বেশি উচ্চে ছিলেন। কীটস স্কুলের গন্ডীটাও ঠিকমতো পার হতে পারেন নি। কিন্তু যা পড়তেন, যার সংস্পর্শে আসতেন, তাকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিলো তার। আর তাই স্পেন্সার, চ্যাপম্যান, মিল্টন, শেক্সপিয়ার, লে-হান্ট কারও প্রভাব থেকেই তিনি মুক্ত নন। মাত্র ৬ বছরের কাব্যজীবনে যে ফসল তিনি ঘরে তুলেছেন তা মোটেও নগন্য নয়। সমসাময়িক সকলের থেকে গৃহীত বৈচিত্র্যময় সব উপাদান নিয়ে গঠিত এক অপূর্ব রূপমূর্তি ছিলো তার সৃষ্টির।
১৮২০-এর ফেব্রুয়ারিতে ফ্যানিকে কীটস লিখেছিলেন, “আমি এমন কোনো মহান কর্ম পেছনে ফেলে যাচ্ছিনা যা আমার বন্ধুদের গর্বিত করবে, আমি শুধু প্রতিটি জিনিসের ভেতরের সৌন্দর্য্যের উৎসকে ভালোবেসেছি। সময় পেলে নিজেকে স্মরণীয় করে যেতাম।” সত্য, সৌন্দর্য আর প্রেমের পিয়াসী এই কবি তার পরেও স্মরণীয় হয়ে আছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম দিয়ে, মানুষের মাঝে সৌন্দর্যতত্ত্বের বীজ বুনে দিয়ে। এক বসন্ত যায়, আরেক বসন্ত আসে। বাসন্তী হাওয়ায় ভেসে বসন্তের দূতের মতো চিরকাল কাব্যপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যান জন কীটস। চিরবসন্তের দুনিয়ায় চিরসুখী থাকুন চিরসুন্দরের কবি
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment