Wednesday, 3 March 2021

                  প্রথম বাঙালি মহিলা।

ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় রচনা করেছেন।

মাত্র ২১ বসন্ত বাহারে পলাশবীথি সবুজমন।

১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ রামবাগানের দত্ত পরিবারে তরু দত্তের জন্ম। পিতা গোভিন চন্দ্র দত্ত। মা ক্ষেত্রমোহিনী। গোভিন চন্দ্রের তিন সন্তান, অরু, তরু ও পুত্র অব্জু। সবাই ছিলেন স্বল্পায়ু। অব্জু বেঁচে ছিলেন মাত্র চোদ্দ বছর। অরু দত্ত মারা যান কুড়ি বছর বয়সে। আর তরু ৩০ আগস্ট ১৮৭৭, একুশ বছর বয়সে।

সেযুগে রামবাগানের দত্ত পরিবার ছিল শিক্ষিত ও ধনী। এই পরিবারের রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ, রাজনীতিজ্ঞ এবং আইএএস হয়ে আলিপুর কোর্টে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদানসীন। তাঁরই নামানুসারে তরু দত্তের বাসভবনের সামনের মানিকতলা স্ট্রিট আজ রমেশ দত্ত স্ট্রিট।

তরুর পরিবার ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ তৎকালীন খ্রীষ্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকদের সংস্পর্শে এসে ১৮৬২ সালে সপরিবারে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে যে গির্জা, সেখানেই তাঁদের ধর্মান্তরণ ঘটেছিল।

একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যুর পর তরুর বাবা ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৬৯ সালে ফ্রান্সে আসেন, তরু এবং অরুকে ভর্তি করেন দক্ষিণ ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে। সেখানে দুই বোন ফরাসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শুরু হয় দুজনের কবিতা লেখা। ১৮৭১ সালে তাঁরা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে শুরু ইংরেজি ভাষার চর্চা। সেখানে তাঁরা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হায়ার লেকচারস ফর উইমেন’-এ যোগদান করেন। ১৮৭৩ সালে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন মূলত ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে। ১৮৭৪ সালে অরু মারা যান। তরু দত্ত বোনের মৃত্যুতে ভীষণ আঘাত পান, কারণ সর্বদা দুই বোন মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। দুজনে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার বেশ কিছু কবিতা তরু লিখেছেন, অরু অলংকরণ করেছেন।


জীবনের অধিকাংশ সময় ইউরোপে কাটালেও তরুর অন্তরে গভীর ভালোবাসা ছিল দেশের প্রকৃতি, গাছপালা, পুরান, মহাকাব্যের ওপর। নদী মাঠ ক্ষেত ছিল তাঁর প্রকৃতিপ্রেম সম্পর্কিত কবিতার বিষয়। তিনি যেমন লিখেছেন ফরাসি কৃষিজমির কথা, তেমনই লিখেছেন দেশের পুকুর, বড় বড় ছায়াভরা গাছের কথা। তাঁর কবিতায় ভিড় করেছে তাল, তমাল তরু, শিমুল ফুল, বাঁশ বাগান। চাঁদের জ্যোৎস্না খেলা করেছে তাঁর কবিতার ছন্দে। ঝাউবন তাঁর মনে, কবিতায় অনুরণন তুলতো অনুক্ষণ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটি ‘Our Casurina Tree’। পদ্মফুলও ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়, কবিতার নাম ‘Lotus’। তরু দত্তের লেখায় মানবজীবনের সমস্যা যেমন উঠে এসেছে, পুরান, রামায়ণ, মহাভারতও ছুঁয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। তৈরি হয়েছে সাবিত্রী, একলব্য, সীতা। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৮৭৬-এ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর ১৫০টি কবিতার সংকলন ‘A Sheaf Gleaned in French Field’ (ফরাসি ক্ষেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের প্রতি ভালোবাসায় নিজ ব্যয়ে কবিতা সংকলনটি প্রকাশ করেন ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে। এর মধ্যে চারটি কবিতা দিদি অরু দত্তের অনুবাদ। ১৮৭৭ এ সমালোচক এডমন্ড গুজ এটি পড়েন এবং ভূয়সী প্রশংসা করে রিভিউ প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বইটির আরো সংস্করণ বের হয়। কিগান পল লন্ডন থেকে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন।সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নেওয়া ‘Ancient Ballads and Legends of Hindustan’ তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। ১৮৭৭ এ তাঁর বাবা এর পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন।

তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ফরাসি ভাষায় ডায়রির আকারে লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জী’ (La Journal de Mademoiselle d’Arvers). এটি কোনো ভারতীয় লেখকের ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি অনুবাদ করে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বহু বছর পর ১৯৫৬ সালে এটি বই আকারে বের হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘Bianka’ বা ‘Young Spanish Maiden’ ও প্রথম ভারতীয় মহিলা লেখিকার ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস।


তরু দত্তের চিঠির সংকলনও প্রকাশ পায়। তাতে আছে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের লেখা চিঠি এবং বিদেশ থেকে দেশে আত্মীয়দের লেখা চিঠি। চিঠিগুলো থেকে তৎকালীন জীবনযাত্রা, তরুর প্রকৃতিপ্রেম, মানবচেতনা, তাঁর ভাবনা জানা যায়। এই সব লেখা থেকে তাঁর ভাষার দক্ষতা প্রকাশ পায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর লেখনীতে। মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও এক হাতে ফরাসি অন্য হাতে ইংরেজি সাহিত্যকে ছুঁয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসি কোমলতা ও ইংরেজি আভিজাত্য – এই তিন নিয়েই তরু দত্ত।

তরুর মৃত্যুর পর কলকাতার বাস উঠিয়ে যে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান গোভিন চন্দ্র দত্ত, সে বাড়ি কেনেন জনৈক বসু পরিবার। সেই বিশাল বাড়ি, ক্যাসুরিনা গাছঅলা সেই বাগান আজ ১২এ, বি ও সি তিনটি আলাদা নম্বরে বিভক্ত। রমেশ দত্তের বাড়ি প্রোমোটারের হাতে পড়ে এখন মধ্যবিত্তের বাক্সবাড়ি। ১২বি ও ১২সি’র বাসিন্দা এ বাড়ি হেরিটেজ ঘোষনার দাবী জানিয়েও পরবর্তীকালে নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। ১২এ অংশের মালিকানা দেবকুমার বসু এবং তাঁর স্ত্রী শোভাবাজার রাজপরিবারের কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর। তাঁরা জানান, তরু দত্তের কোনো অস্থাবর সম্পত্তি বা ছবি নেই আর এখানে। কিন্তু দত্ত পরিবারের ব্যবহৃত কাঠের সিঁড়িটি তাঁরা রেখে দিয়েছেন অবিকল.

একুশ বছরের মেয়েকে স্নেহময় পিতা সমাহিত করেন মানিকতলার খ্রীষ্টান সিমেটারিতে। পরিবারের অনেকেই সমাধিস্থ হয়েছেন ওখানে। সমাধি ক্ষেত্রের উত্তরপশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সপরিবার তরু দত্তের সমাধি। ছোট কালো পাঁচিলের ঘেরাটোপে একে একে অব্জু দত্ত, অরু দত্তের পাশে সমাধিস্থ তরু দত্ত।


তরু দত্তের সমাধি

তরুর ওপরের দিকে চিরনিদ্রায় শায়িত বাবা ও মা। প্রত্যেক কবরের ওপর একটি মার্বেল স্ল্যাব ও তার ওপর একটি ক্রশ। তরুর কবরও একই রকম দেখতে, তাতে লেখা -

TORU DUTT

YOUNGEST DAUGHTER OF

GOVIN CHUNDER DUTT

BORN 4 MARCH 1856

DIED 30 AUGUST 1877

ET THOU FAITHFUL UNTO DEATH AND

WILL GIVE THEE CROWN OF LIFE.

           ১৫০ তম  জন্মবর্ষে স্থাপিত ফলক


রমেশচন্দ্র দত্ত স্ট্রিটে অবস্থিত দত্ত পরিবারের সেই সিঁড়ি। বাঙালি প্রথম মহিলা তরু দত্তের স্মৃতিবিজড়িত আজও পথের সাথী হয়ে টিকে আছে।

তরু দত্তের 

SONNET

A sea of foliage girds our garden round,

But not a sea of dull unvaried green,

Sharp contrasts of all colors here are seen;

The light-green graceful tamarinds abound

Amid the mango clumps of green profound,

And palms arise, like pillars gray, between;

And o’er the quiet pools the seemuls lean,

Red–red, and startling like a trumpet’s sound.

But nothing can be lovelier than the ranges

Of bamboos to the eastward, when the moon

Looks through their gaps, and the white lotus changes

Into a cup of silver. One might swoon

Drunken with beauty then, or gaze and gaze

On a primeval Eden, in amaze.


চতুর্দশপদী

আমাদের বাগানকে ঘনিষ্ঠ বাঁধনে জড়িয়েছে পত্রপল্লবের অবাধ পাথার,

তবে সে সাগর নয় বৈচিত্র্যবিহীন সবুজের রাজ, একঘেয়ে নীরস বিস্তার,

সকল রঙের তীব্র বৈপরীত্য দেখতে তুমি পাবে এ-বাগানে;

গভীর সবুজ আম্রকুঞ্জগুলোর এখানে ওখানে

হালকা সবুজ লাবণ্যময় তিন্তিড়ী তরুদের ভিড়,

আর তার মধ্যে মধ্যে ধূসর থামের মতো তাল গাছ উচ্চশির;

পুকুরের শান্ত জলে নুয়ে আছে শিমুল গাছেরা ফুলে ভরা

লালে লাল, যেন চমক জাগানো তুর্যধ্বনি উঠেছে নিঃস্বরা।

সবচেয়ে মনোরম কিন্তু সারিবদ্ধ বাঁশবন পূর্বদিক জুড়ে

যার ফাঁকে ফাঁকে বিহ্বলের মতো মরে ঘুরে ঘুরে

আর থেকে থেকে উঁকি মারে চাঁদ, আর শ্বেতকমলেরা

রঙ পাল্টে হয়ে যায় রুপোর পেয়ালা। যে-কেউ লাগাম ছেঁড়া

বেহেড মাতাল হবে এ-সৌন্দর্য পানে, কিম্বা শুধু বাক্যহীন হয়ে

দেখবে আর দেখবে এক 

আদিম স্বর্গোদ্যান বিপুল বিস্ময়ে।

----------------////////----------------///////-----------------


দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার আজ ৩০০ দিন। সাহিত্যের অনন্ত পথে ..... পা ফেলতে ফেলতে আজ ৩০০ টি সংখ্যা প্রকাশিত হলো। আপনাদের নিরন্তর শুভেচ্ছা, সহযোগিতা ও আন্তরিকতায়। বসন্তের পলাশ প্রেমে কৃতজ্ঞতা জানাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। 

             দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পরিবার।

                ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার।

=================================

      Doinik Sabder Methopath.

       Vol -300. Dt -04.03.2021.

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

Krishnanagar. Khejuri. Purba Medinipur.

Cont. 9679450245.

Mail - janabishnupada99@gmail.com

------------------------------------------------

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...