প্রথমে একটি শৌখিন জুতার দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানে সারা দিন শ্রম দিতে হতো তাকে। এরপর কিশোর পেশকভ কাজ নেন কয়েদি বহনের জাহাজে। তার কাজ ছিল জাহাজের কর্মচারীদের বাসন-কোসন ধোয়া।
সেখানে ভোর ছয়টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তাকে ঘাম ছুটাতে হতো। পেটের দায়ে ভালো কাজের আশায় পেশা বদলাতে থাকেন পেশকভ। কিন্তু কোথাও শান্তি পাননি।
অবশেষে পেশকভ শান্তি খুঁজে পান বইয়ের পাতায়। তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা। অভাব-অনটন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম- এত কিছুর মধ্যেও থামেনি তার বই পড়া। রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই তাকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
দরিদ্রতা পেশকভের পিছু ছাড়েনি। এক পর্যায়ে তিনি কাজ নেন একটি রুটির কারখানায়। সেখানে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত একটানা কাজ করতে হতো। দারিদ্র্যের কশাঘাত আর দিনের পর দিন ঘামঝরা শ্রমের ধকলে মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।
জীবন হয়ে পড়ে তার কাছে অর্থহীন। তিক্ত জীবনের অবসান ঘটাতে পিস্তল কেনেন তিনি।
সময়টা ১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। পেশকভের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকেই গুলি করলেন পেশকভ। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
চিকিৎসকরা তার জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তার দ্বিতীয় জীবন। নব-উদ্যমে জীবন শুরু করেন পেশকভ। সেই থেকে লেখালেখির গোড়াপত্তন। ধারণ করেন নতুন নাম- মাক্সিম গোর্কি। রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম অর্থ সর্বাধিক আর গোর্কি অর্থ তেতো।
প্রথাগত রচনার বাইরে গোর্কির লেখায় প্রাধান্য পায় সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনালেখ্য। ১৮৯৮ সালে তার লেখা প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি সংকলন ‘রেখাচিত্র ও কাহিনী’ প্রকাশিত হয়।
বইটি প্রকাশের পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গোর্কির খ্যাতি। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় তার সার্থক উপন্যাস ফোমা গর্দিয়েভ। ১৯০১ সালে বিপ্লবী ছাত্রদের হত্যার প্রতিবাদে গোর্কি রচনা করলেন ‘ঝোড়ো পাখির গান’ নামের কবিতা। ওই কবিতা হয়ে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র। তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদের মুখে তাকে ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় সরকার।
ক্রমে গোর্কি হয়ে ওঠেন লেনিন আদর্শের কর্মী, লেখনীর মাধ্যমে মানবিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরার সুদক্ষ শিল্পী। গোর্কিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
সুস্থ হয়ে নাটক লিখতে শুরু করেন গোর্কি। ১৯০২ সালে লিখলেন লোয়ার ডেপথ। এই নাটকের পর গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে যায় সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক লিওনিদ লিওনভকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘আমি দেখতে ভালোবাসি মানুষের বেড়ে ওঠা।’ সেই মানুষের বেড়ে ওঠা দেখার সবচেয়ে ভালো সময় ছিল এই ভ্রমণকাল।
লেখনীর কারণে জীবনে বহুবার জার শাসকের রোষানলে পড়েছিলেন গোর্কি। বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। আবারও গ্রেফতার হতে পারেন এমন খবর পেয়ে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
অবশেষে তিনি জার্মানি ও ফ্রান্স হয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯০৭ সালে সেখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস মা। এ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি নাম লেখান অমরত্বের খাতায়।
পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রীত উপন্যাসের নাম ‘মা’। পৃথিবীর সকল দেশে, সকল ভাষাভাষীর মধ্যে, সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘পাভেল’ নাম্নী যুবকের সন্ধান পাওয়া যাবে। অনেকেরই ধারণা নেই যে, এটি ‘মা’ উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র পাভেলের নামানুসারে রাখা হয়ে থাকে। ‘মা’ উপন্যাসের পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত প্রভাবের এটি একটি দিক। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লড়াইতে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে ‘মা’ উপন্যাস। এখনো এই চিন্তাধারা বহমান। পাশাপাশি শৈল্পিক বিবেচনাতেও এই উপন্যাসকে পাঠ করতে হয় রুশ তথা সারা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমীদের। সাহিত্যিক মতাদর্শ হিসেবে একসময় আবির্ভূত হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ’। সেই মতাদর্শের পরিপূর্ণ ধারক সাহিত্যিক-মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯০৬-০৭ সালে রচিত এই উপন্যাসটিকে।
প্রথম লেখা প্রকাশের ১০ বছরের মধ্যেই মাক্সিম গোর্কি রাশিয়ার সাহিত্যজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। লেভ তলস্তয় ও আন্তন চেখভের মতোই তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা হয়ে দাঁড়ায় আকাশছোঁয়া। এমনকি গোর্কি তখন যে পোশাক পরতেন, সেই পোশাকটিও সমাজের অনেক স্তরের স্টাইলিস্ট মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। তিনি পরতেন নীল রঙের গলাবন্ধ কোর্তা, বোতাম-আঁটা হাতা, চাষাভূষাদের কানাততোলা বুটজুতা। সেই পোশাক হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের প্রতীক। অথচ তখনো তিনি ‘মা’ উপন্যাস রচনা করেননি।
১৯০৬ সালে জার সরকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তিনি প্রথমে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ডে চলে যান। পরে সুইজারল্যান্ড হয়ে আমেরিকায়। সেখানেই রচিত হয় অবিস্মরণীয় ‘মা’ উপন্যাসটি।
বস্তুত রুশ সাহিত্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে প্রতিভার মিছিল। তারপরও রাশিয়ার সাহিত্যজগতে মাক্সিম গোর্কির স্থান অনেক উঁচুতে। সাধারণ মানুষ যেমন তাঁর রচনা পাঠ করেছে গভীর সহমর্মিতার সঙ্গে, তেমনই বিদগ্ধ সমালোচকরাও তাঁকে স্থান দিয়েছেন অনেক উঁচুতে। রুশসাহিত্যের প্রথম লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইভান বুনিন। সেই বুনিনের চাইতে সমকালীন গোর্কিকে অনেক ওপরের স্তরের লেখক বলে দাবি করতেন রুশবাসী। এই প্রসঙ্গে নন্দনতাত্ত্বিক মারিয়া তস্ভেতায়েভা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন—‘নোবেল পুরস্কার। ২৬ তারিখে অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকব বুনিনের সম্মানে। প্রতিবাদের দায় এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। প্রতিবাদ আমি করছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে আমি একমত নই। কেননা বুনিনের চাইতে নিঃসন্দেহে বড় তো বটেই—অনেক বড়, অনেক মানবিক, অনেক বেশি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়ও বটে—গোর্কি। গোর্কি একটি যুগ, বুনিন একটি যুগের অবসান। কিন্তু যেহেতু এটা রাজনীতি, যেহেতু সুইডেনের রাজা কমিউনিস্ট গোর্কির গলায় পদক ঝোলাতে পারেন না, অগত্যা...’
নোবেল পুরস্কার পাননি মাক্সিম গোর্কি। তার চাইতে বড় পুরস্কার পেয়েছেন। সে পুরস্কার হচ্ছে বিশ্ব মানবতার মুক্তিযাত্রার সহযোদ্ধার স্বীকৃতি।
রাশিয়ার আরেক দিকপাল লেখক আন্তন চেখভ লিখেছিলেন—‘আমি শুধু খোলাখুলিভাবে অকপটে মানুষকে বলতে চেয়েছিলাম—নিজেদের দিকে একবার দেখুন, দেখুন-না কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা! সবচেয়ে বড় কথা, লোকে যেন বুঝতে পারে, আর বুঝতে যখন পারবে তখন অবশ্যই তারা নিজেদের জন্য গড়ে তুলবে আর-এক জীবন, আরো ভালো এক জীবন। আমি তা দেখতে পাব না, কিন্তু আমি জানি তা হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম—যেমন আছে তার মতো নয়। আপাতত তা যখন নেই, তখন আমি মানুষকে বলব, একবার বোঝার চেষ্টা করুন, কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা।’
আন্তন চেখভ যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-এর পথচলা। নিজেদের বিশ্রী জীবন বদলানোর সর্বাত্মক যুদ্ধে শরিক হয়েছে এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। ‘মা’ উপন্যাসের মাধ্যমে বিশ্বের উপন্যাসসাহিত্যে আর একটি নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। মাক্সিম গোর্কিই পৃথিবীতে প্রথম লেখক, যিনি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রমিকদের সংগ্রামের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আর এই চিত্র ধারণ করে, পৃথিবীতে এই ধারার প্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ‘মা’।
মৃত্যু - ১৮ জুন ১৯৩৬.।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
Doinik Sabder Methopath
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Vol -324. Dt -28.03.2021
১৪ চৈত্র,১৪২৭. রবিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷||||||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
No comments:
Post a Comment