শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
"তোমরা পবিত্র হবে বলেআমি যজ্ঞাগ্নি বুকে করে এনেছি।
তোমরা তৃপ্ত হবে বলে
আমি আমার রক্তের রং বদলেছি।
তোমরা খুঁজেছিলে বলে
আমার চোখে মৃত্যুর ছায়া।
এখন দেখতে দাও -
রৌদ্রের ভেতর দিয়ে তোমরা চলেছ
যেখানে মন্দির। "
( তোমরা পবিত্র হবে বলে )
"আজ আবার আমরা বেরিয়েছি একসঙ্গে
অনেকদিন পরে
আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী
আমার স্ত্রীর পাশে যে লোকটি
সে যথাযোগ্যভাবে হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে
আমার স্ত্রীর স্বামী।"
(আমরা)
"এতদুর বৃষ্টিতে পাগল
আকাশ কাকে যে দেখে নেবে।
ভেবে ওই আপাত -পাগল
লোকটা একলা ভিজে গিয়ে
টের পায় মেঠো ইঁদুরের।
গন্ধে ভরে গেছে কলকাতা!
পাশে তার সদ্য নির্জনতা
একটিপ নস্যি দিয়ে নাকে
বলে কী হে, যাবে না অফিসে
এই নিয়ে যেন কতবার!
প্রশ্ন ছুঁয়ে গেল প্রশ্নকে
বিস্ময় ও বিপন্ন বোধ করে।"
(পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকুরী)
শব্দের পর শব্দ সাজালেই কবিতা হয়ে ওঠে, এমন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কবিতা শরীর যারা বিচার করেন , তাদের ক্ষেত্রে কবি দিব্যেন্দু পালিত সরব হয়ে বলেছেন -" এও বুঝি কবিতা শুধু শব্দ নিয়ে; ছন্দ নিয়ে; লেখা নয়, ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়া নয়, স্লোগান বা সংঘ সমিতি নয় রক্ত ক্লেদ সুখে অস্পষ্ট কবিতা অত্যন্ত দূরের বিষয় ।"
অর্থাৎ কবিতা হতে গেলে শুধু ছন্দ শব্দ এর কচকচানি নয় যার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিষয় ও বক্তব্য সুন্দর ভাবে ফুটে উঠবে, মা একান্ত কবির দৃষ্টিভঙ্গির ক্যানভাস। কবি দিব্যেন্দু পালিত মনে করেন কবিতা শুধু শব্দের নির্ণয় নয় এর একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি আছে , এর একটি আত্তীকরণ এর অনুষঙ্গ আছে , যা পাঠক ও স্রষ্টার মধ্যে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১৯৩৯ সালের ৫ মার্চ তিনি বিহারের ভাগলপুর শহরে জন্ম গ্রহণ করেন।প্রাথমিক থেকে স্কুল-কলেজের পাঠ সবই সেখানে। স্কুলজীবনের শেষ দিক থেকেই লেখালেখির শুরু। ১৯৫৮-য় বাবা বগলাচরণের মৃত্যু। তার পর আক্ষরিক অর্থেই ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে এসেছিলেন স্নাতক পরীক্ষায় সদ্য উত্তীর্ণ দিব্যেন্দু। কলকাতায় আসার পর অভাব যেন আরও জেঁকে বসল তাঁর জীবনে। হাতে পয়সাকড়ি প্রায় কিছুই নেই। নিজের পাশাপাশি মা-ভাইবোনদের জন্য ভাবনা। ঘনিষ্ঠ জনদের কাছে পরে দিব্যেন্দু পালিত সে সব দিনের গল্প বলেওছেন। শিয়ালদহ স্টেশনে রাতের পর রাত না খেয়ে কাটিয়েছেন। কিন্তু, লেখালেখি ছাড়েননি।এরই মধ্যে ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে এমএ পাশ করলেন। সেটা ১৯৬১ সাল। কর্মজীবনের শুরুও ওই বছর।
কর্ম জীবন শুরু হয় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে উপ-সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৫-তে যোগ দেন বিপণন ও বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত পেশায়। সেই সুত্রে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন ক্লারিয়ন-ম্যাকান এডভারটাইসিং সার্ভিসেস ,আনন্দবাজার এবং দ্য স্টেটসম্যান-এ।
ভাগলপুর কলেজে পড়বার সময় থেকেই গল্প লেখা শুরু। প্রথম গল্প ‘ছন্দপতন’ প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে। সেটা ১৯৫৫ সালের ৩০ জানুয়ারি। দিব্যেন্দু পালিতের বয়স তখন মাত্র ১৬। পরের বছর সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প ‘নিয়ম’। ভাগলপুর থেকে সব গল্পই তিনি ডাকে পাঠাতেন। ২০ বছর বয়সেই তাঁর প্রথম বই তথা প্রথম উপন্যাস ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৫৯ সাল। ওই উপন্যাস সম্পর্কে পরে দিব্যেন্দু বলেছিলেন, ‘‘লেখক হওয়ার জন্য সেই আঠেরো-উনিশ বয়সে আমি এতই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, পাণ্ডুলিপিটি পরিমার্জনা করার ও আদ্যন্ত ফিরে লেখার কথা ভাবিনি। সমালোচকহীন সেই মফস্সল শহরে এমন কেউ ছিল না, যে আমাকে দ্বিতীয় মত গ্রহণে সাহায্য করবে। আমি লেখক, আমিই তার পাঠক, ইতিমধ্যেই পিঠে পড়ে গেছে পরিচয়ের ছাপ, সুতরাং তর যে সইবে না, তাতে আর আশ্চর্য কী!’’ তাঁর পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠরা জানতেন, দিব্যেন্দু খুব মিতভাষী ছিলেন। খুব উঁচু স্বরে কথাও বলতেন না।
উল্লেখযোগ্য রচনা :
ঘরবাড়ি’, ‘সোনালী জীবন’, ‘ঢেউ’, ‘সহযোদ্ধা’, ‘আমরা’, ‘অনুভব’-এ। পাশাপাশি তাঁর একাধিক ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন— ‘জেটল্যাগ’, ‘গাভাসকার’, ‘হিন্দু’, ‘জাতীয় পতাকা’, ‘ত্রাতা’, ‘ব্রাজিল’...।
১৯৮৪-তে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৬-তে রামকুমার ভুয়ালকা পুরস্কার, ১৯৯০-এ বঙ্কিম পুরস্কার, ১৯৯৮-এ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন দিব্যেন্দুবাবু। ইংরেজি ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর অনেক লেখা। চলচ্চিত্র, দূরদর্শন এবং রেডিয়োতেও রূপায়িত হয়েছে অনেক কাহিনি।
২০১৯ সালের ৩ রা জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে মৃত্যু হল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব দিব্যেন্দু পালিতের। মৃত্যুর সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
বিশুদ্ধ কবিতা পাঠ -
,আত্মীয়
"কাল রাতে ঝড় এসে ঢুকেছিল পরিচিত ঘরে।লোকেন ছিল না। তার জার্নালের পাতা কটি উড়ছে হাওয়ায়;
সেলফে যে সব বই ব্যবহৃত, ব্যবহার হবে বলে এসেছিল, সব,
দেয়ালে যৌবন: তিনটি পেরেকের মাতন দেখেছে; চিবুকের কাছে এসে কম্পিত অধর যেন শঙ্কিত নীরব।
লোকেন ছিল না।তার স্বরলিপিলেখা খাতাখানি রবীন্দ্রনাথের দিকে চোখ চেয়ে খাঁ -খাঁ শূন্যতাকে ঢাকবার ব্যর্থতায় একবার শুধু কেঁপেছিল।
ধূর্ত টিকটিকি তার বান্ধবীর কাছাকাছি গিয়ে জ্যোৎস্নার আলোয় কিছু ভয় পেয়ে দূরত্বে পালাল।
পর্দার কাঁপন দেখে মনে হয় যেন কেউ এইমাত্র আসবে এই ঘরে:
মহাশ্বেতা কিংবা আরো অনায়াস, পরিচিত নাম।লোকেন ছিল না। তার একপাটি জুতো,
কিংবা পাঞ্জাবির ঝুল একপাশে বেশি কাত হয়ে-স্থির থেকে স্থিরতর হয়ে-
সময়ের কাছে গিয়ে অবশেষে নির্জনতা হল।
গায়ের চাদর ফেলে পা টিপে পা টিপে
মন্দিরের গদি থেকে একটি গভীর পাপ আস্তে উঠে এল।"
তাঁর কবিতাগুলি, মূলত গল্পের বা উপন্যাসের প্রাথমিক খসড়া, বলে মনে হয়।
===============////////==============
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
২০ ফাল্গুন,১৪২৭. শুক্রবার
Vol -301. Dt -05.03.2021
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment