∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
নাট্যকার মনোজ মিত্র
≠===============================
Doinik Sabder Methopath
Vol -228. Dt -22.12.2020
৬ পৌষ, ১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নাট্যকার মনোজ মিত্র : সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
--------------------------------------------------------
মনোজ মিত্র সাম্প্রতিক কালের একজন বিখ্যাত নট ও নাট্যকার। তাঁর জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে অধুনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা গ্রামে। সম্পর্কে তিনি হলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের দাদা। তিনি কোলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে স্নাতক এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে। সুদীর্ঘকাল অধ্যাপনার পর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের শিশিরকুমার ভাদুড়ি অধ্যাপক থাকাকালীন তিনি অবসর গ্রহণ করেন। লেখক জীবনে তিনি গল্প দিয়ে সাহিত্যিক জীবন শুরু করলেও নাটক রচনা করেই তিনি বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি একাধারে নট, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, প্রযোজক, চলচ্চিত্রাভিনেতা এবং নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা-নির্দেশক। যেমন অভিনয়ে, নাট্যরস সৃজনে তাঁর দক্ষতা অবিসংবাদিত। বিদেশী নাটকের অনুবাদ নয়, তিনি মৌলিক নাটক রচনা করেই সর্বাধিক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
তিনি নাট্যজগতে প্রবেশ করেন একাঙ্ক নাটক রচনার সূত্র ধরে। তাঁর প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার আগে এই নাটকটি ১৯৫৯ সালে থিয়েটার সেন্টার আয়োজিত একাঙ্ক নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম অভিনীত ও পুরস্কৃত হয়। এছাড়া তাঁর রচিত বিভিন্ন একাঙ্ক নাটকগুলি হলো ‘পাখির চোখ’ (১৯৬৭), ‘টাপুর টুপুর’ (১৯৬৯), ‘প্রভাত ফিরে এসো’ (১৯৮৭), ‘অশ্বত্থামা’, ‘পাখি’, ‘কালবিহঙ্গ’, ‘কাকচরিত্র’, ‘বেকার বিদ্যালঙ্কার’, ‘আমি মদন বলছি’, ‘পুঁটি রামায়ণ’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘শিবের অসাধ্য’ ইত্যাদি। তাঁর ‘মৃত্যুর চোখে জল’ একাঙ্ক নাটকটি বৃদ্ধ বঙ্কিমের জীবনে বেঁচে থাকার উদগ্র বাসনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন একাঙ্ক নাটকগুলি হাল্কা কমেডির ঢঙে রচিত। তাঁর বিভিন্ন নাটকে কৌতুক রস পরিবেশন করার সাথে সাথেই সেইসব নাটকগুলিতে দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, প্রকাশিত হয়েছে। এরই সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্তবেদনা প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো ‘মৃত্যুর চোখে জল’ (১৯৬০), ‘নীলকণ্ঠের বিষ’ (১৯৬৫), ‘পাখির চোখ’ (১৯৬৭), ‘টাপুর টুপুর’ (১৯৬৯), ‘অবসন্ন প্রজাপতি’ (১৯৬৭), ‘চাকভাঙা মধু’ (১৯৭১), ‘পরবাস’ (১৯৭৫), ‘সাজানো বাগান’ (১৯৭৭), ‘মেষ ও রাক্ষস’ (১৯৮০), ‘প্রভাত ফিরে এসো’ (১৯৭৮), ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘টু-ইন-ওয়ান’, ‘কেনারাম বেচারাম’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘নৈশভোজ’, ‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘গল্প হেকিম সাহেব’, ‘কিনু কাহারের থেটার’ ইত্যাদি। নাট্য রচনার প্রথম থেকেই তিনি বাংলার মাটির কাছাকাছি চলে গেছেন। সেজন্য তাঁর নাটক মধ্যবিত্ত স্বভাবের বাইরে ‘সাজানো বাগান’ নাটকে কৃষক জীবনের এবং ‘চাকভাঙা মধু’ নাটকে লোকজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষারই কথা বিশেষ করে ফুটে উঠেছে। তাঁর নাটক যে কৌতুকরস তা যেমন সহজ সরল তেমনি অর্থপূর্ণ।
মনোজ মিত্রের ‘নীলকণ্ঠের বিষ’, ‘তক্ষক’ (১৯৭৯) এবং ‘কামধেনু’ও মনস্তত্ত্বমূলক নাটক। সবগুলিই মঞ্চসফল নাটক। ‘তক্ষক’ নাটকে আমরা দেখতে পাই, রোমান ক্যাথলিক গীর্জার পাদরী লংম্যান একজন মেয়েকে ভালোবাসার অপরাধে একটি গীর্জার বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ পরিবেশে পরিত্যক্ত হল। তবুও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অটুট থাকল। ঘটনাচক্রে এই পাদরী কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করতে গিয়ে নিজেই কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। এজন্যই নাটকের নামকরণ।
মনোজ মিত্রের ‘চাকভাঙা মধু’ একটি বহুজন সমাদৃত নাটক। এই নাটকটি ১৬ই মে ১৯৭২-এ রঙ্গনা থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায়। এই নাটকের কাহিনি হলো সুন্দরবন অঞ্চলের মহাজনের অত্যাচারে পীড়িত এক ওঝা পরিবারের কথা। তাঁর ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি কৃষকজীবন কেন্দ্রিক। একটি সাধের বাগানকে কেন্দ্র করে একপক্ষের লোভ এবং অন্যপক্ষের স্বপ্ন-সম্ভাবনা কেমন আকার নিয়েছিল, তা-ই নাটকে বিবৃত হয়েছে। ‘সাজানো বাগান’-এর মালিক ছিল হতদরিদ্র ও হৃতবল বাঞ্ছারাম। বাঞ্ছারামের মাটির প্রতি এতই ছিল যে, সে দারিদ্র্যের মধ্যেও কোনোদিন তার বাগানটিকে হাতছাড়া করতে চায়নি। প্রচুর প্রলোভন সত্ত্বেও নয়। তাঁর ‘নরক গুলজার’ (১৯৭৬) থিয়েটার ওয়ার্কশপের সুপ্রযোজিত নাটক। প্রথম অভিনীত হয় ২৭-এ ডিসেম্বর ১৯৭৬ সালে রঙ্গনা থিয়েটারে। মানিক ও ফুল্লরার দুঃখদারিদ্র্যপীড়িত জীবন অবলম্বনে কিছু করুণ রসের বিস্তার এই নাটকে লক্ষ করা যায়।
নাট্যকার মনোজ মিত্র একাধিক নাট্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন, ‘সুন্দরম’, ‘গন্ধর্ব’, ‘বাতায়ন’, ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’, ‘প্রতিকৃতি’, ‘স্বপ্নসন্ধানী’ প্রভৃতি। তিনি হলেন ‘সুন্দরম’ নাট্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-নির্দেশক ও অভিনেতা। ‘দেশ’ পত্রিকা সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত নাটক রচনা করেছেন। এছাড়া তিনি অভিনয় বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থও রচনা করেছেন। তাঁর নাটক বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ছোটদের জন্যে লেখালেখিতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। অভিনেতা হিসেবেও তিনি সবার প্রিয় মানুষ। তিনি বাংলা চলচ্ছিত্র ও দূরদর্শনের একজন নিয়মিত সুদক্ষ শিল্পী। বিশেষ করে ‘সাজানো বাগান’-এর বাঞ্ছারাম চরিত্রাভিনয়ে তাঁকে অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করে। নাট্যরচনা ও অভিনয়ের জন্য তিনি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৫-তে নাটক রচনার জন্যে জাতীয় স্তরে সংগীতনাটক আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর নাটকগুলি জীবনসত্যের রূপায়ণে, তথ্যের স্বচ্ছতায় ও নাটকীয়তায় আকর্ষণীয় হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ :
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (আধুনিক যুগ, ১৯৫০ – ২০০০) – ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য।
লেখক পরিচিতি :
শ্রী লিল্টু মণ্ডল
সহ কলেজ শিক্ষক
বাংলা বিভাগ, সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment