Sunday, 21 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য


ভূদেব মুখোপাধ্যায়


              হুমায়ুন কবির
=================================
Doinik Sabder Methopath
     Vol -290. Dt -22.02.2021
      ৯ ফাল্গুন, ১৪২৭. সোমবার
≠================================

তিনি ১৮২৭ সালের  ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতার ৩৭, হরিতকী বাগান লেনের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন৷ হুগলি জেলার খানাকুল থানার অন্তর্গত নতিবপুর গ্রাম তাঁদের আদিনিবাস৷ তিনি প্রথমে সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন । তারপর তিনি হিন্দু কলেজে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি মাসিক ৪০ টাকা বৃত্তি পেতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার সহপাঠী ছিলেন । তার পিতার নাম বিশ্বনাথ তর্কভূষণ। 
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজ ত্যাগ করেন এবং কিছুদিন হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়ে এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত চন্দননগর সেমিনারীতে শিক্ষকতা করেন। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজি বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষক হিসাবে সরকারী শিক্ষাবিভাগে যোগ দেন। ১৮৬৪ সালে তিনি বিদ্যালয়সমূহের অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের প্রথম শ্রেনীতে উন্নীত হন। এরপর তিনি হান্টার কমিশনের (এডুকেশন কমিশন) সদস্য হিসাবে ২৩ জুলাই ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। 
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার উপরে শিক্ষাদর্পণ নামে দু আনা দামের মাসিক পত্রিকা পরিচালনা করেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে চুঁচুড়া থেকে সরকারী পত্রিকা এডুকেশন গেজেট এবং এবং সাপ্তাহিক বার্তাবহ পত্রিকা সম্পাদনা করেন । তার বহু প্রবন্ধ ও বই সাপ্তাহিক বার্তাবহ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী। তার রচিত স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস বইতে কাল্পনিক ঘটনার সাহায্যে তিনি ভারতের জাতীয় চরিত্রের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। তার রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বইতে সফল স্বপ্ন এবং অঙ্গুরীয় বিনিময় নামে দুটি গল্প ছিল। এগুলি ছিল বাংলা ভাষায় লিখিত দ্বিতীয় উপন্যাসধর্মী রচনা। প্রথম উপন্যাসধর্মী রচনা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস (১৮৫২)। অঙ্গুরীয় বিনিময় গল্পটির কাহিনী কিছুটা ইতিহাস থেকে নেওয়া হলেও গল্পটিকে মৌলিক রচনার পর্যায়ে ফেলা যায়। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের এখানেই সূত্রপাত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে অঙ্গুরীয় বিনিময় গল্পের কিছুটা প্রভাব আছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় রচিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পারিবারিক প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, আচার প্রবন্ধ, বিবিধ প্রবন্ধ, পুষ্পাঞ্জলি, এবং বিদ্যালয় পাঠ্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ক্ষেত্রতত্ত্ব, পুরাবৃত্তসার, বাঙলার ইতিহাস, ইংল্যান্ডের ইতিহাস, রোমের ইতিহাস প্রভৃতি। 

হিন্দি ভাষার উন্নতির জন্য তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন। স্কুল পরিদর্শক থাকাকালীন বিহারে বহু হিন্দি স্কুল স্থাপন, বাংলা বইয়ের হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ ও মূল হিন্দি বই লেখায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তারই প্রস্তাবে বিহারের আদালতে ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ব্যবহার শুরু হয়। সংস্কৃত ভাষার উন্নতির জন্য তিনি তার পিতার নামে বিশ্বনাথ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলেন এবং চতুষ্পাঠীর শিক্ষকদের বৃত্তিদান করতেন। এছাড়াও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী এবং মায়ের নামে ব্রহ্মময়ী ভেষজালয় স্থাপন করেছিলেন।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিআইই উপাধি পান। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য ছিলেন। ভূদেব ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষাদর্পণ ও সংবাদসার পরিচালনা করেন এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি পত্রিকা এডুকেশন গেজেট (১৮৫৬)-এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর বিশিষ্ট কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ হলো: পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২), আচার প্রবন্ধ (১৮৯৫), বিবিধ প্রবন্ধ (১৮৯৫) ইত্যাদি

১৫ মে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
==================================

বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোমরপুর গ্রামে ১৯০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর কবিরুদ্দিন আহমদ তাঁর পিতা। নওগাঁ কে.ডি. স্কুল থেকে ইংরেজিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯২২) পাস। অতঃপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি। এই কলেজ থেকে ইংরেজিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. (১৯২৪), ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ. অনার্স (১৯২৬) এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম. এ. (১৯২৮) ডিগ্রি লাভ। সরকারি বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড গমন (১৯২৮)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একসেটর কলেজে ভর্তি। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত। অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি. এ. অনার্স ডিগ্রি লাভ (১৯৩১)।১৯৩১ সালে এশিয়া বাসীর মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অক্সফোর্ডের মর্ডান গ্রেটস পরীক্ষায় প্রথম হন। তিনিই প্রথম এশিয় যিনি অক্সফোর্ডের হাবার্ট স্পেন্সারের প্রথম বক্তৃতা দেন এবং প্রথম এশিয়া সাহিত্য সম্মেলন প্রথম এশিয়া সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ভারত সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা মন্ত্রী রাজ্যসভার সদস্য প্রভৃতি পদে তিনি কাজ করেছেন। তিনি দুবার শিক্ষা মন্ত্রী দায়িত্ব মর্যাদার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রথমবার ডক্টর জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায়। পরে তিনি আরেকবার। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন যথার্থ সম্মানের সঙ্গে।
রচনা কর্ম :
  প্রবন্ধ গ্রন্থ - 
   ইমানুয়েল কান্ট (১৯৩৯), বাঙলার কাব্য (১৯৪২), মার্কসবাদ (১৯৪৮), শিক্ষক ও শিক্ষার্থী (১৯৫৭), শরৎ সাহিত্যের মূল তত্ত্ব (১৯৫৮), মীর্জা আবু তালিব খান (১৯৬১)
Poetry, Monads and Society (1941)
Muslim Politics in Bengal (1943)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪৫), দিল্লি-ওয়াশিংটন মস্কো (১৯৬৪) প্রকৃতি।
    কাব্যগ্রন্থ : 
                 স্বপ্নসাধ,  সাথী
    উপন্যাস :
                    নদী ও নারী (১৯৬১)
    সম্পাদনা : 
          ত্রৈমাসিক সাহিত্যয পত্রিকা চতুরঙ্গ এর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি কৃষক , নবযুগ নয়াবাংলা পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সাহিত্যকে নতুন পথ দেখিয়েছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে সর্বদা চেষ্টা করেছেন যুক্তির শৃঙ্খলা ও তথ্যের সমাহার সুখপাঠ্য করে তুলতে। যেমন -
   ১)  মানব কল্যাণ বিষয়ে  -
     " সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে সমস্ত পৃথিবী সংঘটিত না হলে যে মানুষের কল্যাণের কোন সম্ভাবনা নাই এ বিষয়ে বর্তমান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বোধহয় সকলেই একমত ।"
২) সমাজ বাস্তবতা বিষয়ে -
      " যতদিন মানুষ মানুষকে শোষণ
 করবে ততদিন আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিক শোষণের শেষ নেই। যতদিন মানুষ মানুষকে দাস করে রাখবে ততদিন মানুষের দুঃখ দৈন্যের অবসান হতে পারে না।"
৩) জাতীয়তাবোধ 
     " অনেকেই ভাবেন যে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এশিয়া বুঝি স্থান পায়না - তাঁরা ভুলে যান যে ইউরোপের নেতৃত্ব অত্যন্ত সাম্প্রতিক।"
৪) দার্শনিক প্রত্যয় 
     " প্রতি দেশেই আমরা দেখি যে একদিকে বিলাসের প্রাচুর্য ও প্লাবন এবং অন্যদিকে অভাব যন্ত্রণার নিদারুণ নিপীড়ণ। সমাজের এ অসুস্থ অবস্থায় সমাজের শান্তি থাকতে পারে না এবং সমাজের মধ্যে অন্তর্নিহিত অশান্তি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘর্ষে তাই আত্মপ্রকাশ করে।"
৫) ভারতবর্ষের মুক্তি প্রসঙ্গ 
       " স্বাধীন ভারত বর্ষ তাই কেবলমাত্র ভারতবাসীর জন্য নয় বরং সমস্ত পৃথিবীর কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় . ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থিতি ভারতবর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্য ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে বর্তমান পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় করতে হবে । কারণ সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন ভারতবর্ষেই হবে ভবিষ্যৎ বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ভিত্তি।"
১৯৬৯ সালে ১৮ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
================================

No comments: