Thursday, 10 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
       জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
                         সমরেশ বসু
                       (কালকূট,  ভ্রমর)
===========//////=========///////======
         Doinik sabder methopath
           Vol -218. Dt -11.12.2020
               ২৫ অগ্রহায়ণ,১৪২৭. শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷√√√√×÷÷÷÷÷÷÷√√√√×÷÷÷÷÷
রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম একজন কথাসাহিত্যিক হলেন সমরেশ বসু। প্রথাগত বিদ্যা বা দারিদ্রতা যে মহান প্রতিভাকে কোনদিন আটকে রাখতে পারেনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সমরেশ বসু। অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনগরে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। পিতা মোহিনীমোহন বসু তাঁর নাম দিয়েছিলেন 'সুরথনাথ' কিন্তু পরবর্তীতে তা সমরেশ বসুতে পরিণত হয়। ছোটবেলা থেকে বন্ধনহীন ,চঞ্চল সমরেশের পড়াশুনার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিলনা।লেখাপড়া শিকেয় তুলে বাইরের প্রকৃতিরটানে সে ঢাকার বিস্তীর্ণ শহরতলীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন সবসময়।যখন তাঁর বয়স মাত্র বারো বছর তখন তিনি নয় বছরের এক বালিকার প্রেমে পড়েন। ছেলের এই অকালপক্কতার কথা জানতে পারা মাত্রই পিতা মোহিনীমোহন তাঁকে বড়দাদা মন্মথনাথের কাছে নৈহাটিতে পাঠিয়ে দেন। দাদা সেখানে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেও সমরেশের অাচরণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না এবং তিনি পরিক্ষায় অকৃতকার্য হন। ফলস্বরূপ দাদা মন্মথনাথ তাকে আবার ঢাকায় নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সমরেশের এইরূপ আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পিতা মোহিনীমোহন তাঁকে 'ঢাকেশ্বরী কটন মিলে' কাজে লাগিয়ে দেন।
       কিন্তু ছোটবেলা থেকেই যে নিজেকে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে রেখেছে তাঁর পক্ষে এই মিলের বাঁধাধরা কাজ কীভাবে করা সম্ভব? তাই সেখানেও তাঁর মন বসল না আবার ফিরে গেলেন দাদার কাছে নৈহাটিতে। এখানে আসার কিছুদিন পরেই সমরেশ অাক্রান্ত হলেন ম্যালেরিয়া ও জন্ডিস রোগে। কিন্তু দাদা ছিলেন তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। এইরূপ অবস্থায় বন্ধু দেবশঙ্করের স্বামী বিচ্ছিন্না দিদি গৌরির সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং এই সূত্র ধরেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যান। গৌরিদেবী ছিলেন সমরেশের থেকে চার বছরের বড় ও ব্রাহ্মণ কন্যা। তা সত্ত্বেও সমাজের সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে তিনি গৌরিদেবী কে নিয়ে চলে আসেন অাটপুরের বস্তিতে।

       নানান অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন শুরু হয়। সমরেশ বসু তখন পুরোপুরি বেকার তাই পেটের দুটো ভাতের জন্য তাকে অনেক নীচু কাজও করতে হয়েছে। কখনও তিনি সবজির বোঝা মাথায় নিয়ে সবজি বিক্রি করেছেন আবার কখনও কখনও সাহেব বাবুদের কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে ডিম ফেরি করে বেড়িয়েছেন।তিনি নিজেই বলেছেন -- "সপ্তাহে তিনচার দিন আমাদের দুজনের খাওয়া জুটত"।
এরপর ১৯৪২ খ্রি: তাঁর পরিচয় ঘটে কমিউনিস্ট নেতা সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের সঙ্গে। তিনি সমরেশকে চটকল এলাকায় কিছু কাজের দায়িত্ব দেন। সত্যপ্রসন্নের সংস্পর্শে আসার পরই তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেন। সত্যবাবু সমরেশকে নানাভাবে সাহায্য করতেন তার জন্যই 'ইন্সপেক্টরেট অফ স্মল আর্মস'-এর ড্রয়িং অফিসে সমরেশ বসু চাকরি পান। ফলে আভাব যেমন কিছুটা কমে তেমনি রাজনীতির আঁচ গায়ে এসে লাগে। এরপর তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন এবং সাংস্কৃতিক ঘষা-মাজা ও অনুশীলনের দ্বারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করেন। এইসময় সত্যমাস্টার এবং উদয়ন পাঠাগারের হাতের লেখা 'উদয়ন' পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সমরেশ বসুর জীবন এক নতুন পথে বাঁক নেয়।

      ১৯৪৪সালে তিনি ও গৌরিদেবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির ঋণের কথা স্বীকার করে পরবর্তীতে সমরেশ বসু নিজেই বলেন--- " কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসার পরেই আমার চারপাশের জগত ও মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টি সজাগ হয়।আমার অভিজ্ঞাতর প্রসার ঘটে। "কিন্তু পার্টির প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ছেদ পড়ে অল্প সময়েই। কারন হঠাৎ সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু ঘটে। তিনি মনে করেছিলেন এটা কমিউনিস্ট পার্টির অন্তঃকারসাজি এবং এই ঘটনায় পার্টির অন্যান্য নেতাদের প্রতি তিনি ঘৃণায় ফেটে পড়েন। 
১৯৪৯ এ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি গ্রেফতার হন। পার্টিকে তিনি ভালোবাসতেন আর এই ভালোবাসাকে কোন অবস্থায় ক্ষুণ্ণ করতে না চাওয়ায় তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৫১ তে তাঁর চাকরিও চলে যায়। এরপর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করে। কারাগারে বসেই লিখতে শুরু করেন 'উত্তরঙ্গ' শুরু হয় এই মহান শিল্পীর মহৎ যাত্রা।


সৃষ্টিকর্ম:-
১৯৪৬ সালে 'পরিচয়' পত্রিকায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প "আদাব" প্রকাশীত হয়। এরপর ১৯৫০-১৯৫৫ এই দীর্ঘ পাঁচ বছর তাঁর সাহিত্য জীবনের যথার্থ সংগ্রামের পর্ব।এইসময় তিনি একে একে ' উত্তরঙ্গ','বি.টি.রোডের ধারে','শ্রীমতি কাফে ' প্রভৃতি।তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি নীচে দেওয়া হল---

উপন্যাস:--
উত্তরঙ্গ(১৯৫১), নয়নপুরের মাটি(১৯৫২), বি.টি.রোডের ধারে'(১৯৫২), 'শ্রীমতি কাফে(১৯৫৩), গঙ্গা (১৯৫৭), ত্রিধারা(১৯৫৭),পুতুলের খেলা (১৯৫৮), বাঘিনী (১৯৬০), দুরন্ত চড়াই (১৯৫৮), ছিন্নবাধা (১৯৬২), ফেরাই(১৯৬৪),বিবর(১৯৬৫),স্বীকারোক্তি (১৯৬৭),প্রজাপতি (১৯৬৭),আত্মজ(১৯৬৭),অপরিচিত (১৯৬৮), পদক্ষেপ (১৯৬৮),অচিনপুর(১৯৬৮), বিষের স্বাদ(১৯৭০), ওদের বলতে দাও(১৯৭২), অশ্লীল (১৯৭৩), ত্রিধারা(১৯৭৩), পথিক(১৯৭৩), প্রাচীর(১৯৭৪), সংকট(১৯৭৭), মহাকালের রথের ঘোড়া(১৯৭৭), শেষ অধ্যায়(১৯৭৯), মরীচিকা(১৯৭৯), তিনপুরুষ (১৯৮৬), উদ্ধার(১৯৮৭), প্রকৃতি(১৯৮৭) প্রভৃতি।

গল্পগ্রন্থ:---
মরশুমের একদিন(১৯৫৩), অকাল বৃষ্টি(১৯৫৩), ষষ্ট ঋতু(১৯৫৬),বনলতা(১৯৬৭), পাপপুণ্য (১৯৬৭), শ্রেষ্ট গল্প(১৯৬৭), হ্রেষাধ্বনি(১৯৭৩), কামনাবাসনা(১৯৭২), নাচঘর(১৯৭৬),কুন্তীসংবাদ(১৯৭৬) ,বিবরমুক্ত(১৯৮০), ছায়াচারিনী(১৯৮৩), বাছাই গল্প(১৯৮৫), ছোট ছোট ঢেউ(১৯৭৭), বিবেকবান ভীরু(১৯৮৬) প্রভৃতি।

কিশোর সাহিত্য সমূহ:
মোক্তার দাদুর কেতু বধ(১৯৭৫), বদ্ধ ঘরের আওয়াজ(১৯৭৯), গোগল চিক্কুস নাগাল্যান্ডে(১৯৮৩), সেই গাড়ির খোঁজে(১৯৮৪), ভুল বাড়িতে ঢুকে(১৯৮৬), জঙ্গল মহলে গোগল(১৯৮৭), বিদেশী গাড়ির বিপদ(১৯৮৮) প্রভৃতি।

ছদ্মনাম :
কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি ছিল তার ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধর্মী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে তিনি অমৃতের সন্ধান করেছেন। তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ অমৃত বিষের পাত্রে, মন মেরামতের আশায়, হারায়ে সেই মানুষে, তুষার শৃঙ্গের পদতলে ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস ।

ভ্রমর ছদ্মনামে লেখা তিনটে উপন্যাস ১৩৮৯, ১৩৯০ ও ১৩৯১ বঙ্গাব্দের শারদীয়া প্রসাদএ প্রকাশিত হয়:'যুদ্ধের শেষ সেনাপতি' , 'প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত' , 'প্রেম - কাব্য - রক্ত'।

পুরস্কার :
ছদ্মনামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।

মৃত্যু :
সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল দশ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে। এই উপন্যাসের চিত্রাঙ্কন করেন প্রচ্ছদ শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆



No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...