Friday, 19 March 2021

আবৃত্তি কর্মশালা ।
     পর্ব -১
বিষয় : জন্মভূমি বা স্বদেশভূমি

¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶
১. 
ভারততীর্থ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হে মোর চিত্ত,পূণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে–
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে
নমি নর-দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে
বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর,
নদীজপমালাধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র
ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
রণধারা বাহি জয়গান গাহি
উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত
যারা এসেছিল সবে,
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর,
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে
তারি বিচিত্র সুর।
হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো,
ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো,
বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবে
দাঁড়াবে ঘিরে
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
হেথা একদিন বিরামবিহীন
মহা ওংকারধ্বনি,
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে
উঠেছিল রনরনি।
তপস্যাবলে একের অনলে
বহুরে আহুতি দিয়া
বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল
একটি বিরাট হিয়া।
সেই সাধনার সে আরাধনার
যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার,
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে
আনতশিরে–
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
সেই হোমানলে হেরো আজি জ্বলে
দুখের রক্ত শিখা,
হবে তা সহিতে মর্মে দহিতে
আছে সে ভাগ্যে লিখা।
এ দুখ বহন করো মোর মন,
শোনো রে একের ডাক।
যত লাজ ভয় করো করো জয়
অপমান দূরে থাক।
দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান
জন্ম লভিবে কী বিশাল প্রাণ।
পোহায় রজনী, জাগিছে জননী
বিপুল নীড়ে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা
তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।

২.
আমার ভারতবর্ষ
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আমার ভারতবর্ষ
পঞ্চাশ কোটি নগ্ন মানুষের
যারা সারাদিন রৌদ্রে খাটে, সারারাত ঘুমুতে পারে না
ক্ষুধার জ্বালায়, শীতে ;
কত রাজা আসে যায়, ইতিহাসে ঈর্ষা আর দ্বেষ
আকাশ বিষাক্ত করে
জল কালো করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায়
ক্রমে অন্ধকার হয় ।
চারদিকে ষড়যন্ত্র, চারদিকে লোভীর প্রলাপ
যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ আসে পরস্পরের মুখে চুমু খেতে খেতে
মাটি কাঁপে সাপের ছোবলে, বাঘের থাবায় ;
আমার ভারতবর্ষ চেনে না তাদের
মানে না তাদের পরোয়ানা ;
তার সন্তানেরা ক্ষুধার জ্বালায়
শীতে চারিদিকের প্রচণ্ড মারের মধ্যে
আজও ঈশ্বরের শিশু, পরস্পরের সহোদর ।
৩.
বাংলাদেশ
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

কোন্ দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
দলতে হয় রে দুর্বা কোমল?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
সোনার কমল ফোটেরে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে

কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
ফিঙে নাচে গাছে গাছে?
কোথায় জলে মরাল চলে,
মরালী তার পাছে পাছে?
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
চাতক বারি যাচে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!

৪.
জননী জন্মভূমি 
সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে
কখনো মুখ ফুটে বলিনি
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলা লেবু
শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভরে উঠতো।
আমার ভালবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি।

হে দেশ, হে আমার জননী-
কেমন করে তোমাকে আমি বলি!

যে মাটিতে ভর দিয়ে আমি উঠে দাড়িয়েছি
আমার দু’হাতের
দশ আঙুলে
তার স্মৃতি।

আমি যা কিছু স্পর্শ করি
সেখানেই
হে জননী,
তুমি।
আমার হৃদয় বীণা
তোমারই হাতে বাজে।

হে জননী,
আমরা ভয় পাইনি।
যারা তোমার মাটিতে নিষ্ঠুর থাবা বাড়িয়েছে
আমরা তাদের ঘাড় ধরে
সীমান্ত পার করে দেব।
আমরা জীবনকে নিজের মতো করে
সাজাচ্ছিলাম
আমরা সাজাতে থাকব।

হে জননী,
আমরা ভয় পাইনি।
যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা বিরক্ত।

মুখ বন্ধ করে
অক্লান্ত হাতে – হে জননী,
আমরা ভালবাসার কথা বলে যাব।।  

৫.
বঙ্গভূম 
শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়


ত্যামুন দিন কবে আসবেক
যখুন গরুড় বাহনে চড়ি আকাশে যেতি যেতি মা-লক্ষ্ণী শুধাবেন
উদিক উটা কী দেশ গ';
লদী ভরি জল টমটম করে, মাঠ ভরি ধান
কাল-কাল মানুষগুলান খিলখিল খিলখিল করি হাসে।
অন্তরযামী, লারায়ণ মিটিমিটি হাসবেন।
শুধাবেন, 'তুমার মনে লাই
কতবার এইচ ইদিকে, তুমার মনে লাই
কত পুজা লিউচ
ই হল বঙ্গভূম।

বান হইছিল, উরা বাঁধ বাঁধল
লদী শুকাইছিল, এখুন কেলান হইচে,
বচ্ছরে তিন-তিনবার ধান উঠে। দেখ ক্যানে
লতুন দালান হইচে কত। উদের আর কষ্ট লাই।
বিকালের সোনার পারা লহর
উই শুন__ টিকটিক টিকটিক করি শব্দ উঠে__
বল দিনি, উ কিসের শব্দ?'
'কী জানি।' মা-লক্ষ্ণী অবাক হই তাকান।
'মানুষ এখুন কাজ করি ফিরছে।
শিশুরা পড়া করি ফিরছে।
উ মুড়ি খাওয়ার শব্দ বটে; দুধে ভিজাই মুড়ি খায়
বঙ্গভূমের মানুষ!'
হায়, ত্যামুন দিন কবে আসবেক গ'? কবে আসবেক?
দুধ পাবেক, পেট ভর মুড়ি পাবেক পোড়া দেশের মানুষ!
ত্যামুন দিন কবে আসবেক গ'?

৬.
বঙ্গভূমির প্রতি
 মাইকেল মধুসূদন দত্ত

রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধু,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে, দৈবের বশে,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সেই ধন্য নরকূলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদ সেবে সর্বজন;-
কিন্তু কোন গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্ম দে!
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ, ধর
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কী বসন্ত, কী শরদে!

৭.
আমার নাম ভারতবর্ষ 
অমিতাভ দাশগুপ্ত

স্টেন গানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র—
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে
চা-বাগিচায় কফি খেতে,
কয়লা-খাদানে, পাহাড়ে-অরণ্যে
লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা—
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ
খুনীর চেয়েও রুক্ষ কঠোর মাটিতে
বোনা হয়েছে যে-অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন—
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার ঠাণ্ডা মুখের ওপর
এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে
ভাক্ রা নাঙ্গালের পাথুরে বাঁধের গম্ভীর ছায়া।
ডিগবয়ের বুক থেকে
মায়ের দুধের মত উঠে আসা তোলো ভেসে যাচ্ছে
আমার সারা শরীর।
কপাল থেকে দাঙ্গার রক্ত মুছে ফেলে
আমাকে বুকে ক’রে তুলে নিতে এসেছে
আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর।
আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ
প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম।
প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর
শোক নয় ক্রোধের আগুনে
দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।

ভরাট গর্ভের মত
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
বৃষ্টি আসবে।
ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝবরাবর
ঝরে যাবে বরফ-গলা গঙ্গোত্রী।
আর একটু পরেই প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর
কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত।
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুদ চুম্বনে।

ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়
সাঁওতালী মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে
জেগে উঠবে তুমুল উৎসবের রাত।
সেই রাতে
সেই তারায় ফেটে পরা মেহফিলের রাতে
তোমরা ভুলে যেও না আমাকে
যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্ জে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম
মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
. স্বদেশ
. স্বাধীনতা
. ভারতবর্ষ॥

৮.
ভারতবর্ষের মা
অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়
 

৯.

১০.

++++++++++++০০০0০০০০+++++++++++++
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -315. Dt -19.03.2021
৫ চৈত্র, ১৪২৭. শুক্রবার
=============∆∆∆∆∆∆============

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...