"জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ করছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া".
জাত-ধর্মের নামে পৃথিবীকে নরকের আখড়ায় পরিনতকারীদের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মানবতার দূত কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল মূলত একটি দর্শনের নাম। নজরুল দর্শন হল অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানবতার দর্শন। যেখানে সবার উপরে মানুষ সত্য। এ দর্শন ধর্ম-বর্ণ, অর্থ-বিত্ত, ভৌগলিক সীমানা দ্বারা আবদ্ধ নয়। এ দর্শন মুক্ত, অবারিত। মানুষকে ভালোবাসাই যার মর্মবাণী।
নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের আবাস ভূমি এই বঙ্গ ভূখণ্ডে শান্তির সুবাতাস নিয়ে এসেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ধর্মীয় হানাহানি, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কবির ছিল দৃপ্ত উচ্চারণ। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে জীবনের শেষ বক্তব্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবির বলিষ্ঠ উচ্চারণ ছিল, “ আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কুলষিত-পুরাতন-পচা সেই সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবল হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি”।
নজরুল ছিলেন মূলত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির কারিগর। তিনি সাম্যের গান গেয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। এই কাতারটিই হল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির মূল মন্ত্রই মানুষ। যেখানে সবাই একে অপরের পরিপূরক। একে অন্যকে ছাড়া পরিপূর্ণ নয়, অসম্পূর্ণ। এ সম্পর্কে কবি বলেছেন,
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান |
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ ||
এক সে আকাশ মায়ের কোলে, যেন রবি-শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান ||
কবির অসাম্প্রদিয়িক চিন্তাধারা সম্পর্কে আমরা তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধ পড়লে স্বচ্ছ ধারণা পাই। তিনি লিখেছেন, নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।“
হালের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শ্লোগান “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” মূলত নজরুলের কথারই পরিবর্তিত রূপ মাত্র। এ সম্পর্কে কবি তাঁর “সাম্যবাদী কবিতায় বলেছেন।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!
নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কলাহল,
পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
কবি একদিকে যেমন রচনা করেছেন, হামদ-নাত আবার অন্যদিকে রচনা করেছেন ভজন-শ্যামা সঙ্গীত। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই। তিনি মনে করতেন ঈশ্বর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বন-জঙ্গল, সাগর-পাহারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর সর্বদা বিরাজমান। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর ঈশ্বর কবিতায় লিখেছেন,
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।
মানবতার কবি নজরুল, মানবতার অমর বানী প্রচার করেছেন তাঁর গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে। তিনি মনে করতেন মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। আর এ জন্যই তিনি সর্বজনীন। তাই তিনি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও সকল ধর্মের মানুষের। তিনি বঙ্গভূমিতে জন্ম গ্রহণ করেও সমগ্র বিশ্ব মানবতার। এ সম্পর্কে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সভায় বলেছিলেন, “ বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম।“
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সারাজীবনই সত্য ও সুন্দরের জয়গান করেছেন। মানবতার জয়গান করেছেন। আজকের এই সংঘাতময় পৃথিবীর জন্য তাই নজরুল দর্শন অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। নজরুল চর্চা অনেক বেশী সময়োপযোগী। সংঘাতময় পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস আনতে পারে কেবলই নজরুলের মানবতাবাদ।
=================================
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -344. Dt -16.4.2021
২রা বৈশাখ,১৪২৭. শুক্রবার
++++++++((<((((((((++++++++++(+++++(++
No comments:
Post a Comment