"তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর উপর রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো।
তার বেলা ?......"
"যদিও আমার প্রধান কাজ সৃষ্টি. একটির পর একটি সৃষ্টি করি আর এটুকু পর একটু মুক্ত হই তবুও আমাকে কখনো কখনো সৃষ্টির কাজ সরিয়ে রেখে দেশের ও কালের ভাবনার ভাগ নিতে ও দিতে হয়। নইলে আমি হব পলায়নবাদী।"
--------------০০০0০০০০০০---------------------
কবি প্রাবন্ধিক কথাসাহিত্যিক ছড়াকার ও দক্ষ প্রশাসক অন্নদাশঙ্কর রায়।
শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন
=================================
অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম মার্চ ১৫, ১৯০৪ সাল । বর্তমান উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে । তাঁর পূর্বপুরুষের আদি বসতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কোতরং অঞ্চলে ( অধুনা উত্তরপাড়া কোতরং ) ৷তাঁর পিতা ছিলেন ঢেঙ্কানল রাজস্টেটের কর্মী নিমাইচরণ রায় এবং তার মাতা ছিলেন কটকের প্রসিদ্ধ পালিত বংশের কন্যা হেমনলিনী । ছোটবেলায় ঢেঙ্কানলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় । ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । এরপর সংবাদপত্রের সম্পাদনা শিখতে কলকাতা বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের কাছে যান । তিনি শর্টহ্যান্ড, টাইপরাইটিং এবং প্রুফরিডিং-ও শেখেন । কিন্তু এই কাজ তার ভালো লাগেনি । এরপর তিনি কটকের র্যাভেনশ কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষা দেন এবং তাতে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন । ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পরীক্ষাতেও তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্থানাধিকারী হন । ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এম.এ পড়তে পড়তে আই.সি.এস পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয়বারে পূর্ববর্তী রেকর্ড ভেঙে প্রথম স্থান অধিকার করেন । তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এ গৌরব লাভ করেন। সেই বছরেই তিনি সরকারি খরচে আই.সি.এস হতে ইংল্যান্ড যান । সেখানে তিনি দুই বছর ছিলেন । এই সময়ে তার ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী পথে প্রবাসে বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় ।স্কুলে তিনি শিশু, সন্দেশ, মৌচাক, সবুজপত্র, প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তেরো বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকার গ্রাহক হন এবং সে পত্রিকায় লেখা ছাপেন।১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘পথে প্রবাসে’। একই সময় মৌচাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ইউরোপের চিঠি’। অন্নদাশঙ্কর রায় কোনো গোষ্ঠীভুক্ত লেখক ছিলেন না। তবে সম্পাদকদের অনুরোধে কল্লোল, কালিকলম, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকার জন্য লেখেন। কলোল, কালিকলম যুগের সাহিত্যিক এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও শিখা গোষ্ঠীর প্রতিভূদের সঙ্গেও তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন কন্যা অ্যালিস ভার্জিনিয়া অনফোর্ডকে বিবাহ করে তিনি তাঁর নাম দেন লীলা রায় । লীলা রায় বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন । অন্নদাশঙ্করের অনেক লেখা লীলাময় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজে যোগ দেন । তিন বছর এই পদে থেকে বিভিন্ন জেলায় কাজ করে কুমিল্লা জেলায় জজ হিসাবে নিযুক্ত হন । ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সরকারী কাজে নিযুক্ত থেকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিচার বিভাগের সেক্রেটারি হন । ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেন । ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন প্রথম সভাপতি এবং আমৃত্যু এই পদে ব্রতী ছিলেন।
তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২২টি। এর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস আগুন নিয়ে খেলা (১৯৩০)।বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যিক উপন্যাস তাঁর ছয় খন্ডে প্রকাশিত সত্যাসত্য ছয়টি নামে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে- যার যেথা দেশ (১৯৩২), অজ্ঞাতবাস (১৯৩৩), কলঙ্কবতী (১৯৩৪), দুঃখমোচন (১৯৩৬), মর্ত্যের স্বর্গ (১৯৪০), অপসরণ (১৯৪২)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস অসমাপিকা (১৯৩১), পুতুল নিয়ে খেলা (১৯৩৩), না (১৯৫১), কন্যা (১৯৫৩), তিন খন্ডে প্রকাশিত রত্ম ও শ্রীমতী (১ম-১৯৫৬, ২য়-১৯৫৮, ৩য়-১৯৭২), সুখ (১৯৬১), বিশল্যকরণী (১৯৬৭), তৃষ্ণার জল (১৯৬৯), রাজঅতিথি (১৯৭৮) এবং চার খন্ডে রচিত ও প্রকাশিত ক্রান্তদর্শী (১ম-১৯৮৪, ২য়-১৯৮৫, ৩য়-১৯৮৫, ৪র্থ-১৯৮৬)।
ছোটগল্প.
তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলো: প্রকৃতির পরিহাস (১৯৩৪), দুকান কাটা ১৯৪৪, হাসনসখী (১৯৪৫), মনপবন (১৯৪৬), যৌবনজ্বালা (১৯৫০), কামিনীকাঞ্চন (১৯৫৪), রূপের দায় (১৯৫৮), গল্প (১৯৬০), কথা (১৯৭১), কাহিনী (১৯৮০), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৮৪) এবং গল্পসমগ্র (১৯৯৯)।
প্রবন্ধ:
তারুণ্য (১৯২৮), আমরা (১৯৩৭), জীবনশিল্পী (১৯৪১), ইশারা (১৯৪৩), বিনুর বই (১ম পর্ব-১৯৪৪), জীয়ন কাঠি (১৯৪৯), দেশকালপাত্র (১৯৪৯), প্রত্যয় (১৯৫১), নতুন করে বাঁচা (১৯৫৩), আধুনিকতা (১৯৫৩), সাহিত্যে সংকট (১৯৫৫), কণ্ঠস্বর (১৯৫৬), রবীন্দ্রনাথ (১৯৬২), প্রবন্ধ (১৯৬৪), খোলা মন ও খোলা দরজা (১৯৬৭), আর্ট (১৯৬৮), গান্ধী (১৯৭০), প্রাণ রক্ষা ও বংশ রক্ষার অধিকার (১৯৭০), শুভোদয় (১৯৭২), বাংলার রেনেসাঁস (১৯৭৪), শিক্ষার সংকট (১৯৭৬), কাঁদো প্রিয় দেশ (১৯৭৬), প্রেম ও বন্ধুতা (১৯৭৬), লালন ও তাঁর গান (১৯৭৮), চিত্ত যেথা ভয়শূন্য (১৯৭৮), বাংলাদেশে (১৯৭৯), সাতকাহন (১৯৭৯), টলস্টয় (১৯৮০), স্বাধীনতার পূর্বাভাস (১৯৮০), জাতিবৈর (১৯৮১), শিক্ষার ভবিষ্যৎ (১৯৮১), সংহতির সংকট (১৯৮৪), সংস্কৃতির বিবর্তন (১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (১৯৮৬), যুক্তবঙ্গের স্মৃতি (১৯৯০), যেন ভুলে না যাই (১৯৯২), বিনুর বই (১ম ও ২য় পর্ব একত্রে-১৯৯৩), সাহিত্যিকের জবানবন্দী (১৯৯৬), সেতুবন্ধন (১৯৯৬), নববই পেরিয়ে (১৯৯৬), বিদগ্ধ মানস (১৯৯৭), মুক্তবঙ্গের স্মৃতি (১৯৯৮), জীবন যৌবন (১৯৯৯), রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও সবুজপত্র (১৯৯৯), নতুন করে ভাবা (১৯৯৯), সাহিত্যে সংকট ও অন্যান্য (২০০০), আমার কাছের মানুষ (২০০১), শতাব্দীর মুখে (২০০১), আমার ভালোবাসার দেশ (২০০১) প্রভৃতি।
ছড়ার বই :
উড়কি ধানের মুড়কি (১৯৪২), রাঙা ধানের খৈ (১৯৫০), ডালিম গাছে মৌ (১৯৫৮), শালি ধানের চিঁড়ে (১৯৭২), আতা গাছে তোতা (১৯৭৪), হৈ রে বাবুই হৈ (১৯৭৭), ক্ষীর নদীর কূলে (১৯৮০), হট্টমালার দেশে (১৯৮০), ছড়াসমগ্র (১ম সং. ১৯৮১), রাঙা মাথায় চিরুনি (১ম সং. ১৯৮৫), বিন্নি ধানের খই (১৯৮৯), কলকাতা পাঁচালী (১৯৯২), ছড়াসমগ্র (২য় পরিবর্ধিত সং. ১৯৯৩), সাত ভাই চম্পা (১৯৯৪), যাদু এ তো বড় রঙ্গ (১৯৯৪),) খেয়াল খুশির ছড়া (১৯৯৭), দোল দোল দুলুনি (১৯৯৮), (২০০২) ইত্যাদি।
ENGLISH ;
Bengali Literature (1942) Flight and Pursuit (1968), Yes, I Saw Gandhi (1976), Companion on the Road কবিতার অনুবাদ- (1976), A Writer Speaks (1977) Woman and Other Stories গল্পের অনুবাদ- (1977), An Outline of Indian Culture 1978 Aspects of Indian Culture (1983), In Restrospect (1989), Tolstoy Goethe and Tagore (1999), Selected Short Stories (গল্পের অনুবাদ-1999)। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক অসংখ্য ভাষণের মধ্যে কিছুসংখ্যক গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (২৯ ডিসেম্বর ১৯৭৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন (৭ এপ্রিল ১৯৮৯), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় (৯ মে ১৯৮৯), কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে (৭ মে ১৯৯৪) দেওয়া তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতাগুলি ইংরেজিতে প্রদত্ত এবং তিনি এর বাংলা অনুবাদ করেননি, অন্য কেউ অনুবাদ করুক তাও চাননি।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি :
১) ১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদক পুরস্কারে ভূষিত করে। ২) দেশিকোত্তম সম্মান প্রদান করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
৩) বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডিলিট) উপাধি প্রদান করে।
৪) অন্যান্য পুরস্কার ;
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬২),
আনন্দ পুরস্কার (দুইবার-১৯৮৩, ১৯৯৪),
বিদ্যাসাগর পুরস্কার,
শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৫),
বাংলাদেশের জেবুন্নিসা পুরস্কার।
অন্নদাশঙ্কর রায় ২৮ অক্টোবর ২০০২ মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -311. Dt -15.03.2021
১ লা চৈত্র, ১৪২৭. সোমবার
=====================================
No comments:
Post a Comment