*****************************************
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী
###############################
Doinik Sabder Methopath
Vol -268. Dt -31.01.2021
১৭ মাঘ ১৪২৭. রবিবার
©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©
আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার চাংড়িপোতা গ্রামে (বর্তমানে সুভাষগ্রাম) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তাঁর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগর (১৮২৭-১৯১২) ছিলেন জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার প্রথম পৌরপ্রধান। তাঁর মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬) ছিলেন তৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এর সম্পাদক।শিবনাথ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৬৬) এবং কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৬৮), বি.এ (১৮৭১) ও এম.এ (১৮৭২) পাস করেন। পরে ঐ কলেজ থেকেই তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন।
ছাত্রাবস্থায়ই (১৮৬৯) শিবনাথ কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। Indian Reforms Association-এ যোগ দিয়ে তিনি মদ্যপান নিবারণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে এবং শিল্প-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যার প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। মদ্যপানের বিরোধিতা কল্পে তিনি ১৮৭০ সালে প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক একটি মাসিক পত্রিকা। পরে তিনি সোমপ্রকাশ (১৮৭৩-৭৪) ও ধর্মবিষয়ক সমদর্শী পত্রিকা (১৮৭৪) এবং আরও পরে
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি গঠন করেন।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় স্থাপন করেন।
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা 'সখা' প্রকাশিত হয়।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান মেসেজ ও মুকুল (১৮৯৫) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
এই সময়ে তিনি কিছুদিন 'তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
শিবনাথ কেশব সেনের ভারত আশ্রমের বয়স্কা মহিলা বিদ্যালয় (১৮৭২), ভবানীপুর সাউথ সুবারবন স্কুল (১৮৭৪) এবং হেয়ার স্কুলে (১৮৭৬) শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৭৮)। নারীমুক্তি আন্দোলনে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে তিনি কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। তাদের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ১৮৭২ সালে মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়সসীমা ১৪ বছর নির্ধারিত হয়।
১৮৭৭ সালে শিবনাথ ব্রাহ্ম যুবকদের ‘ঘননিবিষ্ট’ নামে একটি বৈপ্লবিক সমিতিতে সংগঠিত করে পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি (১৮৭৯) এবং নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষে্য মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় (১৮৮৪) স্থাপন করেন। ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা সখা (১৮৮৩) তার উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাধনাশ্রম।
শিবনাথ কাব্য , উপন্যাস , প্রবন্ধ, জীবনী ইত্যাদি ধারায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তার কয়েকটি অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থও আছে। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৯০৪), আত্মচরিত (১৯১৮), History of Brahma Samaj ইত্যাদি তার গবেষণামূলক আকরগ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হলো: নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্পমালা (১৮৭৫), মেজ বৌ (১৮৮০), হিমাদ্রি-কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), যুগান্তর (১৮৯৫), নয়নতারা (১৮৯৯), রামমোহন রায়, ধর্মজীবন (৩ খণ্ড, ১৯১৪-১৬), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক হিসেবেও শিবনাথ শাস্ত্রী রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর।
সমাজ সম্পর্কে প্রগতিশীল দৃষ্টিই তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়।
হিন্দু ধর্মের নানামাত্রিক কুসংস্কার থেকে তিনি সমাজকে মুক্ত করার মানসে একের পর
এক প্রবন্ধ লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে – এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ? (১৮৭৮), খৃষ্টধর্ম (১৮৮১), জাতিভেদ (১৮৮৪), বক্তৃতা স্তবক (১৮৮৮), মাঘোৎসব উপদেশ (১৯০২), মাঘোৎসব বক্তৃতা (১৯০৩), প্রবন্ধাঞ্জলি (১৯০৪), ধর্মজীবন (১৯১৬) ইত্যাদি।
ব্রাহ্মধর্মের তিন প্রধান তাত্ত্বিকের জীবনী লিখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁর জীবনী
গ্রন্থগুলো হচ্ছে রামমোহন রায়
(১৮৮৫), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
(১৯১০) এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র
(১৯১০)। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী আত্মচরিত। তাঁর আত্মচরিত পাঠ করলে গোটা উনিশ শতক পাঠকের
চোখে ভেসে উঠবে। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর কালজয়ী গ্রন্থ -
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, যা
ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইংরেজি
ভাষাতেও শিবনাথ শাস্ত্রী কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি
গ্রন্থ – History of the Brahma Samaj (১৮৮৮) এবং Men I have seen (১৮৯৯)।
রামতনু লাহিড়ী এবং উনিশ শতকী বাঙালির নবজাগরণকে সমান্তরাল দৃষ্টিতে
পর্যবেক্ষণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী রচনা করেছেন রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন
উপস্থাপন সূত্রে শিবনাথ শাস্ত্রী এই গ্রন্থে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন উনিশ
শতকী উন্মথিত বাঙালির জাগরণ-ইতিহাস। কেবল উনিশ শতকী সমাজ নয়, সমকালীন
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও এখানে পাওয়া যাবে শিবনাথ শাস্ত্রীর বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন। গ্রন্থটি কেবল উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর জীবনেতিহাস নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ওই শতকের সামাজিক-সাংস্কৃতিকইতিহাস ও রেনেসাঁস-আন্দোলনের ঐতিহাসিক এক দলিল। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর নিম্নোক্ত ভাষ্য :
…অগ্রে ভাবিয়াছিলাম বিশেষভাবে তাহার [রামতনু লাহিড়ী] অনুরক্ত ব্যক্তিগণের জন্য একখানি
ক্ষুদ্রাকার জীবনচরিত লিখিব।… অতএব, প্রথমে তদ্নুরাগী লোকদিগের জন্যই লিখিতে
আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু তৎপরে মনে হইল, লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবনের প্রথমোদ্যমে
রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার ও ডিরোজিও, নব্যবঙ্গের এই তিন দীক্ষাগুরু তাঁহাদিগকে যে
মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, সেই মন্ত্রের প্রভাবেই বঙ্গসমাজের সবর্ববিধ উন্নতি ঘটিয়াছে;
এবং সেই প্রভাব এই সুদূর সময় পর্যন্ত লক্ষিত হইতেছে। আবার সেই উন্নতির স্রোতের
সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন, অগ্রসর হইয়া অত্যগ্রসর দলের সঙ্গে মিশিয়াছেন, এরূপ দুই একটি
মাত্র মানুষ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় একজন। অতএব, তাঁহার জীবনচরিত লিখিতে
গেলে, বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্তকে বাদ দিয়া লেখা যায় না। তাই বঙ্গদেশের
আভ্যন্তরীণ সামাজিক ইতিবৃত্তের বিবরণ দিতে প্রবৃত্ত হইতে হইল।রামতনু লাহিড়ীর জীবন-ইতিহাস, উনিশ শতকের সামূহিক অবক্ষয় এবং রামমোহন-হেয়ার-ডিরোজিও প্রভাবিত ভাব-আন্দোলন – এই ত্রিমাত্রিক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রন্থটি পাঠ করার সময় মনে হয় না যে একখানা জীবনীগ্রন্থ বা সমাজ-ইতিহাসের বই পাঠ করছি; বরং মনে হয়,পাঠ করছি অসামান্য এক উপন্যাস।
১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$
No comments:
Post a Comment