আলোচনা পর্ব
কবি বিদ্যাপতি ও দ্বিজ চন্ডীদাস এর সাক্ষাৎ
মুঙ্গেরের কষ্টহারিণী গঙ্গাঘাট।
=================================
Doinik sabder methopath
Vol - 252. Dt -15.01.2021
১ লা মাঘ, ১৪২৭. শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সাহিত্যের সীমানা ধরে অনুসন্ধিৎসু মন ঘুরে বেড়িয়েছে নানান ঐতিহাসিক সম্পদ আহরণে প্রাচীন ভারত বর্ষ থেকে আধুনিক ভারতবর্ষের প্রান্তরে প্রান্তরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান উপাদানের অনুষঙ্গ ভিড় করে আছে জেনে উৎসাহী আগ্রহী মন আজও আবিষ্কারের নেশায়, ঐতিহাসিক সত্যতা প্রমাণের নেশায় বুঁদ নয়, তেমনই একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে আজকের আলোকপাত। বৈষ্ণব সাহিত্যের সীমানা ধরে বৈষ্ণবীয় রস প্রকাশ।
মিথিলার কবি বিদ্যাপতি এবং বাঙলার কবি দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাক্ষাৎ হয়েছিল মুঙ্গেরের কষ্টহারিণী গঙ্গাঘাটে, সেই কথা আজকের ক’জন সাহিত্যিক খবর রাখেন ?
সেই ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিতেই আজ মুঙ্গেরের কষ্টহারিণী ঘাটের দিকে আমাদের যাত্রা।
বাংলা সাহিত্যে ছিলেন তিনজন চণ্ডীদাস। এক, বীরভূমের নানুর গ্রামের কবি চণ্ডীদাস। তুর্কি ধর্ম উন্মাদদের হাতে যখন লাঞ্ছিত হচ্ছে বাংলা, তখন নানুরের কবি চণ্ডীদাস নির্ভিক কণ্ঠে ধর্মকে গৌণ বিবেচনা করে মানুষকেই বড়ো বলে ঘোষণা করলেন,
“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।”
এই যে মানবিকতাবাদের জন্ম দিলেন নানুরের কবি চণ্ডীদাস, পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের হাতে তা ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ বিকশিত হয়েছিল ।
নানুরের চণ্ডীদাস ছিলেন বারেন্দ্র শ্রেণির ব্রাহ্মণ। পিতার নাম—দুর্গাদাস বাগচী। চণ্ডীদাস তাঁর লেখায় নিজেকে “দ্বিজ চণ্ডীদাস” বলে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় চণ্ডীদাস ছিলেন বাঁকুড়ার ছাতনায়, মতান্তরে মানভূমের হুড়া থানায়। তিনি ছিলেন উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণ। আসল নাম ছিল—চণ্ডীদাস পাণিগ্রাহী। তিনি তাঁর লেখায় নিজেকে “বড়ু চণ্ডীদাস” বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন।”
এই দুই চণ্ডীদাস ছাড়াও পশ্চিম বর্ধমান এলাকায় আরেক চণ্ডীদাস ছিলেন, তাঁর আসল নাম—চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য।
তবে দ্বিজ চণ্ডীদাস ও বড়ু চণ্ডীদাস—এই দুজন চণ্ডীদাসই বাংলা সাহিত্যে জয়প্রিয়। “বড়ু” মানে মন্দিরের দেবসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি। ( সুকুমার সেন)
বাংলা ও মিথিলায় তখন শুরু হয়েছে সেন রাজাদের শাসন।
উত্তর রাঢ়ের বীরভূম থেকে মুঙ্গেরে হাজির হোন নানুরের দ্বিজ চণ্ডীদাস।
মুঙ্গেরের এই কষ্টহারিণী ঘাটে গঙ্গা উত্তর বাহিনী। ভারতের সাধক পরম্পরায় উত্তর বাহিনী নদীর একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। উত্তর বাহিনী মানে সাধকের সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে এই নদীতটে। তাই দুই কবির সাক্ষাতস্থল হিসেবে এই উত্তর বাহিনী গঙ্গাতীরকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। যদিও এ সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল নেই, তবে জনশ্রুতি রয়েছে। তাই দীর্ঘদিন ধরে পরম্পরায় চলে আসা জনশ্রুতিই এখানে দুই কবির মিলনস্থল হিসেবে সাক্ষ্য দেয়।
দুই কবির এই সাক্ষাতের সময় বিদ্যাপতি ছিলেন প্রবীণ, অন্যদিকে চণ্ডীদাস তখন নবীন। দু’জনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় ৪০ বছর।
বর্তমান বিহারের মধুবনী জেলার বিসপী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বিদ্যাপতি। “বিসর্পী:” থেকে তাঁর গ্রামের নাম হয় “বিসপী।” তাঁদের কৌলিক উপাধি ছিল “ঠাকুর।” বংশপরম্পরায় তাঁরা মিথিলার উচ্চ রাজকর্মচারি পদে আসীন ছিলেন।
মিথিলার সিমারিয়া ঘাটে কবি নিয়মিত গঙ্গাস্নানে আসতেন। স্থানটি তখন ছিল মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত, বর্তমানে এটি বেগুসরাই জেলায় অবস্থিত। প্রাচীন মুঙ্গের থেকেই পরে বেগুসরাই জেলা গঠিত হয়েছে।
কবি বিদ্যাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাংলা থেকে মিথিলায় গিয়েছিলেন এবং নৌকোয় চড়ে গঙ্গা পেরিয়ে মুঙ্গের শহরের এই কষ্টহারিণী ঘাটে পৌঁছেছিলেন।
“মুদগিরি” থেকে “মুঙ্গের” নামটি এসেছে বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত।
আবার কারো কারো মতে, ঋষি মুদগলের নাম থেকে “মুঙ্গের” হয়েছে। আবার কেউ বলেন, গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মৌদগলায়নের নাম থেকে “মুঙ্গের।” কানিংহামের মতে, “মুঙ্গের” নামের সঙ্গে যোগ আছে মুণ্ডা জাতির। আবার সি.ই.এ. ওল্ডহ্যাম জানাচ্ছেন, সম্ভবত মুঙ্গেরের আদি নাম ছিল “মুনিগৃহ।”
বিহারের দক্ষিণে এবং গঙ্গার দক্ষিণ তীরে অবস্থিত মুঙ্গের প্রাচীনকালে অঙ্গ মহাজনপদের অংশ ছিল।
মহাভারতে “মুদগিরি” নামটি পাওয়া যাচ্ছে।
একসময় পালরাজাদের রাজধানী ছিল “মুদগিরি।” পালরাজ দেবপালের লিপিতে “মুদগিরি” নামের উল্লেখ রয়েছে।
কবি বিদ্যাপতি ও দ্বিজ চণ্ডীদাসের সাক্ষাতস্থলের স্মৃতি নিয়ে মুঙ্গেরে আজও বয়ে চলেছে উত্তরবাহিনী গঙ্গা।
বাংলার ইতিহাসের এও প্রায় এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়। প্রাচীন মানুষেরা কালের নিয়মেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, সুতরাং এসব জনশ্রুতি হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসে তৈরি হচ্ছে নতুন করে জেনারেশন গ্যাপ। তাই সেই ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখার চেষ্টা আজকের এই লেখায় ।
ড.বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, বিদ্যাপতির সময়কাল ১৩৮০-১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment