"মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এ বিশ্বাসী উৎপল দত্ত চেয়েছিলেন নাটকের মাধ্যমে সামাজিক জীবনের বদল ঘটাতে। ফলে তাঁর নাটকে বাস্তবতা এসেছে তীক্ষ্ণ এবং অনাবৃত্ত রূপে। জগৎ ও জীবনের কোমল সুন্দর মুহূর্তের প্রতি তাঁর কোন আস্থা ছিল না। আর ছিলনা বলেই তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে রুক্ষতা ও রূঢ়তা লক্ষ্য করা যায়। সেই কারণেই তাঁর নাটকের সংলাপও তীক্ষ্ণ , যা পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।"
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ড স্কুলে । তারপর বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ স্কুলে। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ।যে কোন ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে সমকাল, পারিবারিক পরিমণ্ডল সর্বোপরি প্রতিভা খুব গুরুত্বপূর্ণ। উৎপল দত্তের ক্ষেত্রে এই তিনের নিখুঁত মেলবন্ধন তাঁকে তাঁর প্রতিভার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। উৎপল দত্তের জীবনী পর্যালোচনায় জানা যায় তাঁদের বাড়ির সদর দরজায় নাকি তাঁর মায়ের হাতে তৈরি এমব্রয়ডারি করা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের সংলাপ ঝুলত। মেজদা মিহিররঞ্জন কিশোর উৎপলকে শেক্সপিয়ারের নাটকের গল্প পড়ে শোনাতেন। বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে নাটক শোনার চল ছিল। সুতরাং বোঝাই যায় উৎপল দত্তকে তাঁর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর পারিবারিক উপাদান কম ছিল না।
দাম্পত্য সঙ্গী - শোভা সেন (বি. ১৯৬০–১৯৯৩)
সন্তান - বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত।
নাট্যকার রূপে আবির্ভাবের পূর্বে তিনি অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন ১৯৪৭ সালে জিওফ্রে কেন্ডালের শেক্সপিয়ার ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানিতে যোগ দেন। শুধু শেক্সপিয়ারের নাটক নয় বার্নাড শ, গোল্ডস্মিথ প্রভৃতি নাট্যকারের নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪৯ এ লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং উপলব্ধি করেন সমকালীন রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্বিপাকময় পরিস্থিতি, যার মধ্যে ছিল দেশ বিভাগ তেভাগা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্যা মহামারী দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সমাজ গড়ার পরিকল্পনা তিনি দীক্ষিত হন মার্কসবাদে। ১৯৫১ সালে তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কৃতিক নাট্যসংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হোন- নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে. গণনাট্য সংঘের প্রথম বাংলা নাটক 'সাংবাদিক" রচনা করেন ১৯৫২ সালে। এটি অনুবাদ মূলক নাটক। এছাড়া তিনি অনুবাদ করেছিলেন শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ মার্চেন্ট অফ ভেনিস মিডসামার নাইটস ড্রিম জুলিয়াস সিজার, জার্মান নাট্যকার ভোলিফ প্রফেশর মামলক , ম্যাক্সিম গোর্কির লোয়ার ডেপথস এর অনুবাদ নীচের মহল প্রভৃতি। তাাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ১৯৫৮ তে প্রকাশিত হয় ছায়ানট ।পরবর্তীতে অনেক নাটক তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে অভিনয়ের মাধ্যমে - " বর্গী এলো দেশে টিনের তলোয়ার সূর্যশিকার ব্যারিকেড টোটা ,দুঃস্বপ্নের নগরী লেলিন কোথায় এবার রাজার পালা তিতুমীর দাঁড়াও পথিকবর শৃংখল ছাড়া অগ্নিশয্যা নীল সাদা লাল একলা চলো দৈনিক বাজার পত্রিকা লাল দুর্গ ক্রুশবিদ্ধ ফুলবাবু জনতার আফিম ফেরারী ফৌজ অজয় ভিয়েতনাম মানুষের অধিকার দিন বদলের পালা টিনের তলোয়র ,ঘুম নেই প্রভৃতি।
নাটক নির্বাচন নাটকসম্পাদনা ভূমিকা বন্টন মহড়া আলো-শব্দে মঞ্চ সাজসজ্জা সঙ্গীত প্রভৃতি দিক থেকে সমন্বিত করে তিনি যে নাট্য পরিবেশনা র দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাতে এক যুগের দর্শক তাঁর কাছে ঋণী। সমালোচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনায় কৃতিত্ব নয় অভিনেতা হিসেবেও তাঁর উজ্জ্বল চরিত্র, মঞ্চ সাফল্য পেয়েছে, দর্শকের মন জয় করেছে।
উৎপল দত্ত অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র –
বিদ্যাসাগর (১৯৫০), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), চৌরঙ্গী (১৯৬৮), ভুবন সোম (১৯৬৯), গুড্ডি (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ঠগিনী (১৯৭৪), যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), কোরাস (১৯৭৪), পালংক (১৯৭৫), অমানুষ (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), গোলমাল (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), আঙ্গুর (১৯৮২), পার (১৯৮৪), পথভোলা (১৯৮৬), আজ কা রবিনহুড (১৯৮৭), আগন্তুক (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) ইত্যাদি।
তিনি অভিনয় করেছেন -
মামলক ( প্রফেসর মামলক), ওথেলো (ওথেলো) ভক্ত প্রসাদ (বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ) বেনীমধব (টিনের তলোয়ার ), স্ট্যালিন (স্ট্যালিন) ,মধুসূদন (দাঁড়াও পথিকবর) প্রভৃতি ।
নাট্যচর্চা কে প্রসারিত করতে তিনি এপিক থিয়েটার এবং প্রসেনিয়াম নামে দুটি থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
তিনি জানতেন -"নাটক মানে সংগ্রাম নাটক সংগ্রামের হাতিয়ার'। জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল . তাই ছাঁচে ঢালা দুর্বলতাহীন অবিমিশ্র নিখাদ বীর চরিত্রের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা তাই লোহার ভীম একাঙ্ক নাটকের সুলতান খানেের মুখে সেই সংলাপ বসিয়েছিলেন - "ক্ষুধার কাছে ইজ্জত দাঁড়াতে পারে না" এই নাটকের মঞ্চ নির্দেশ বর্ণনা ইবসেনীয় নাট্যরীতি কে মনে করিয়ে দেয় । তাাঁর একাঙ্ক নাটক গুলিতে সমাজ ও রাজনৈতিক দর্শন , ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ময় সংলাপ নাটকগুলোকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তাাঁর
ঘুম নেই, মে দিবস, ইতিহাসের কাঠগড়ায়, দ্বীপ, কাকদ্বীপের এক মা , লৌহমানব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি কিছু যাত্রাপালা লিখেছিলেন। যেমন
রাইফেল, জালিওয়ালাবাগ, দিল্লি চলো, সন্ন্যাসীর তরবারি, মাও সে তুং, মুক্তি দীক্ষা, অরন্যের ঘুম ভাঙছে, স্বাধীনতার ফাঁকি, দামামা ঐ বাজে, নীল রক্ত, জয়বাংলা, সমুদ্র শাসন, ঝড়, বৈশাখী মেঘ, তুরুপের তাস, সীমান্ত, সাদা পোশাক, কুঠার ও বিবিঘর।
লোকনাট্য গণবাণী তরুণ অপেরা এবং তাঁর নিজস্ব যাত্রাদল এই সমস্ত যাত্রাপালা অভিনয় করেছে । আর তাঁর একটি সাংগঠনিক দিক ছিল
- ১৯৬৪ তেে সত্যজিৎ রায় কে সভাপতি করে তিনি ব্রেখট সোসাইটি গঠন করেন। প্রসেনিয়াম ১৯৬২ ও এপিক থিয়েটার ১৯৬৫ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেে প্রকাশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলো হল -
বাংলা নাট্য জগৎ ও বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অসাধারণ শিল্পী উৎপল দত্ত এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ।যিনি অসামান্য ব্যক্তিত্ব ঐতিহ্যের প্রতীক। অসাধারণ পাণ্ডিত্য সৃজনশীলতার বস্তুবাদী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী ।শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রমী এক নাট্যকর্মী। যার উৎকর্ষ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা নাট্যজগতে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে । তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নাট্যকার অভিনেতা পরিচালক ও সংগঠক।
মৃত্যু - ১৯৯৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -325. Dt -29.03.21
১৫ চৈত্র,১৪২৭. সোমবার
======{{{{======{{{{{======={{{{{{=====
No comments:
Post a Comment