রাজ শেখর বসু
(পরশুরাম)
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার বীরনগর গ্রামে। পিতা চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও দার্শনিক। মাতা লক্ষীমনি দেবী । পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি দ্বারভাঙ্গা রাজ এস্টেটে র ম্যানেজার ছিলেন । রাজশেখরের বাল্য জীবন কেটেছে বিহারে । তিনি দ্বারভাঙ্গা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে পাটনা কলেজে এফ.এ পড়েন। এই সময় তিনি শ্যামাচরণ দের পৌত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স বিএ পাস করেন। ১৯০২ সালে বিএল পাস করে কিছুদিন আইন ব্যবসা করেন। ১৯০৩ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস এর যোগ দেন। স্বীয় দক্ষতায় অল্প দিনে এই সংস্থার ম্যানেজার পদে উন্নীত হন এবং আমৃত্যু সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
" শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড " প্রথম গল্পরচনা করেন 'পরশুরাম' ছদ্মনামে.১৯২২ সালে মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি শনিবারের চিঠি পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন।
গল্পগ্রন্থ :
গড্ডলিকা , কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন , গল্পকল্প , ধুস্তুরী মায়া, কৃষ্ণকলি, নীলতারা, আনন্দী বাঈ, চমৎকুমারী প্রভৃতি।
এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গল্প হল -
বিরিঞ্চিবাবা, ভূষণ্ডির মাঠ, লম্বকর্ণ ,অদল বদল ,পরশপাথর, জাবালি ,পুনর্মিলন ,ডম্বরু পন্ডিত, গন্ধমাদন বৈঠক, গগন চটি, মহেশের মহাযাত্রা, ধনুমামার হাসি, কচি সংসদ , রটেশ্বরের অবদান প্রভৃতি ।
অন্যান্য রচনা :
কালিদাসের মেঘদূত,
বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ),
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ),
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ইত্যাদি
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসু বিরচিত বাংলা অভিধান চলন্তিকা।
লঘুগুরু, বিচিন্তা, ভারতের খনিজ, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২১টি।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি :
১) ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্বববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির সভাপতি হন।
২) ১৯৪০ সালে জগত্তারিণী পদক পান।
৩) ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা সংসদের সভাপতিত্ব করেন তিনি।
৪) ১৯৫৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পান।
৫) ১৯৫৬ সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ও ভারত সরকারের "পদ্মভূষণ" সম্মানে সম্মানিত হন।
৬) ১৯৫৭-৫৮ সালে কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
জীবনাবসান:
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী মৃণালীনি দেবীও অকাল মৃত্যুর পর ১৮ বছর একাকী জীবনে রচনা করেন অমূল্য সাহিত্যকর্মসমূহ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দূর্দশার কথা তাঁর লেখনিতে কেমন করে ফুটে ওঠেনি। পরে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান । অবশেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে এপ্রিল দ্বিতীয় দফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
চলে গেলেন, বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসাত্মক বুদ্ধিদীপ্ত রচনার স্রষ্ঠা। যিনি বাইরে অত্যন্ত গম্ভীর কিংবদন্তীতুল্য মানুষ হলেও ভেতরে বা অন্তরে সুরসিক, রসিক প্রিয় ও রঙ্গ-রসের মানুষ ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট রসিক চরিত্রগুলি আজও পাঠকের মনে রসের সঞ্চার । বিশেষ করে বিরিঞ্চিবাবা লম্বকর্ণ উলটপুরান জাবালি এর চরিত্রগুলি । তাঁর শব্দ চয়ন বিশেষ অবদানের পরিচয় রেখেছে। শুদ্ধ ব্যঙ্গাত্মক শব্দ যোজনায় বর্ণিত নানান হাস্যরসাত্মক প্রসঙ্গগুলি সাধু ও চলিত হলেও জীবন্ত এবং হৃদয়গ্রাহী। কচি সংসদের তরুণ-যুবকরা যে চালচিত্রের পরিচয় অদ্ভুতভাবে রেখেছেন, সে ভাষায় সহজ-সরল শব্দের ব্যবহার হলে ও খাঁটি বাংলা ব্যবহার, সংলাপের ভাষা, নানান বৈচিত্র্যময় ভাষার ব্যবহার- এদিক থেকে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
রবীন্দ্রনাথ ও পরশুরাম ছোটগল্পের দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব । উভয়ে নাগরিক জীবনের বৈশিষ্ট্য তাদের গল্পের বিষয়বস্তু করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ জীবনের স্বরূপ যেমন ফুটিয়েছেন তেমনি কিছু কিছু গল্পে নাগরিক স্বভাবের বৈশিষ্ট্য ও ফুটে উঠেছে । অপরদিকে পরশুরামের গল্প নাগরিক রুচিবোধের সুন্দর উদঘাটন। এদিক থেকে তিনি মৌলিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি চির ভাস্বর হয়ে আছেন।
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -312. Dt -16.03.2021
২রা চৈত্র,১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
No comments:
Post a Comment