Monday, 28 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
      বিশেষ আলোচনা পর্ব

         বিভূতিভূষণের "রমা"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     Doinik Sabder Methopath
     Vol -236. Dt -29.12.2020
       ১২ পৌষ,১৪২৭. মঙ্গলবার
=================================

কিছু না হোক, অন্তত একটি সুবিধে আপনি হয়েছিল৷ সেই ১৯৩৯ সালের গোড়ার দিকেই রমা ম্যাট্রিক সেশন পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিল এবং সফলও হয়েছিল৷ কিন্ত্ত ষোড়শীকান্তের বদলির নোটিশে মেয়ের উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনাটি মুলতুবি হয়ে রইল৷ মাতৃহীনা কন্যাটি কলেজে পড়বে, এবং অতঃপর তার জন্য উপযুক্ত পাত্র সন্ধান করবেন, এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন ষোড়শীকান্ত৷ কিন্ত্ত বনগাঁয় কাজ করতে গেলে, সে সন্ধান বিঘ্নিত হবে জানতেন, অথচ নিরুপায় তিনি৷ কী ভাগ্যিস বড়োটির বিবাহ হয়ে গিয়েছিল৷

রমার অবশ্য কোনও হেলদোল তাঁর চোখে পড়ল না৷ তা সত্ত্বেও সংবাদটি তাকে জানিয়ে বললেন, সরকার যদি বদলি করে, আমার তো না গিয়ে উপায় নেই৷ কিন্ত্ত তোর জন্যই যে চিন্তা মা৷
রমা একই সঙ্গে বুদ্ধিমতী ও আন্তরিক মেয়ে৷ দেখতে শুনতেও সুশ্রী৷ গায়ের রং শ্যামবর্ণা বটে, তা হলেও সুগঠিত, স্বাস্থ্যবতী এবং স্বভাবে নম্র, ভদ্র এবং খুবই অনুভূতিশীল মেয়ে৷ জানে, বনগাঁ যাওয়ার ব্যাপারে সে যদি সামান্য আপত্তিও করে, বাবা মানসিক ভাবে বিচলিত হবেন এবং শুধু তাই না, হয়তো কোনও ভাবে রমার কলকাতায় থাকার আয়োজনও করতে পারেন৷ কিন্ত্ত তার তো সত্যি সত্যিই কোনও আপত্তি নেই বনগাঁ যেতে৷ এবং বিভিন্ন স্থানে বসবাস করলে মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়, দেখাশোনার চোখকান খোলা, এমনটাই ওর মনে হয়৷ নিজে কিছু সাহিত্যচর্চা এবং রচনাও করে রমা৷
তুমি কি জানো, আমাদের এই বনগাঁয়ে বিভূতিভূষণ থাকেন! রমা অবাক হয়ে বলল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়! পথের পাঁচালীর লেখক? হ্যাঁ ভাই তিনিই৷ এখন এ শহরেই থাকেন… তবে একটু বাইরের দিকে, নদীর কাছাকাছি৷ রমা দুরন্ত উত্‍সাহে বলল, কবে আমায় নিয়ে যাবে বলো৷ এক বারটি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আসব… আর যদি সুযোগ হয় একটা অটোগ্রাফও নিয়ে আসব৷ ওহ্ আমি ভাবতেই পারছি না৷
কয়েক দিন পরে এক বিকেলে প্রায় দুরুদুরু বক্ষে বেনুর সঙ্গে রমা চলল স্বনামধন্য সাহিত্যিকের বাড়িতে৷ বনগাঁ শহর থেকে একটু পুবের দিকে ছয়ঘেরির কাছাকাছি থাকেন বিভূতিভূষণ৷ আশা করা যায় বাড়িতেই থাকবেন, কেননা এখন তিনি আর অন্য কোনও কাজ করেন না, সাহিত্যচর্চাই তাঁর কাজ ও জীবিকা৷ একটা রিকশা নিয়েছে দুই বন্ধু৷ বিকেলে তাপ খানিকটা কমে এসেছে, ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে৷
বিশেষ করে সেই কারণেই আরও, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় স্থানান্তর, বসবাস এবং জীবনাপনে তার কিছুমাত্র আপত্তি নেই৷ ষোড়শীকান্তর মন্তব্য শুনে রমা বলল, আমার জন্য কীসের চিন্তা বাবা? কেন?
ষোড়শীকান্ত বললেন, গঞ্জ মফস্সল জায়গা… নামে বনগাঁ শহর কিন্ত্ত শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ কি আর ওখানে আছে! তাতে কী হয়েছে বাবা! আমি শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, আধুনিকতা ছাড়া থাকতে পারি না?
পারবি না কেন মা! কিন্ত্ত আর একটু অন্তত কলকাতার কাছে হলে, বোধ হয় তোর আমার দু’জনেরই সুবিধে হত৷ আমি কিন্ত্ত তা মোটেও ভাবছি না বাবা৷ তবে তোমার অসুবিধে হলে আলাদা কথা৷ না-না আমার আর অসুবিধে কী! তোর জন্যই…৷
ষোড়শীকান্তকে শেষ করতে না দিয়েই রমা বলল, আমি কিন্ত্ত খুশিই বাবা৷ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে থাকলে, মনের মধ্যে একঘেয়েমি আসে না৷ নতুন জায়গা, পরিবেশ দেখা যায়, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়৷ তা ছাড়া শহরের মধ্যে বৈচিত্র্য কম বাবা৷ গ্রাম-গঞ্জ-মফস্সলে প্রকৃতিকেও অনেক কাছের থেকে অনুভব করা যায়৷
ষোড়শীকান্তরা থাকেন একতলায়, বাড়িওলা ওপরে৷ বাইরের দিকে সিঁড়ি, সুতরাং ভাড়াটে-বাড়িওলার স্বাধীন বিচরণে কোনও ঠোকাঠুকি নেই৷ দু’টি ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর-বাথরুম- এটুকুর মধ্যে ষোড়শীকান্তরা তিনটি প্রাণী নিজেদের মধ্যে দিব্যি মানিয়ে নিলেন৷ একটু একটু করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হতে লাগল৷ রমার কয়েকটি বান্ধবী জুটে যেতে সময় লাগল না৷ রবীন্দ্র পাঠাগারেও সে যাতায়াত করে৷ বই আনে, পড়ে, প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা দেখে৷
মানুষ যেখানেই বসবাস করে, নিজের পছন্দের মানুষজন সেখান থেকে ঠিক খুঁজে নেয়৷ একটু একটু করে অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়৷ তার পর কয়েকজনের সঙ্গে হয় ঘনিষ্ঠতা৷ ভাবনা আর রুচির স্বতঃস্ফূর্ত মিল অনুভূত হলে ঘনিষ্ঠতা জন্মায়৷
বর্ণালি তথা বেনু নামের মোটামুটি সমবয়সিনী একটি মেয়ের সঙ্গে রমার বেশ ভাব হয়েছে৷ বেনু আবার প্রতিবেশিনীও বটে৷ পাঠাগারে আলাপ, তার পর বাড়িতে যাতায়াত৷ শীতের দিন যাই-যাই করেও যায়নি৷ ইতিমধ্যে মাস তিনেক অতিবাহিত হয়েছে রমারা বনগাঁয় এসেছে৷ প্রকৃতি এ দিকে বেশ খোলামেলা৷ বাতাস এখন দিক্ভ্রান্ত৷ গাছে গাছে নতুন পাতা আসছে৷
দুপুরবেলা গল্প করতে করতে বেনু এক দিন বলল, রমা, তুমি নিশ্চয়ই গল্পটল্প লেখো, তাই না?
রমা হেসে বলল, খুব ইচ্ছে করে… কিন্ত্ত ভাই পারি না৷ তোমার ও কথা মনে হল কেন?
তোমার কথাবার্তা, মাঝে মাঝে যে ভাবে বর্ণনা করো… সেই সব শুনেই মনে হয়৷ গল্প ছাড়া আর অন্য কিছুও কি লেখো? ওই যে বললাম… ইচ্ছে করে কিন্ত্ত পারি না৷ তবে চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই৷
তাই তো৷ সারা জীবন ধরে আমরা যা কিছু করি, সে তো কিছু চেষ্টারই সমষ্টি৷
কথাটা বেশ ভালো বলেছো তো৷ ভেবে দেখলে সত্যি তাইবেনু এর পর থেকে প্রায় নিয়মিত রমাকে উত্‍সাহিত করে লেখার জন্য৷ রমাও সময় সুযোগ মতো আবার চর্চা শুরু করে দেয়৷ স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় টুকটাক করে রমার একটা-দুটো রচনা প্রকাশিতও হচ্ছে৷ সে নিজেও টের পায়, তার সাহিত্য মনস্কতা একটা মাত্রা পাচ্ছে৷ এ রকম সময়ে বেনু এক দিন খুব ভালো একটা খবর দিল রমাকে৷
অটোগ্রাফ খাতাটি বুকে চেপে, বাড়ি থেকে একটু দূরেই রিকশা থেকে নেমে পড়ল দুই বন্ধু৷ তার পর হাঁটতে হাঁটতে বিভূতিভূষণের বাড়ি৷ একটেরে, একতলা বাড়ি৷ বেশ খানিকটা চ্যাঁচাড়ি বাঁশের বেড়া দেওয়া বাগান, সামনে বেড়ার ফটক৷ বাগানে কিছু ফুল ফুটে রয়েছে- চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, দোপাটি৷ বাড়ির এক পাশের পাঁচিল বেয়ে ছাদে লতিয়ে উঠেছে ফনফনে লাউডগা৷ ফটকের কাছে দু’জন পৌঁছতেই মালিগোছের একটি লোক এগিয়ে এল৷ বেনু জিজ্ঞেস করল, বিভূতিভূষণবাবু কি আছেন বাড়িতে? আমরা একটু দেখা করব৷
লোকটি গেট খুলে দিয়ে বলল, আসুন৷ বাড়িতেই আছেন… কিন্ত্ত দেখা করবেন কি না… আমি খবর দিচ্ছি৷
পায়ে পায়ে বাগানের মাঝখানে সরু পথ দিয়ে রমা আর বেনু পাকাবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল৷ সামনে দু’ধাপ সিঁড়ি, তার পর লাল মেঝের বারান্দা, উপরে ছাদ সামনে খোলা৷ পিছনে অন্দরমহলে ঢোকার দরজা, একটু হাঁটু পর্যন্ত মলিন পর্দা ঝুলছে সামনে৷ সেইটি সরিয়ে বছর ত্রিশের এক আটপৌরে মহিলা বেরিয়ে এলেন৷ রমা এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার৷ আমার নাম রমা চট্টোপাধ্যায়, আর এই আমার বন্ধু বর্ণালি৷ আমরা কি এক বার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?... মানে… বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়…৷
মহিলা বললেন, আসুন৷ আমি ওঁর ভাগনি, আমার নাম উমা৷ আপনারা বসুন, আমি খবর দিচ্ছি৷
বলতে বলতে বারান্দাতেই একটা মাদুর পেতে দিলেন উমা৷ আবার বললেন, মামার মনটা ভালো নেই আজ৷ রমা দ্রুত বলল, আচ্ছা তা হলে না হয় থাক… আমরা পরে আর এক দিন আসব৷
উমা বললেন, বসুন তো আগে, মামাকে জিজ্ঞেস করে আসি৷ বনগাঁতে থাকেন আপনারা? আজ্ঞে হ্যাঁ… পালপাড়ায়, রবীন্দ্র পাঠাগারের কাছে৷
উমা ভেতরে চলে গেলেন৷ মিনিট দশেক পরে আবার বেরিয়ে এলেন৷ হাতে দু’কাপ চা আর নিমকি বিস্কুট৷ রমা আর বেনুর সামনে নামিয়ে বললেন, মামা আসছেন, আপনারা চা খান৷ আমি একটু কাজে ব্যস্ত আছি… আসছি৷
কিছুক্ষণ পরেই লেখক এলেন৷ পরনে ধুতি, হাফহাতা গেঞ্জি৷ মধ্যবয়সী, প্রায় ষোড়শীকান্তর মতোই হবে মনে হল রমার৷ মুখে একটা উদাস চিন্তাচ্ছন্ন ভাব৷ মাঝারি গায়ের রং, মাঝারি উচ্চতা৷ মাদুরের উপরেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই রমা ও বেনু তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে৷ বিভূতিভূষণ বুকের সামনে নমস্কারের ভঙ্গিতে দু’হাত জড়ো করে বললেন, থাক থাক, বসুন৷
সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তার সূচনা করলেন বিভূতিভূষণই৷ কোথায় থাকেন, কী করেন, বাড়িতে আর কে আছেন, কী রকম বই-টই পড়েন, সাহিত্যে উত্‍সাহ কেন, নিজেরা চর্চা করেন কিনা… ইত্যাদি কথাবার্তা হল৷ রমাই অধিকাংশ কথার উত্তর দিল৷ এবং মনে মনে অনুভব করল, একটি মুগ্ধ আনন্দের স্রোতে ও ভেসে যাচ্ছে, এই নিরাড়ম্বর অথচ প্রখর অনুভূতিশীল, হূদয়বান-প্রকৃতি প্রেমিক-আন্তরিক-বিবেকবান- ভাষার জাদুকরটির সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে৷ দিনটি বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে রমার জীবনে৷
একটু পরেই অটোগ্রাফের খাতাটি বিভূতিভূষণের কাছে বাড়িয়ে ধরল রমা৷ বিজড়িত সংকোচ সত্ত্বেও বলে ফেলল, একটা কিছু কথা যদি লিখে দেন, আমি সারা জীবন কৃতার্থ বোধ করব৷
খুব হালকা একটা হাসির আভাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন বিভূতিভূষণ৷ কিন্ত্ত যেন পারছেন না৷ খাতাটা টেনে নিলেন অবশ্য৷ সহজ ভাবেই মুক্তাক্ষরে লিখে দিলেন, ‘গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু’৷ তার পর নাম সই করে তারিখ দিলেন৷
গভীর আগ্রহে খাতার লেখাটি দেখতে দেখতে রমার মনে হল, এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি তার জীবনে ইতিপূর্বে ঘটেনি৷ ফিরে আসার আগে, সনির্বন্ধ অনুরোধের মতো রমা বলল, আপনি যদি এক দিন আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন… আমার বাবা এবং আমরা সকলেই ভীষণ খুশি হব৷ আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব৷
বিভূতিভূষণ বললেন, তার কোনও প্রয়োজন নেই৷ আমি নিশ্চয়ই এক দিন যাব, কিন্ত্ত কবে তা এখনই বলতে পারছি না৷ রমা বলল, সে ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে যাব৷ আজ আপনার মনটা ভালো নেই… দিদি বলছিলেন৷ বিভূতিভূষণ বললেন, আজ আমার বোন জাহ্নবী পিয়ালী নদীতে স্নান করতে গিয়ে ঘাট থেকে আর ফেরেনি৷ বেনু ও রমা দু’জনেই তড়িদাহতের মতো বলল, সে কী!
বিভূতিভূষণ বললেন, খোঁজাখুঁজি চলছে… হয়তো জলেই ডুবে গিয়ে থাকবে৷ মনটা তাই বড়ো খারাপ৷ রমা বলল, ইশশ্… আর তার মধ্যে আমরা এতক্ষণ ধরে…৷ তাইতে আপনাদের কোনও দোষ হয়নি৷ বিভূতিভূষণ বললেন৷ কিন্ত্ত আমি আপনাদের ঠিকমতো অভ্যর্থনা করতে পারিনি আজ… পরে অবশ্যই আর এক দিন আসবেন৷

এ দিকে বিভূতিভূষণের সান্নিধ্যে আসার পর থেকে, সাহিত্য রচনার দুরন্ত প্রেরণা অনুভব করে রমা৷ আগেও লিখতো, কিন্ত্ত এ বার নিয়মিত বসার জন্যই তার লেখাপত্র প্রকাশিত হতে লাগল পত্র-পত্রিকায়৷ সুযোগ পেলেই সে প্রখ্যাত সাহিত্যিকটির কাছে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে৷ কেন যেন বিভূতিভূষণও কন্যাসমা এবং তাঁর সাক্ষাত্‍প্রার্থিনী, মুগ্ধ অষ্টাদশী মেয়েটিকে ফেরাতে পারেন না, বরং কিঞ্চিত্‍ প্রশ্রয়ই দেন৷ জীবন এবং অভিজ্ঞতার কথা বলেন৷ তাঁর চাকুরিজীবন, মাস্টারি করা, মেসে বসবাস করার অভিজ্ঞতা, লবটুলিয়ার অরণ্যে ম্যানেজারি করার সময়কার কথা, কত বিচিত্র বিশ্বাস-দারিদ্র-সুখদুঃখ নিয়ে চলা নানান মাপের মানুষের কথা বলেন৷ কেন যে বলেন, নিজেও যেন তার সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেন না৷ অথচ নিভৃত মনে যেন একটি কৌতুক বোধেরই উদয় হয়৷
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে৷
অন্তর্মুখী মনের মানুষ বিভূতিভূষণ৷ শান্ত, ভাবুক৷ এক সময় অফিস-কাছারি, শিক্ষকতা, মেসের বন্ধুদের সঙ্গে কলেজস্ট্রিট পাড়ায় আড্ডার সঙ্গেই সাহিত্য রচনা করেছেন, আবার গার্হস্থ্য জীবনযাপনও করেছেন৷ বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর জীবন ও জীবদ্দশা৷ দারিদ্র থেকে শুরু করে, মানুষের ব্যক্তি জীবনের বেদনা-বঞ্চনা, হতাশা-প্রত্যাশা, আনন্দ, সুখ যেমন গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন, তেমনই আন্তরিক ভাষায়, শব্দে সেই সব উপলব্ধিকে সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলেছেন৷ এক দিকে বঙ্গসাহিত্য দেবতা তাঁকে যেমন অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ করেছেন, অপর দিকে তিনিও আপন সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে এক স্বচ্ছন্দ, প্রীতিময়, ভালোবাসার সরল মানবিক মাত্রা সংযোজন করেছেন৷ ইতিমধ্যেই তাঁর সৃষ্টি-সম্ভার কালজয়ী আখ্যা পেয়েছে৷ অথচ এ সব সত্ত্বেও, অর্ধাঙ্গিনী গৌরীদেবীর অকাল প্রয়াণের পর থেকে, নিঃসঙ্গতাই যেন তাঁর নিত্যসঙ্গী, অবিচ্ছেদ্য ভাবেই জড়িয়ে গেছে অস্তিত্বের সঙ্গে৷

পারিবারিক কর্তব্য পালনে অবশ্য তার পরেও রেহাই নেই বিভূতিভূষণের৷ সাহিত্যকর্ম, চর্চা এবং ধারাবাহিক রচনার উদ্যোগকে তিনি নিজেই ইদানীং সাহিত্য ব্যবসার রসে অভিহিত করেন, এবং যথারীতি ছেদ পড়েনি সেই অভ্যাসেও৷ কিন্ত্ত সব কিছু নিয়ে এই আপাত-নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনেই যেন একটি অদৃশ্য চোরাস্রোতের অস্তিত্ব অনুভব করেন৷ নিশ্চিত হতে পারেন না, আবার অনিশ্চিত ভেবে উপেক্ষাও বা করতে পারছেন কই! জীবনের এমন একটি সময়ে এ কী অন্যতর এক দোলাচলেরই সূচনা!
বনগাঁ শহরের আর এক প্রান্তে ষোড়শীকান্ত যেন আলোআঁধারি এক বিভ্রান্ত অনুভবের শিকার হয়েছেন৷ ঘরে বিবাহযোগ্যা অষ্টাদশী মেয়ে পাত্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত, বাবার একটি অনিবার্য দুশ্চিন্তা থাকাই স্বাভাবিক৷ সে দুশ্চিন্তা লাঘবের জন্য তিনি মানসিক ভাবে প্রস্ত্তত৷ কিন্ত্ত তাঁর বিভ্রান্তি রমাকে নিয়েই৷ লক্ষ করেছেন, বিবাহের কথায় রমা যে খুব অসম্মতি প্রদর্শন করেছে, তা নয়৷ কিন্ত্ত পাত্র নির্বাচনের কথায় মেয়ে কোনও উত্‍সাহ দেখায় না৷ শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী মেয়ে সে৷ তার দিক থেকে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া খুবই জরুরি ষোড়শীকান্তর পক্ষে৷ নতুবা শুধুমাত্র তাঁর নিজের পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত রমার উপর চাপিয়ে দিতে হয়৷ উদারমনা ষোড়শীকান্ত তা করতে চান না৷ তিনি নিজেও শিক্ষিত মানুষ৷ পদস্থ সরকারি অফিসার৷ মেয়ের পূর্ণ সম্মতি ব্যাতিত কোনও পাত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া তাঁরও রুচি এবং নীতিবিরুদ্ধ৷
বিভ্রান্তি আর ভাবনার দোলাচলের মধ্যেই কখনও চকিতে একটি প্রান্তিক সম্ভাবনার প্রশ্ন ষোড়শীকান্তর মনে উঁকি দেয়৷ রমা সাহিত্যঅন্তপ্রাণ৷ নিজে পত্রপত্রিকায় লেখে৷ আবার এ শহরেই দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, কৃতী সাহিত্যিকটিও বসবাস করেন৷ রমা যাতায়াত করে তাঁর কাছে৷ ষোড়শীকান্তও গেছেন তাঁর বাসাবাড়িতে৷
একটি পারিবারিক পরিচয়ের যোগসূত্রও কি রচিত হয়নি! লেখকটি বিপত্নীক, এবং বয়সেও ষোড়শীকান্তর ধারেকাছেই হবেন৷ তথাপি…! ষোড়শীকান্ত বনগাঁয় বদলি হয়ে এসেছেন প্রায় বছর ঘুরতে চলল৷ সরকার কবে আবার স্থানান্তরে পাঠাবে ঠিক নেই৷ ঠাঁইনাড়া হওয়ার আগে রমার বিবাহ দিয়ে দিতে পারলে তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করবেন৷
সুতরাং মনের দোলাচল পাশে সরিয়ে রেখে, নিজেই এক দিন দেখা করতে গেলেন বিভূতিভূষণের সঙ্গে৷ মনে মনে বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিশীল লেখক মা সরস্বতীর বরপুত্র৷ তিনি সজ্জন, আন্তরিক৷
বিভূতিভূষণ বিনম্র হাসিমাখা মুখে বললেন, আমার বিশ্বাস, আপনার সম্ভাব্য প্রশ্নটি সঠিক ভাবনা থেকেই উত্‍সারিত৷ রমা মনে মনে তার স্বামী নির্বাচন করে ফেলেছে বলেই আমার মনে হয়৷
পরম নিশ্চিন্ত ও দ্বিধাহীন মন নিয়ে ষোড়শীকান্ত বাড়ি ফিরলেন৷ কিছু দিন পরেই রমা ও বিভূতিভূষণের শুভবিবাহ সম্পন্ন হল৷ দিনটি ছিল ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ৷ রমার বয়স আঠারো, বিভূতিভূষণের ছেচল্লিশ৷ কিন্ত্ত আঠাশ বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রীতিময়তা ও মানসিকতার নিরিখে, বিবাহের পক্ষে কোনও তরফ থেকেই তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷
কালের দেবতা সে দিন অলক্ষ্য থেকে এই অসমবয়সী বিবাহের পরিণতি বিষয়ে কী লিখে রেখেছিলেন, জানা গেল না৷ কিন্ত্ত বঙ্গ সাহিত্য জগতে এই ঘটনা উত্তরকালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল৷ এবং তা যতখানি প্রতিভাবান লেখকটির সৃষ্টিমালার জন্য, ততখানি তাঁর তরুণী দ্বিতীয়া স্ত্রী রমাদেবীর ভূমিকার জন্যও বটে৷ বয়সে কন্যাসমা হলেও, স্বামীর শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের জন্য রমাদেবী উঠে পড়ে লাগলেন৷ বিবাহের ঘটনাটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরে তিনি সত্যিই অবাক হয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত খুশি আর আনন্দে ভরপুর হলেন তার চেয়েও বেশি৷
বিভূতিভূষণ এক দিন বললেন, আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে এ আমার কল্পনায় ছিল না৷
রমা বললেন, কোন ঘটনার কথা বলছ?
আবার কী! পৌঢ় বয়সে এই বিবাহ৷ কত বিচিত্র আকস্মিকতা যে মানুষের জীবনে থাকে!
রমা বললেন, তাইতে কী! তোমার কি অনুশোচনা হচ্ছে আবার বিয়ে করে?
বিভূতিভূষণ অবাক হয়ে বললেন, ও কী কথা বলছ! অনুশোচনা… সে বরং তোমার হলেও হতে পারে… আমার মতন এমন লোককেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে হল!
করতে তো হয়নি, আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করেছি৷ তা ছাড়া… ঠাকুর কার সঙ্গে কার জোড় বেঁধে রাখেন… কেই বা বলতে পারে! তা অবশ্য ঠিক৷ কিন্ত্ত তোমার ঘাড়ে যে অনেক ঝামেলা পড়ে গেল৷
আমি তা মনে করি না৷ রমা বললেন৷ তুমি যেগুলো ঝামেলা বলে ভাবছো, আমি ভাবি সেগুলোই আমার দায়িত্ব৷ আচ্ছা বেশ, তা-ও না হয় হল৷ কিন্ত্ত আমি মরে যাওয়ার পরে একা এই সব দায়িত্ব নিয়ে…৷
বিভূতিভূষণকে শেষ করতে না দিয়েই, তাঁর মুখের ওপর হাত রাখলেন রমা৷ বললেন, ছি… ও রকম কথা মুখে এনো না৷ বিভূতিভূষণ শ্বাস ফেলে বললেন, জানি, তোমার কষ্ট হয়৷ কিন্ত্ত বাস্তবকে তো অস্বীকারও করা যাবে না৷ রমা একটু পরে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, আমায় আশীর্বাদ কর, যেন সব দায়িত্ব পালন করতে পারি৷
প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসার বাঁধনে এক নিবিড় দাম্পত্য জীবন রচনা করলেন বিভূতিভূষণ ও রমা৷ রমা বোঝেন, ওপর ওপর সাদামাটা, উদাসীন গোছের মনে হলেও, তাঁর স্বামীটি এলেবেলে, যে-সে মানুষ নন৷ যে মানুষ পথের পাঁচালী-অপরাজিত-অপুর সংসার-আরণ্যক রচনা করতে পারেন, তিনি অন্য আর কিছু না লিখলেও বিশ্বসাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন৷ কিশোর সাহিত্যে চাঁদের পাহাড়-ও কালজয়ী সৃষ্টি৷ তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষটি যেমন সংবেদনশীল, শিল্পী মনের অধিকারী, উদার আবার তেমনই রসিক৷ রবীন্দ্রোত্তর যুগে বঙ্গ সাহিত্যাকাশে ইতিমধ্যে তিনি একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন৷

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments: