Friday, 30 April 2021

পথ ও পথিক প্রসঙ্গ রবিমানসের গভীরতম বোধ থেকে উৎসারিত  সত্য, সুন্দর ও পরমেশ্বর অন্বেষণের ভাবনা।  শুধু আধ্যাত্মিকতা কিংবা ধর্মীয় ভাবনার প্রেক্ষাপটে নয়, মানুষের মধুরতম প্রেমের প্রেক্ষাপটেও পথ প্রসঙ্গ, নবমাত্রায় অনন্ত আনন্দিত রবীন্দ্রনাথের গানে। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যে অনন্ত প্রেম সেই উপলব্ধির উপায় ব্যক্তি আমি চির আনন্দের প্রবাহে নিয়ত প্রবহমান। জাগতিক মায়াময় জগৎসংসারের বন্ধনে আবিষ্ট মন যথার্থ মুক্তির দিশা খুঁজে পায়না-  সেই জীবন একমাত্র খোঁজার উপায় - পথ । কবি সেই পথ কে ভালবেসে গেয়ে ওঠেন -

###    গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
 আমার মন ভুলায় রে ....

বাংলাদেশের আউল, বাউল, দরবেশ, সুফি-সাধকরা কবিতা ও গানে পথ ও পথিকের কথা তুলে ধরেছেন বারে বারে। বাংলাদেশে জমিদারির কাজে এসে এই ধারাটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীরতর পরিচয় ঘটে। বাংলার বাউলদর্শন ও প্রেমধর্ম কবিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়, বিশেষ করে লালনের গান ও দর্শনের পরিচয়ে।পল্লীর নিরক্ষর বাউলরা মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে ভর করে তাদের যে আধ্যাত্মিক জগৎ রচনা করেছেন, সেখানে পরমেশ্বর এসেছেন অরূপ রতন বা মানুষ রতন হয়ে। আর এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ
 "'আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
    তাই হেরি তাই সকলখানে'"
এই সহজিয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে বলেন -

##।  ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
         লুটিয়ে যায় ধুলায় রে ....

                            প্রাণের মানুষের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে তিনি 'কাঙালবেশে দ্বারে দ্বারে', বহু দেশ ঘুরে পথপরিভ্রমণ করে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে নিজের অন্তরেই সন্ধান পেয়েছেন যারে। তারেই তিনি নিজের কাছেই পরমাত্মারই অংশ মনে করেন
। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মবিষয়ক লেখায় তাই বলেছেন, 'পরম মানবের বিরাটরূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ আমারই মধ্যে তাঁর প্রকাশ সার্থক হোক।' বাউলদের মতো কবি বলেছেন- 
আমি কোথায় পাব তারে
 আমার মনের মানুষ যে রে।
 হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
 দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।'
                       সর্বমানবাত্মার মুক্তির আনন্দের ভেতরেই রবীন্দ্রনাথের ধর্মদর্শন নিহিত রয়েছে। আবার তিনি বলেন -

## ও যে আমায় ঘরের বাহির করে
 পায়ে পায়ে পায়ে ধরে 
মরি হায় হায় রে .....

'পৃথিবীর লোক পথ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা সঙ্গে কিছুই লইয়া যায় না। তাহারা সুখ-দুঃখ ভুলিতে ভুলিতে চলিয়া যায়। ... ... আর কিছুই থাকে না, কিন্তু প্রেম তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে।' প্রেমকে পাথেয় করেই আমাদের মরমি কবি দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু করেছেন - পরম সুন্দরকে পাওয়ার আশায়। হাফিজ, শেখ সাদী, রুমি, কবীরের দোহা কিংবা লালনের গানে মাশুকের উদ্দেশে আশেকের যে নিরন্তর ছুটে চলার - সাধক কবিদের পথের সন্ধানে ...ঘর ছেড়েছেন....পথের শেষ কোথায় জানতে চেয়েছেন! তেমনি রবীন্দ্রনাথের গান তত্ত্ব এসে আকীর্ণ করেনি, বরং নির্ভার গতি এনে দিয়েছে। আর বলেছে - 

##। ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায়রে
 যায়রে কোন চুলায় রে
 মরি হায় হায় রে .....

কবি সেই পরমপ্রিয়র উদ্দেশে অসীম আশায় উচ্চারণ করেন- '
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে
 আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
 কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি
 তোমারি আশ্বাসে।' 
         গীতাঞ্জলি পর্বে কবি সেই প্রিয়তমের চরণের ধ্বনি শোনেন। এক অপরিসীম গভীর নির্ভরতায় পথিকহীন পথে আবার সেই পরম পথিকের উদ্দেশে বলেন-
 কূজনহীন কাননভূমি
দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,
একেলা কোন্‌ পথিক তুমি
 পথিকহীন পথের পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
 সমুখ দিয়ে স্বপনসম
 যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।"


### ওই যে কোন বাঁকে কি ধন দেখাবে
 কোন খানে কি দায় ঠেকাবে
 কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে
 ভেবেই না কুলায় রে ...
আমার মন ভুলায় রে 
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
 আমার মন ভুলায় রে ....

                   রবীন্দ্রনাথের গানে শুনি, আসা-যাওয়ার পথের ধারে বসে মানুষের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে কবি বিষণ্ণ। পথিকরা বাঁশি ভরে যে সুর সঙ্গে করে আনে, তাই কবির মনপ্রাণ কেড়ে নেয়। তবু পথের ভাবনায় পথকেই ভালোবাসেন কবি। গানটিতে কবি বলেন-

সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী দুই পারের এই কানাকানি

তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি

কিংবা কবি যখন অন্তরের গভীরে ডুব দিয়ে নিজেকে শুধোন 'আসা যাওয়ার মাঝখানে/একলা চেয়ে আছ কাহার পথ-পানে', তখন পথটি রাস্তা না হয়ে অপেক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের গানে পথ, পথের সাথী, পথিক অভিন্ন হয়ে উঠেছে। পথিক কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছবে বলে ছুটে চলে। কিন্তু গন্তব্য কোথায় কিংবা পথের শেষ কোথায়, কে জানে? রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা শুনি- চলার পথে যদি সেই পরম বন্ধু কিংবা পরানসখা সঙ্গে না থাকেন, তবে কী করে গন্তব্যে পৌঁছাবেন। প্রশ্নটির ভেতরে বেদনা ও নির্ভরতার যে অদ্বৈত ভাবনা প্রকাশিত, তা দূর করে দেয় পথচলার কষ্ট। বাংলার আউল-বাউল ও সুফি-সন্তরা পথের অপরিসীম ক্লেশের ভেতর দিয়ে তাদের পরমপ্রিয় বা অরূপ রতনকে পাওয়ার জন্য বিরামহীন ছুটে চলেন। তারাও জানেন না পথের শেষ কোথায়? এই পথের বেদনা ও পথশেষে প্রাপ্তির সংশয় পথিকদের বিষণ্ণ করে, তবুও তাদের পথযাত্রা শেষ হওয়ার নয়। ছুটে চলার খামতি ঘটে না। 'অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার' এই লক্ষ্যে মহা অজানার পথে যাত্রা শুরু করেন।।

রবীন্দ্রনাথের গানে এই পথচলা খুব সহজ নয়। সেই দূরের আনন্দধাম অন্বেষণ করেন কবি ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে। কারণ কবি তো সেই পথ জানেন না। পথ চলতে চলতে সূর্য ডুবে যায়; অন্ধকারে ছেয়ে যায় পৃথিবী। তখন কবি সেই আঁধার পথচলায় বিশ্ববিধাতার কৃপা প্রার্থনা করেন। কবির অতৃপ্ত বাসনা তৃপ্ত করার জন্যই অদেখা আনন্দধামের পথে ছুটে চলা। কবির মনে তীব্র বেদনা ধ্বনিত হয় :তবে কি কোনোদিন পথের শেষ তার জানা হবে না! তবে এই সংশয়ে থেমে থাকেন না কবি। তিনি পরম বিশ্বাসে সংশয় জয় করে পথ চলেন। পথ চলেন আনন্দ, প্রেম, নির্ভরতা এবং চলার প্রসন্নতায়। কবির এই ভাবনাগুলো পাই গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও গানে। কবি সেই পরমপ্রিয়র উদ্দেশে অসীম আশায় উচ্চারণ করেন- 'মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,/ আঁধার করে আসে,/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ/ একা দ্বারের পাশে।/ কাজের দিনে নানা কাজে/ থাকি নানা লোকের মাঝে,/ আজ আমি যে বসে আছি/ তোমারি আশ্বাসে।' গীতাঞ্জলি পর্বে কবি সেই প্রিয়তমের চরণের ধ্বনি শোনেন। এক অপরিসীম গভীর নির্ভরতায় পথিকহীন পথে সেই পরম পথিকের উদ্দেশে বলেন- কূজনহীন কাননভূমি/ দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,/ একেলা কোন্‌ পথিক তুমি/ পথিকহীন পথের পরে।/ হে একা সখা, হে প্রিয়তম,/ রয়েছে খোলা এ ঘর মম,/ সমুখ দিয়ে স্বপনসম/ যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।











        



No comments: