Wednesday, 10 March 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য


বিজয়া মুখোপাধ্যায়

'পৃথিবী এখন ক্লান্ত, আমি তার চোখ

বহুদিন ধরে দেখে গেছি

আমি মরে যাব ভালোবাসা সঙ্গে যাবে

আর বর দিয়ে যাব--ভুবন ঈশ্বরী,

এইবার মুক্তগ্রহ হও।'

 দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়াহাটের মেঘমল্লার আবাসনের বাসিন্দা ছিলেন কবি। ১৯৩৭ সালের ১১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার বিক্রমপুরে। দীর্ঘ পড়াশোনা ওখানেই। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতি এমএ পাস করেন। কর্মসূত্রে কলেজে অধ্যাপনা। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার এর ভারততত্ত্বচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রশিক্ষক এবং গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।  স্বামী  বিশিষ্ট কবি শরৎ মুখোপাধ্যায়।  সংস্কৃত ভাষায় দখল ছিল অসামান্য। কবি বুদ্ধদেব বসু 'মহাভারতের কথা' লেখার সময়ে বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন। 

নিজের লেখালখি প্রসঙ্গে বলেছেন- " অনেককাল কিন্তু কিন্তু করে প্রকাশ্যে লেখার সাহস হলো যখন তখন ছয় এর দশক। তখনই তো সেই সব অভূতপূর্ব ঘটনা। রাজনৈতিক আদর্শের ওলট-পালট সামাজিক সম্পর্কের কাটাছেঁড়া নিজের ব্যক্তিজীবনের পরিবেশ বদল উপার্জন স্বাধীনতার দীর্ঘচ্ছেদ আর কলকাতাকে ছেড়ে যাওয়া। অগত্যা অনভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞতায় পাক খেতে খেতে আমার লেখা গুলি একান্তে বাড়তে লাগল কবিতার কাঠকুটোয় ". 

(একান্তর মে,২০০৫)

 কাব্যগ্রন্থ :

 'আমার প্রভুর জন্য' (১৯৬৭), 'যদি শর্তহীন (১৯৭১), 'ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম' (১৯৭৭), 'উড়ন্ত নামাবলী' (১৯৭৯) 'দাঁড়াও তর্জনী' (১৯৮৮) , শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০) অশ্লেষা তিথি র কন্যা (১৯৯৩)সামনে আপনারা(২০০০) ওই যে সৌধের চূড়া (২০০১) ভাষায়, যেটুকু বলা যায়(২০০৫) প্রভৃতি। 

'বিভাষা' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন

কবি মণীন্দ্র গুপ্ত " ষাট দশকের কবিতা " প্রবন্ধে বলেছেন -" বিজয়় যেন হৃদয়় থেকে ইন্দ্রিয়ের ধমনীী জালে বিস্তৃত না হয়ে সরাসরি পৌঁছে যান মেধায়। তাঁর জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা অনুভূতি নিংড়ে ওঠে তত্ত্ব, তাঁর সত্য। বিজয়ার তত্ত্বান্বেষী মন শিল্পের পক্ষে কখনো কখনো ক্ষতিকর হলেও ওটি তাঁর সহজাত,  অনেকের মত ভাণ নয়।"

কবি সুবোধ সরকার স্মৃতিচারণে বললেন, 'আমি তখন কৃষ্ণনগরে। বিজয়াদির কবিতার বই 'ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম' পড়ে ওদের গড়িয়াহাটের বাড়িতে এসেছিলাম দেখা করতে। সেই শুরু। তার পর থেকে বিজয়াদি এবং শরৎদা আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে যান। আমি মনে করি, মেয়েদের যে লেখালেখি, তার বলয়কে অতিক্রম করে যেতে পেরেছিলেন বিজয়াদি। গুণী এবং বিদূষী এই কবির প্রয়াণে আমি মর্মাহত। যদিও তিনি ষাটের দশকের, কিন্তু তাঁকে আমরা সুনীলদা-শরৎদার পাশে পাশেই দেখেছি।'

২৬ শে জুলাই,২০২০ । চলে গেলেন ষাটের দশকের অন্যতম অন্তর্বেদনা কবি বিজয় মুখোপাধ্যায়।

----------+------------+------------+-++++++-

বিশেষ আলোচনা-

কবির চোখে কবিকে দেখা :

অসম্মানে উদাসীন ফুটেছে অক্ষর

বেবী সাউ।

পাঁচের দশকের কবিতা মানেই বহুস্তরীয়, বহুরৈখিক নানান কাব্যভাষার কবিতা। অন্তত ছয় দশক পরেও কবিতা লিখতে এসে যখন পাঁচের দশকের কবিদের কবিতা পড়ি, তাঁদের সমসাময়িক-ই মনে হয়। যদিও সময় তাঁদের নশ্বর অস্তিত্বের উপর যে জীর্ণ আস্তরণ ফেলে দেন, তার প্রভাবে অনেকেই আজ আমাদের মধ্যে নেই, আবার অনেকে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছেন অনন্তের কাছে। কিন্তু তাঁদের কবিতা আমাদের কাছে যেন নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে এখনও। বিনয় মজুমদার যেমন বহুকাল ধরেই আমাদের আবিষ্ট করে রেখেছেন। আছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আলোক সরকার, শঙ্খ ঘোষ, যুগান্তর চক্রবর্তী, কবিতা সিংহ ইত্যাদি। পাঁচের দশক মানেই যে বাংলা কবিতার এক নতুন অধ্যায়, এ বিষয়ে নিশ্চয়ে কারও সন্দেহ নেই, আর এই অধ্যায়ের নিভৃতে ঈশ্বরের মতো রয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তবে, ভুলে গেলে চলবে না পাঁচের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ কবিদের সঙ্গেই নিজের কবিতাযাপনের শীর্ষে তখন অবস্থান করছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন সমর সেন এবং অরুণ মিত্র। প্রস্তুতি নিচ্ছেন মণীন্দ্র গুপ্তও। এবং পাশাপাশি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ও।

এই যে সৃজনের ঝড়, চিন্তা এবং চেতনার হিমালয়স্বরূপ অসংখ্য শৃঙ্গ, তাঁদের মধ্যে অনন্য এবং স্বতন্ত্র কবিতা লিখে চলা খুব সহজ কাজ নয়। আর যদি সেই কবির কাব্যভাষা অপেক্ষাকৃত নীরব হয়, তবে তো, সেই কবির কাব্যভাষা অনেকের চক্ষুর অন্তরালেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই ‘আমার প্রভুর জন্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক এই কবির কাব্যব্যক্তিত্ব এতটাই নীরব অথচ তীক্ষ্ণ, যে তাঁর কবিতাকে সাবলাইম চিহ্নে চিহ্নিত করলেও, এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ব্যঙ্গ, কশাঘাত, শান্ত এক নির্জন তাকিয়ে থাকা আছে কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়। অনেকেরই সিলভিয়া প্লাথের কথা মনে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু বিজয়া মুখোপাধ্যায় তাঁর ধ্বংসাত্মক বিষণ্ণতার দিকটি স্পর্শ করেই বেরিয়ে গেছেন। বরং বেছে নিয়েছেন তাঁর দুঃখের জায়গাটি। যদিও বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের দুঃখের মধ্যে অনাড়ম্বর মানুষের জীবনের প্রবহমানতা।

এখন আমি একই স্বপ্ন দেখি রোজ
আশৈশব সম্পর্ক নেই যার সঙ্গে— সেই বাড়ির।
দেখতে পাই
নাটমন্দিরের দুপাশে জুঁই ফুটেছে
এখন বর্ষা।
দেখি, দিঘির ঘাট থেকে উঠে আসছে কেউ
আমার মায়ের মত।
দেখি আসগর আলির
সুপুরি গাছে উঠে-যাওয়া লম্বা লম্বা পা,
আর দিগন্ত জোড়া পাটখেত।
ওরা এখন শরণার্থী, ষাট লক্ষ।
ওরা সারাদিন সদরে ঘণ্টা বাজায়
আমি অসাড়,
শুধু রাত্রে স্বপ্ন আসে নাটমন্দির,
পাটখেতে ঢেউ, আসগর আলির পা।

(একই স্বপ্ন রোজ)

এই হচ্ছে কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষা। অত্যন্ত সহজে, পা ফেলার মতো করেই তিনি আসেন তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে, আর তাঁর কবিতায় তিনি এক দৃশ্য ও দৃশ্যের অভ্যন্তরে থাকা ‘বোধ’-কে এনক্রিপ্ট করে যান এমনভাবে, যে, তার দিকে তাকিয়ে যেন একটা ট্রান্সের জন্ম হয়ে যায়। একটা অতি সাধারণ ন্যারেটিভ কীভাবে যে কবিতার শীর্ষে পরিণত হয়, তা বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতোই নিজস্ব এক প্রভুর মানচিত্র পাওয়া যায় তাঁর কবিতাগুলির মধ্যে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে এক তীব্র সামাজিক দ্বন্দ্ব। যেমন আমার প্রভুর জন্য শীর্ষক কবিতায় তিনি লেখেন—

হে জ্ঞানী পিতৃকুল
তোমাদের আভূমি প্রণাম
কন্যাকে ত্যাগ করো অন্ধকারে।
তোমাদের ঘৃণাঞ্জন আমার অঙ্গলেপ, বিস্মৃত তমস্বান উত্তরীয়
ধিক্কারে রাত্রিস্তোম সঙ্কলিত হোক।

কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের আপাত নরম মৃদু কণ্ঠস্বরের আড়ালে যে লুকিয়ে ছিল এক দৃঢ়চেতা মানুষের কণ্ঠস্বর তা বুঝতে আমাদের কারো অসুবিধে হয় না। আসলে, এটিই কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষা। ষাট দশকে যখন গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে চলছে নানান ওঠাপড়া, নানান খণ্ডবৈচিত্রের দিন যেমন এক তুমুল বিক্ষোভ এবং সংক্ষোভের পৃথিবী গড়ে তুলেছে, সে সময় উচ্চকিত নয়, অথচ শক্তিশালী এমন এক মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ কাব্যভাষায় কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় কবিতা লিখে গেছেন একের পর এক। ‘আমার প্রভুর জন্য’ কাব্যগ্রন্থের বিষয় যেমন ১৯৬৭ সালের বিক্ষুব্ধ আর্থ-রাজনৈতিক-লিঙ্গবৈষম্যের ভারতবর্ষের এক জ্বলন্ত ম্যানিফেস্টো বললে ভুল হবে না, তেমন এটিও বললে ভুল হবে না, তিনি, উচ্চকিত না হওয়ায়, সেই প্রতিবাদের বলিষ্ঠ উচ্চারণ অনেকগুলি স্তরের মধ্যেই ছিল। একজন প্রকৃত কবির মতোই তিনি বক্তব্যকে কখনও স্লোগান করে তোলেননি তাঁর কবিতায়, বরং নানাভাবে, কবিতাকেই করে তুলেছেন এক অস্ত্রের মতো— “ভোর হলে রক্তপাত থামাবার বন্দোবস্ত হবে/ তার আগে সামনে এসো, বেজেছে সাইরেন/ নারকেল পাতার ফাঁকে নক্ষত্ররা সজ্জিত হয়েছে” (বেজেছে সাইরেন)।

‘ভালোবাসার কোনও ভবিষ্যৎ নেই’ লিখেছিলেন কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর কবিতায় ছত্রে ছত্রে প্রকৃত ভালোবাসার কথা ধ্বনিত। আসলে আত্মসচেতন এক কবি, আত্মব্যক্তিত্বে ভরপুর এক কবি কখনওই কোনও সামাজিক অসম দৃষ্টিভঙ্গির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে পারেন না। তিনি হয়তো নিজের অন্তরাত্মায় থাকা নির্জন শিক্ষার সঙ্গে আপস করে নিতে পারেন না সামাজিক বৈষম্যগুলিকে, কিন্তু এই কবি অত্যন্ত তীব্রভাবে যেমন প্রেমের কথা বলেন, তেমন এক অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির কথাও বলেন। মেয়েদের জীবন, নানান বয়সের, নানান শ্রেণির মেয়েদের জীবন, অত্যাচারিত নারীদের জীবন তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে। ভ্রুণহত্যার মতো বিষয় নিয়েও তিনি অত্যন্ত অভিনবভাবে কবিতা লিখেছেন। একশোজন পুরুষের প্রেক্ষিতে তিরানব্বইজন নারী ও বাকি সাতজনের জন্য তিনি বেরিয়েছেন এক অভিযাত্রায়। অন্বেষণে। ‘বাইরে পাথর, ভিতরে কি মধু, ভিতরে কি বিষ?’ এই তীব্র অনুসন্ধানী গভীর বোধের রাজনৈতিক পংক্তিও লেখা হয় বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কলমেই। এই যে আপাত একটা বাস্তব দৃশ্যের অন্তরালে রয়েছে আরও বেশ কিছু বাস্তবতা, সেই দিকে একজন কবি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়েই থাকেন। ষাটের আরও একজন মহৎ কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা এ প্রসঙ্গে তুলনীয়, যিনি হাসির ভিতরে এই দুঃখ এবং দুঃখের ভিতরে হাসির অন্বেষণ করে গেছেন আজীবন ধরেই। বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও অনেকটাই সেই পরিসরকে ধারণ করে থাকে। অবশ্যই ভাস্কর চক্রবর্তীর কাব্যভাষা এবং বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কাব্যভাষা এক নয়। কিন্তু বিজয়া মুখোপাধ্যায় তাঁর কাব্যব্যক্তিত্ব দিয়েই নিজস্ব এক কাব্যভাষা গড়ে তুলেছিলেন। প্রায় প্রতি কবিতার ছত্রে ছত্রেই ছিল আপাত এবং অন্তরালের অর্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব।

এই কারণেই, বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতাকে আমাদের চিরসময়ের বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতে আলাদা এক স্থানে সরিয়ে রাখতেই হবে। কারণ ভালো করে ভেবে দেখলে, এই কবির কবিতা তাঁর সমসময়ের উচ্চকিত সামাজিক প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, প্রবহমানতায় প্রবাহিত না হয়ে গিয়ে, অনুবর্তনের আশ্রয়ে না গিয়ে অথবা মেদুর লীলায় আচ্ছন্ন না হয়ে নিজের মতো করে তীক্ষ্ণ এক কাব্যপরিসর গড়ে তোলা। এখানে তাঁর স্বাতন্ত্র্য এবং এখানেই তাঁর নিজস্ব এক কাব্য-মানচিত্র।

   (পুনঃ প্রকাশিত )

-------------------------------------------------------

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik sabder methopath

Vol -307.Dt -11.03.2021

২৬ তারিখ, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার

============================



No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...