আলোচনা পর্ব -২০
বাঁদনা পরব বা গোয়াল পুজো
লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক
=============$$$$$$$$============
Doinik Sabder Methopath
Vol -192. Dt -15.11.2020
২৯ কার্তিক,১৪২৭. রবিবার
$$$$$$$$$$$÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷$$$$$$$$$$
" বন্দনা " থেকে বাঁধনা শব্দটি এসেছে। এই উৎসব মূলত গরুর বন্দনা করা। বস্তুত, এই পরব মূলবাসীদের। সহরা মূলত আদিবাসীদের উৎসব। কালীপুজোর দিন গোয়াল ঘর পরিস্কার করা হয়। গোবর-মাটি দিয়ে নিকানো হয়। গরুদের স্নান করিয়ে শিংয়ে তেল মাখানো হয়। কপালে দেওয়া হয় সিঁদুরের টিপ। গোয়াল ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয়। আল্পনাও দেওয়া হয়। কথিত রয়েছে, মহাদেব কালীপুজোর রাতে গৃহস্থের গোয়াল পরিদর্শন করতে আসেন। রাতে হয় গরু জাগান। ঝাগড় দল গৃহস্থের গোয়ালে ঢোল, করতাল সহযোগে গান গাইতে বেরোয়। সারা রাত ধরে তাঁরা গ্রামে গ্রামে গান শোনান। তাঁদের পিঠে খেতে দেওয়ার চল রয়েছে।
পরের দিন হয় ‘গোহাল পুজো’। নতুন জামা-কাপড় পরে চাষের সরঞ্জাম লাঙল, জোয়াল, কোদাল ধুয়ে গোয়াল ঘরে রাখা হয়। বাড়ির এয়োস্ত্রীরা পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে নতুন মালসায় ঘিয়ে ছেঁকা পিঠে তৈরি করেন। ভাই ফোঁটার দিন হয় গরু খুঁটান। গ্রামের ফাঁকা মাঠে গাছের মোটা ডাল পুঁতে সেখানে বলদ বা ষাঁড় বেঁধে রাখা হয়। তার পরে তার সামনে মরা পশুর চামড়া ঘুরিয়ে বিরক্তি তৈরি করা হয়। গোল করে ঘিরে থাকা দর্শকরা ঢাক, কাঁসর বাজান। প্রায় উন্মত্ত অবস্থায় বলদ বা ষাঁড় লাফালাফি করতে থাকে। তা দেখে খুশি হন দর্শকরা। এই সময় বাড়ির মেয়ে-জামাইকে বাড়িতে নিয়ে এসে আদর যত্ন করা হয়। জামাইকে শাশুড়ি ফোঁটা দেন। বাঁদনা ও সহরা বস্তুত এক ধরনের কৃষি উৎসব। মাঠে এই সময় পাকা ধান থাকে। ক’দিন পরেই সেই ধান গোলায় ভরা হবে। তাই তার আগে কৃষি কাজে সাহায্যকারী পশু গরুর যত্ন করা হয়। তালড্যাংরার বাসিন্দা গুরুপদ সোরেন, সিমলাপালের মহেন্দ্রনাথ সোরেন বলেন, “সারা বছর ধরে আমরা এই পরবের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। নতুন পোশাক কেনা হয়। নাচ-গান হয়। সে জন্য বাদ্যযন্ত্র মেরামতি করে সাজিয়ে রাখা হয়।”
মাহাতো, কুরমি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের এই বাঁধনা পরব আসলে আমন চাষের শেষে গরুগাভীদের বন্দনা। তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। আসলে বাঁধনা শব্দ এসেছে বন্ধন থেকে। কারণ এই পরবের শেষ দিন অর্থাৎ ভাইফোঁটার দিন খুঁটিতে গরুদের বেঁধে শারীরিক কসরৎ করানো হয়। সেই সঙ্গে গাওয়া হয় বিশেষ জাগরণ গীত। সেইসঙ্গে গোরুর পুজো করা হয়। তাকে ঘাস, খড় খাওয়ানো হয়। শেষ দিনের যে অনুষ্ঠান হয় তাকে বলে গরু খোঁটান। এদিন গরুর গায়ে আলতা দিয়ে ছাপ দেওয়া হয়। তাকে পুজো করে গলায় একটা ঘন্টি বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তাক সামনে একটি মৃত গরুর চামড়া ধরা হয়। সেই চামড়া দেখে সে প্রতিপক্ষ দেখে খোঁটাতে আসে। যেখান থেকে এই পরবের নাম এমনটা হয়েছে। ‘গরু খোঁটানে’র সময় সমবেত গান করা হয়, “এতদিন চরালি ভালা, কোচাখুঁদি রে, আজ তো দেখিব মরদানি/ চার ঠেঙে নাচবি, দুই শিঙে মারবি, রাখিবি বাগাল ভাইয়ের নাম.....।”
প্রিয় পোষ্যদের তদারকি করছেন গৃহকর্ত্রী
প্রিয় পোষ্যদের তদারকি করছেন গৃহকর্ত্রী।
এদিন বাঁধনা উপলক্ষ্যে প্রতি বাড়িতেই সুন্দর সুন্দর পিঠে তৈরী হয়। বলা ভালো এই পরবের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়ে যায় মকর সংক্রান্তির প্রস্তুতি। দুর্গাপুজোয় নন, বরং এই সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের নতুন জামা হয় বাঁধনায়। সেই সঙ্গে মাটির প্রদীপ, কুলো, ঝুড়ি কেনাকাটা চলে। তিলের তেল দিয়ে সেদিন সারারাত গোয়াল ঘরে জ্বালিয়ে রাখা হয় প্রদীপ। আর একসঙ্গে বেজে ওঠে ঢাক, মাদল।
জঙ্গলমহলে দাঁতালরা দাপিয়ে বেড়ালেও ভাটা পড়েনি এই উৎসবে। খোয়াবগাঁয়ের এই বাসিন্দারা সারা রাত ধরে আলপনা দিলেন। উঠোন ভরে উঠল তাঁদের কারুকার্যে। সেই সঙ্গে জাগরণ গান গাইলেন। লাঙল, কোদাল সামনে রেখে চলল পুজোও। হেমন্তের মরশুমে জঙ্গলমহলে কড়া নাড়ছে শীত। আর কয়েকমাস পর মাঠ ভরে উঠবে ফসলে। তারপরই ঘরে ঘরে শুরু হবে নবান্নের উৎসব। আসবেন টুসু।
কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতিথিতে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম গোপালন শুরু করেন। তাই এই দিনটি গোপাষ্টমী হিসেবে পালন করা হয়। বাঁধনা হোক বা গোপাষ্টমী সবই কিন্তু বাংলার কৃষিকাজের কথা মাথায় রেখেই।
গোঠপূজা
অমাবস্যার দিন গোয়ালের সবচেয়ে বৃদ্ধ গরু বা মোষের শিংয়ে কড়চার তেল মাখিয়ে গোয়ালের অন্য গরুদের শিংয়ে তেল মাখানো হয়। বিকেলবেলায় গ্রামের মোড়ে গরুগুলিকে একত্র করা হয়। মাঠের ভেতরে চালের গুঁড়ো দিয়ে ঘর কেটে ছাঁদনদড়ি ও বাঁধনদড়ির পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজাকে গোঠপূজা বলা হয়। পূজা শেষ হলে আলপ্না এঁকে তার ভেতরে ডিম রেখে দেওয়া হয়। এরপর ঢাক, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হলে গরুগুলি ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কোন গরু সেই ডিম মাড়িয়ে দেয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা হয় এবং সেই গরুর মাথায় তেল, সিঁদুর ও ধানের শীষ দিয়ে সাজানো হয়।
কাচিজিয়ারি
অমাবস্যার সন্ধ্যাবলায় বাড়ির বিভিন্ন অংশ, তুলসীতলা, কুয়ো তলা প্রভৃতি স্থানের জানালায় কাঁঠাল বা শাল গাছের পাতায় চালের গুঁড়োর ভেতরে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই রীতিকে কাচিজিয়ারি বলা হয়ে থাকে।
জাগরণ
রাত্রে গৃহিনীরা নতুন বস্ত্র পরিধান করে কুলোয় ধান, দূর্বা, আমের পল্লব, হলুদ জল ও ধূপ ধূনা দিয়ে নিম্নে বর্ণিত ছড়া সুর করে গেয়ে গরুকে বরণ করেন। গভীর রাতে গোয়ালে ঘিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ও উঠোনে কাঠের আগুন জ্বেলে রাখা হয়। যুবকেরা বাড়িতে বাড়িতে গরুদের জাগিয়ে রাখতে যান। এই যুবকদের ধাঁগড়িয়া বা ধাঁগড় বলা হয়। তারা অহীরা গান করে ও বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গেলে গৃহস্থরা তাদের স্বাগত জানান। গৃহবধূরা পিটুলী গোলার সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে ধাঁগড়িয়াদের সঙ্গে হোলি খেলেন।
গরয়া গোঁসাই পূজা
অমাবস্যার পরের দিন লাঙল, জোয়াল, মই প্রভৃতি চাষের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা হয়। গৃহকর্তা জমি থেকে এক আঁটি ধান কেটে এনে ধানের শীষ দিয়ে অলঙ্কার তৈরী করে গরু বা মোষের শিংয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। চাষের যন্ত্রপাতিগুলিকে পূজার পরে ঘরের ছাদে রেখে আসা হয়। এগুলিকে মাঘ মাসের প্রথম দিনে হালপুহ্নার দিনে নামিয়ে আনা হয়।
গরুখুঁটা
ভাইফোঁটার দিনে গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা বা বুঢ়ীবাঁধনা নামক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানে কিছু গরু বা মোষকে নির্বাচন করে তাদের গায়ে লাল ছোপ এবং কপাল ও শিংয়ে তেল ও সিঁদুর লাগিয়ে গলায় মালা, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে তাদের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। এরপর গরুর সামনে চামড়া রেখে চারদিক থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গরুগুলিকে উত্তেজিত করলে সেগুলি চামড়াগুলিকে গুতো দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে চলে অহীরা গান ও নাচ।
এই পরব এখন প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কৃষিপ্রধান গ্রামগুলিতে। বাড়িতে গরু থাকলেই এই পুজো হয়ে থাকে। উড়িষ্যা ও তার পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি এবং তার পরের দিন
প্রতিপদ তিথিতে এই পুজো হয়ে আসছে। গরু আমাদের সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধার বিষয়। এই বিশেষ দিনে তাই ওই সম্প্রদায় কে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে পূজা অর্চনা করা হয়। লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ এই পরব সময় মেনে বহু প্রাচীন। সভ্যতার অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্কৃতি এখনো সমানভাবে গুরুত্ব নিয়ে বেঁচে আছে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
তথ্যঋণ - আনন্দবাজার পত্রিকা ও
উইকিপিডিয়া
No comments:
Post a Comment