Thursday, 18 March 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় 
বিমল ঘোষ
           বিমল মিত্র
=================================
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

কল্লোল ও কালিকলম পত্রিকাকে ঘিরে সাহিত্য আন্দোলনের পুরোভাগে যিনি ছিলেন । যার বর্ধমানে স্কুল জীবনে প্রিয় বন্ধু ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শৈলজানন্দ ।

             তাঁর বাবার নাম ধরনীধর মুখোপাধ্যায় ও মা হেমবরণী দেবী । তিনি ১৯০১ সালে ১৮ মার্চ বীরভূম জেলার রূপসীপুর বা রূপুসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিন বছর বয়েসে মায়ের মৃত্যুর পর বর্ধমানে (অণ্ডাল গ্রাম) মামাবাড়িতে দাদামশাই রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বড় হন । দাদামশাই ছিলেন ধনী কয়লা ব্যবসায়ী । 

বর্ধমানে স্কুল জীবনে তার সাথে কাজী নজরুল ইসলামের গভীর বন্ধুত্ব ছিল । সেই সময় শৈলজানন্দ লিখতেন পদ্য আর নজরুল লিখতেন গদ্য । তাদের প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তারা দুজনে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে যান । কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় শৈলজানন্দ বাতিল হন । নজরুল যু্দ্ধে যোগ দেন । ফিরে এসে কলেজে ভর্তি হয়ে নানা কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি । নাকড়াকোন্দা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বাগবাজারের কাশিমবাজার পলিটেকনিক কলেজে যোগ দেন টাইপরাইটিং শিখতে । এরপর তিনি কয়লা কুঠিতে চাকরি নেন । বাঁশরী পত্রিকায় তার রচিত 'আত্মঘাতীর ডায়রী' প্রকাশিত হলে দাদামশাই তাকে আশ্রয় থেকে বিদায় দেন । 
কুমারডুবি কয়লাখনিতে কাজ করার সময়েই একের পর এক স্মরণীয় গল্প লেখেন । তার লেখাতে কয়লাখনির শ্রমিকদের শোষিত জীবন উঠে আসে । এরপর তিনি কলকাতায় আসেন । এখানে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিক যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুরলীধর বসু, প্রবোধকুমার সান্যাল, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, দীনেশরঞ্জন দাস প্রভৃতির সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তিনি কালিকলম এবং কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক শ্রেণীভুক্ত হন । কল্লোল ও কালিকলম পত্রিকাকে ঘিরে সাহিত্য আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি । 

খনি শ্রমিকদের নিয়ে সার্থক বাংলা গল্প রচনায় শৈলজানন্দ পথিকৃৎ । উপন্যাস এবং গল্পসহ প্রায় ১৫০টি বই তিনি লিখেছেন । সেগুলির মধ্যে কয়লাকুঠির দেশে, ডাক্তার, বন্দী, আজ শুভদিন, ঝড়ো হাওয়া (১৯২৩), মাটির ঘর (১৯২৪), বাংলার মেয়ে (১৯২৫), জোয়ার ভাটা (১৯২৬), নারীমেধ, বানভাসি, দিনমজুর, জীবননদীর তীরে, পৌষপার্বণ (১৯৩১), অভিশাপ (১৯৩৩), রূপং দেহি, আমি বড় হব, ক্রৌঞ্চমিথুন, বিজয়িনী, রূপবতী, গঙ্গা যমুনা, পাতালপুরী, আকাশকুসুম, সারারাত ইত্যাদি।

চলচ্চিত্র ও রেডিও 

নিজের কাহিনী চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় শৈলজানন্দের বিখ্যাত ছবি নন্দিনী, বন্দী, শহর থেকে দূরে, অভিনয় নয়, মানে না মানা (হীরক জয়ন্তী পালিত প্রথম বাংলা ছবি), কথা কও, আমি বড় হব, রং বেরং প্রভৃতি । তার প্রথম ছবি ছিল পাতালপুরী । 

আকাশবাণীতে তিনি বহু নাটক প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেছিলেন ।

পুরস্কার ও সম্মাননা

তিনি আনন্দ পুরস্কার, উল্টোরথ পুরস্কার এবং যাদবপুর এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি. লিট পান ।



তিনি শেষ জীবনে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হন এবং ২ জানুয়ারি ১৯৭৬ সালে তিনি প্রয়াত হন ।
-------------------///---------------------

বিমল ঘোষ

১৯১০ সালে ১৮ মার্চ জন্ম। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে। পিতা ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের সঙ্গে যুক্ত জাতীয়তাবাদী কেমিস্ট অনাদিপ্রসন্ন ঘোষ। মাতার নাম ব্রজবালা দেবী। কলকাতার নারকেলডাঙা জর্জ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে (বর্তমানের গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট) ভর্তি হন মুদ্রণ ও বিজ্ঞাপন বিষয়ক ক্ষেত্রে শিক্ষালাভের জন্য।

সাহিত্যকর্ম 
তিনি ছাত্রাবস্থাতেই লেখালেখি করতেন। এ সময়েই ছোটদের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে। আর্ট কলেজে শিক্ষালাভের পর কর্মজীবন শুরু করেন 'অ্যাডভান্স' পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে। পরে যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। তাঁর উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকার ছোটদের আসর 'আনন্দমেলা' প্রতিষ্ঠা হয় ও প্রসার ঘটে। এই সময় তিনি 'মৌমাছি' ছদ্মনামে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর ছদ্মনাম আর আনন্দবাজার পত্রিকায় ছোটদের পাতা 'আনন্দমেলা' সম্পর্কে কোন এক সাহিত্যসভায় বলেছেন -

.....আকুল আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। আমিই ‘মৌমাছি’ ছদ্মনাম নিয়ে 'আনন্দমেলা'-র পরিচালনা করি। আসল নাম জানাতে চাই না। দু’-চারটি কথা বলে আজই ফিরে যাব। আমি মৌমাছি, আমার কাজই হল দেশের বিভিন্ন পুষ্পোদ্যান থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক অর্থাৎ আনন্দমেলা-য় জমা করা এবং তোমাদের কাছে পরিবেশন করা। তোমাদেরও এই মধু সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিতে হবে শহরের, গ্রামের ও শহরতলির দূরদূরান্তে। এ বিষয়ে আমার বিশেষ পরিকল্পনা 'আনন্দমেলা'-র মারফত তোমাদের জানাব। 'আনন্দমেলা'-র দিকে নজর রেখো। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী, নেতাজি, দেশবন্ধু, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় প্রমুখ মহাপুরুষেরা যে শিক্ষা সামনে রেখে গিয়েছেন তাকে সার্থক করে তোলাই হবে তোমাদের আদর্শ ও লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে কী ভাবে পৌঁছাবে তাই নিয়ে আমি এবং কয়েক জন সহকারী বন্ধু চিন্তা করছি এবং তোমাদের জানাব আনন্দমেলা-র মাধ্যমে।...”

           তিনি বন্ধুদের সাথে শলাপরামর্শ করেই 'আনন্দমেলা' মারফত জানালেন তাঁর পরিকল্পনা অর্থাৎ 'মণিমেলা' নামের সংগঠন গড়ার। আনন্দমেলার মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের জন্য গড়ে ওঠা এই সংগঠন এক সময় বাংলা ও বাংলার বাইরে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বহু স্থানে 'মণিমেলা'র শাখা গড়ে উঠেছিল। ছোটদের জন্য তিনি অজস্র ছড়া কবিতা নাটক গল্প উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত শিশু সাহিত্যের সংখ্যা এক-শো চল্লিশ। 'মায়াময়ূর' তাঁর জনপ্রিয় নাটক। মৌমাছি’ ছদ্মনামে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ‘
"চেঙাবেঙা' বইটির জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব উৎসবে তিনি ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেন। বিমল ঘোষ আকাশবাণীর সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন।

রচনাবলী :
' ইউরোপের অগ্নিকোণে'
'কামাল পরদেশী'
'চেঙাবেঙা'

৭ ই মার্চ ১৯৮২ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।
---------------------/////-------------------
বিমল মিত্র

১৯১২ সালের ১৮ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন, কলকাতায়। পিতা সতীশচন্দ্র মিত্র। শিক্ষা চেতলা স্কুল, আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। রেলে চাকরি করতে করতে সাহিত্যচর্চা। প্রথম উপন্যাস ছাই'। । তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাস 'কড়ি দিয়ে কিনলাম', 'একক দশক শতক', 'চলো কলকাতা', 'পতি পরম গুরু', ‘আসামী হাজির’ ইত্যাদি। প্রায় পাঁচশোটি গল্প ও শতাধিক উপন্যাসের লেখক বিমল মিত্র তাঁর 'কড়ি দিয়ে কিনলাম' গ্রন্থের জন্য ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। তাঁর রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। 

বিশ শতকের পাঁচ এর দশকে সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলার সাহিত্যাকাশে যার আবির্ভাব,  পেশায় রেলের চাকরি হলেও পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন ।পাঁচশোর বেশি গল্প এবং শতাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন। এক সময় তিনি কালি কলম পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
রচনা কর্ম :
ছাই (১ম)
একক দশক শতক
সাহেব বিবি গোলাম
কড়ি দিয়ে কিনলাম
বেগম মেরী বিশ্বাস
চলো কলকাতা
পতি পরম গুরু
এই নরদেহ
এরই নাম সংসার
মালা দেওয়া নেওয়া
তোমরা দুজনে মিলে
গুলমোহর
যা দেবী
আসামী হাজির


নিজের সম্পর্কে নিজেই মূল্যায়ন করেছেন বিমল মিত্র “...সত্যিই আমার কিছু হয়নি। অবশ্য তা নিয়ে আমি দুঃখও করি না। কারণ জীবনে যে কিছু হতেই হবে তারই বা কী মানে আছে। আকাশের আকাশ হওয়া কিংবা সমুদ্রের সমুদ্র হওয়াটাই তো যথেষ্ট। লেখক আমি হতে না-ই বা পারলাম, মূলতঃ আমি একজন মানুষ। মানুষ হওয়াটাই তো আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। কারণ তরুলতা অরি সহজেই তরুলতা, পশু-পাখি অতি সহজেই পশু-পাখি, কিন্তু মানুষ অনেক কষ্টে অনেক দুঃখে অনেক যন্ত্রণায় অনেক সাধনায় আর অনেক তপস্যায় তবে মানুষ। আমি কি সেই মানুষই হতে পেরেছি?”

মানুষ হতে পেরেছিলেন কিনা, নিজের কাছে সে প্রশ্ন রেখেছিলেণ বিমল মিত্র। কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যে একজন পথিকৃৎ ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।



মৃত্যু 
বিমল মিত্র ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর দক্ষিণ কোলকাতার নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
       দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
       Doinik Sabder Methopath
       Vol - 314. Dt -18.03.2021
         ৪ ঠা চৈত্র, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
----------------০০০০০------------------

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...