Friday, 5 March 2021

                      জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
              কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্ত।  
         
"এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ 
তবু রঙ্গে ভরা".
বা 
"রসভরা রসময়  রসের ছাগল
তোমার কারনে আমি হয়েছি পাগল।"
বা 
"জননী জন্মভূমি আর কেন থাকো তুমি
ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে"
বা 
"মিছা মণিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তারচেয়ে রত্ন নাই আর।"
বা 
"অগাধ বিদ্যার বিদ্যাসাগর তরঙ্গ তায় রঙ্গনানা
তাতে বিধবাদের কূলতরী 
অকূলেতে কুল পেল না।"
বা 
"সোনার বাংলা করে কাঙাল ইয়ং বাঙাল মত জনা
সদা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কানে লাগায় ফোঁস ফোঁস না"
বা
"শয্যায় ভার্যার প্রায় ছারপোকা ওঠে গায়।"
বা 
"ধর্মতলা ধর্মহীন গোহত্যার ধাম।"
বা 
"কসাই অনেক ভালো গোঁসাই এর চেয়ে।"
 বা 
"তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি স বাঁকানো
কেবল খাব খোল বিচিলি ঘাস।"
বা
"আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল ব্রতধর্ম করতে হবে
একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কি তাদের তেমন পাবে। "

                          ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি ও সাংবাদিক সম্পাদক হিসেবে পরিচিত।  তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিভাস। মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ড খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। মুখ্যত তিনি ছিলেন কবিয়াল। উপরে প্রদত্ত তাঁর সরস উদ্ধৃতিগুলি সম্যক প্রতিভার পরিচায়ক।
        


১৮১২ সালের ৬ মার্চ  তাঁর জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী (বর্তমানে কাঁচড়াপাড়া) গ্রামে। এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে, যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম গুপ্ত ছিলেন নামকরা কবিরাজ এবং তার পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। মায়ের নাম শ্রীমতী দেবী। তার বয়স যখন দশ তখন তার মা পরলোকগমন করেন। পিতা ২য় বিয়ে করলে এর পর থেকে তিনি কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তার বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে।তাঁর যখন মাত্র দশ বছর বয়স, তখন হঠাৎই তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অকালেই প্রয়াণ ঘটে মা শ্রীমতী দেবীর। মাতৃবিয়োগের পর ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতায় চলে আসতে হয়। আশ্রয় নেন জোড়াসাঁকোয় মামারবাড়িতে। শৈশবকালে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগিতার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর না অগ্রসর না হলেও, অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির জোরে ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা,সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেন।তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ ক'রে জীবনী রচনা করেছেন। 

                               ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং কবিয়ালদের গান বেঁধে দিতেন। সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য খন্ডকবিতা সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের এ কবি স্বদেশমূলক যেসব কবিতা রচনা করেছেন তার জন্যও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

                               ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা। পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তাঁর। যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদ প্রভাকর ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করেন। অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন থেকে এটি দৈনিক পত্রে রূপান্তরিত হয়।ছাড়াও সংবাদ রত্নাবলী, পাষন্ডপীড়ন ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি রামপ্রসাদ সেন রচিত কালীকীর্তন (১৮৩৩) ও প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮) সম্পাদনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রচিত হিতপ্রভাকর (১৮৬১) ও বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতা সংগ্রহ (১৮৮৫) এবং সত্যনারায়ণ ব্রতকথা (১৯১৩)। 
সাংবাদিক রূপে ঊনবিংশ শতকের এই আধুনিক মানুষটি যথাযোগ্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন খন্ড খন্ড কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে মধ্যযুগীয় দেবো ভাবনার অবহিত সময় পড়বে সামান্য বিষয় নিয়ে তাঁর কবিতাগুলি - পাঁঠা ,আনারস ,তপসে মাছ  । সাহিত্য অঙ্গনে তার আবির্ভাব মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর সন্ধিক্ষণে। তাই তিনি যুগের কবি  নাকি যুগসন্ধিক্ষণের কবির , এনিয়ে সমালোচক মহলে আজও ঝড় ওঠে।  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাাঁকে "খাঁটি বাঙালি কবি" বলে অবহিত করেছেন । আবার অনেকে তাঁকে গুপ্ত কবি বলেও সম্বোধন করেছেন।
তাঁর প্রতিভা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন -"ঈশ্বরচন্দ্রের এই মহৎ গুণ ছিল যে তিনি খাঁটি জিনিস বড় ভালবাসিতেন, মেকির বড় শত্রু ."

                            বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন -"ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধোঁয়ায়, নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খানায় , পাঁঠার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পান , তাপসে মাছে মৎস্যাভাব ছাড়া তপস্বী ভাব দেখেন , পাঁঠার বোকাগন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান ."

আধুনিকতা ও প্রাচীনতা তাঁর কাব্যে যে বর্তমান সেই অনুসন্ধান করে সমালোচক তারাপদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন -"ঈশ্বরচন্দ্র যুগের সৃষ্টি তিনি যুগস্রষ্টা নন। যে কবি যুগস্রষ্টা,  জগৎ জীবন সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব একটি দর্শন থাকে ।ইহা দ্বারাই তিনি প্রাচীন যুগের কবি গোষ্ঠী হইতে আপন স্বাতন্ত্র্য সূচিত করিয়া নতুন যুগের প্রবর্তন করেন । কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় কোন 'message of life ' নাই. তাঁহার মধ্যে আধুনিকতার যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা ঐ যুগের‌ই লক্ষণ , ঈশ্বরচন্দ্রের নিজস্ব সৃষ্টি নয়."

১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ (২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯) তাঁর মৃত্যু হয়.
=============∆∆∆∆∆=============
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -302. Dt -06.03.2021
২১ ফাল্গুন, ১৪২৭. শনিবার
################################

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...