Friday, 30 April 2021

 

গানকে মন ও অনুভূতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯১৯ সালের ১লা মে জন্ম হয়েছিল এক অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের। যার গান আমাদের জীবনের প্রতিটি ভালোলাগা ও মন্দলাগার সাথে শুধু যুক্ত নয় একান্ত সম্পৃক্ত। প্রেম,ভালোবাসা,স্নেহ,ভক্তি,বন্ধুত্ব,উন্মাদনা সবরকম অনুভূতির প্রকাশই আমরা তাঁর গাওয়া গানগুলির মধ্যে পেয়ে থাকি। তাঁর গান আপামর দেশবাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু দেশ বললে ভুল হবে তিনি সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাঁর নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। যে প্রতিভার কোনো সীমা পরিসীমা গভীরতা আকুলতা ব্যাকুলতা নিয়ে কথা হবে না। কাওয়ালি ,গজল,ক্লাসিকাল,সেমিক্লাসিক্যাল,আধুনিক,রবীন্দ্র সঙ্গীত,এমনকি রক এন্ড রোল সবরকম গানেই তিনি আমাদের মন জয় করেছেন। শুধু বাংলায় নয় তিনি হিন্দি মারাঠি ভোজপুরি, পাঞ্জাবি,ওড়িয়া,সিন্ধি,নেপালি,আসামী,কোঙ্কনি,গুজরাটি ,মাগধী ,মালায়ালম ,ইত্যাদি ভাষায় ও গান গেয়েছেন।

তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পরিবারেইর এক জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন।সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে। এনার সাহচর্যে মান্না দে বড়ো হয়ে ওঠেন, সঙ্গীতের প্রথম হাতে খড়ি ও এনার কাছেই হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীন পর পর তিন বার তিনি ইন্টার কলেজ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪২ সালে মান্না দে তার কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এর সাথে মুম্বই চলে আসেন।এখান থেকেই তার কর্ম জীবন শুরু হয়। কর্ম জীবন শুরু হলেও সঙ্গীত শিক্ষা চলতে থাকে উস্তাদ আমান আলী খান এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খান এর কাছে।
পারিবারিক জীবন তিনি কেরলর মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা রয়েছে: শুরোমা (জন্মঃ ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮ সালে) জন্মগ্রহণ করে। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বাস করেছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন।

১৯৪৩ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র দে এর নির্দেশনায় ‘তাম্মানা’ ছবিতে তিনি প্রথম গান করেন। তাঁর গান সেই সময় এতো জনপ্রিয় হয় যে তিনি ১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের নির্দেশনায় ‘মশাল’ ছবিতে একক গান গাওয়ার সুযোগ পান। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক বাংলা ও হিন্দি এমনকি মারাঠি ছবিতেও তিনি গান গাওয়া শুরু করেন,শুধু তাই নয় এর সাথে সাথে তিনি সঙ্গীত পরিচালনার ও কাজ করেন। তার গাওয়া এবং নির্দেশনায় সবকটি গান বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি ৩বার জাতীয় পুরস্কার পান এছাড়া তিনি অজস্র সম্মান পেয়েছেন তার কাজের জন্য। 

তাঁর গান আমাদের সবরকম অনুভূতির সাথে জড়িত। আজকের জেনারেশন ও যেকোনো রকম আবেগকে বোঝাতে তার গান গেয়ে থাকে। যদি তার বাংলা গান গুলোকে নিয়ে আমরা একটু গভীরে যাই তাহলে দেখবো তার গাওয়া গান আমাদের অনুভূতিগুলোকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আসুন না এই রকম কয়েকটি গান নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

মান্না দের নাম মনে পড়লেই আমার মনে কিন্তু প্রথম যে গান টি আসে তা হলো” কফি হাউস এর সেই আড্ডা টা আজ আর নেই। আজ আর নেই”আড্ডা নামক বস্তুটি বাঙালীর নেই। বড়ো প্রিয় সবকিছু বাঙালিরা হারিয়ে বসতে চলেছে।

প্রিয় গানগুলি কয়টি -

কফি হাউসের সেই আড্ডা

ছোট হোক বড়ো হোক কিংবা বুড়ো হোক আড্ডা না হলে বাঙালী হয়ে ওঠা যায় না। কফি হাউস গানটি সেই আড্ডা প্রিয় বাঙালীর কথাই বলে। কফি হাউস ইন্টেলেক্চুয়াল রোমান্টিক বাঙালীর পীঠস্থান বললে বোধহয় ভুল কিছু বলা হবে না। চারমিনার ঠোঁঠে ,আর গলায় রাজনীতি,বিষ্ণু দে,যামিনী রায়,রবীন্দ্র নাথ ,এই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে এখানে অনেকেই। কত কবি ,লেখক,প্রেমিক রসদ খুঁজে পেয়ে এসেছে এই কফি হাউস এর আড্ডায়। গান টিতে এরকমই প্রেম বিরহ ,হতাশা প্রাপ্তি, সখ্যতা এইসব কিছু মিলিয়ে কোথায় যেন আমরা বার বার নিজেদের এই গানটিতে খুঁজে পাই।


সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল 

ফুটবল প্রীতি বরাবরই বাঙালীর মনে ঘর করে এসেছে। মোহন বাগান আর ইস্ট বেঙ্গল কে ভালো খেলে, এই তর্কের বোধহয় কোনো শেষ নেই। ফুটবুল প্রিয় বাঙালীর জন্যই বোধহয় মান্না দে গেয়েছিলেন “সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল ” ।

বাঙালির ফুটবল প্রীতি যত দিন থাকবে ততদিন এই গানটি ও আমাদের মনে থেকে যাবে।

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

“যদি প্রেম দিলে না প্রাণে “এই প্রেম বস্তুটি ছাড়া বঙ্গ সন্তান অসম্পূর্ণ। প্রেমের কথা আসলেই আমার মনে হয় সকলের মনে মান্না দে এর গাওয়া” হয়তো তোমারি জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য”এই গানটি মনে পরে। কত প্রেমিক যে তার প্রেমিকাকে এই গানটি গেয়ে শুনিয়েছে তা হয়তো গুনে শেষ করা যাবেনা। তবে তার ফলাফল যে সবসময় মধুর হয়েছে এমনটি নয়। কিন্তু এমন রোমান্টিক বাংলা গান আমার মনে হয় খুব কমই আছে।


সে আমার ছোট বোন বড়ো আদরের ছোট বোন

“সে আমার ছোট বোন বড়ো আদরের ছোট বোন”এই গানটি আজ ও আমাদের চোখে জল এনে দেয়। স্নেহ,মায়া মমতা ভালোবাসার এক অসামান্য মেলবন্ধন এই গানটি। ভাই এবং বোনের এমন ভালোবাসার গল্প এমন মধুর ভাবে কোথায় শুনেছি আমরা বলতে পারেন? কত শিল্পীর জীবন হয়তো এভাবেই থেমে গিয়েছে। গানটির পরিণতি করুন হলেও গানটি আজ আমাদের মনে দাগ কাটে।

আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি

কোনো মন্দিরে যখন আমরা যাই তখন আমরা একটি গান প্রায় বাজতে শুনে থাকি। দূর্গা পুজো বা কালী পুজোর সময় প্যান্ডেলে এই গানটি প্রায়ই শোনা যায়।মনে পড়ছে কি গান টি?”আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি ”

আমাদের মনের শ্রদ্ধা ভক্তি যেন মান্না দে এর এই গানটির মধ্যে আমরা অনুভব করতে পারি। তাই কখনো কোনো এই গানটিও আমাদের চোখে জল এনে দেয়।

মান্না দে অসামান্য একজন সুরকার গীতিকার এবং গায়ক ছিলেন। তার সব গানের কথা হয়তো বলা হলো না। হয়তো বলে শেষ ও করা যাবে না কারণ এতটাই বিশাল তার গানের পরিধি। তবুও এই গানগুলি যেন আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের সব অনুভূতি আর আবেগের বহিঃপ্রকাশ।


সাফল্য এবং খ্যাতি 

মান্না দে পদ্মশ্রী এবং পদ্মবিভূষণ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেছেন।

১৯৬৯ হিন্দী চলচ্চিত্র মেরে হুজুর ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৬৯ জাতীয় ছায়াছবি পূরস্কার Renaissance Sanskritik Parishadএর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ

১৯৭১ বাংলা চলচ্চিত্র নিশি পদ্মে ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৭১ ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়।

১৯৮৫ মধ্য প্রদেশ সরকার লতা মঙ্গেশকার পদক প্রদান করে।

১৯৮৮ রেনেঁসা সাংস্কৃতিক পরিষদ, ঢাকা থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে।

১৯৯০ মিঠুন ফ্যানস এসোসিয়েশনের তরফ থেকে শ্যামল মিত্র পুরস্কার।

১৯৯১ শ্রী ক্ষেত্র কলা প্রকাশিকা, পুরী থেকে সঙ্গীত স্বর্ণচূড় পুরস্কার প্রদান।

১৯৯৩ পি.সি চন্দ্র গ্রুপ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে পি.সি. চন্দ্র পুরস্কার।

১৯৯৯ কমলা দেবী গ্রুপ কমলা দেবী রায় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০১ ‍আনন্দবাজার গ্রুপ আনন্দলোক আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।

২০০২ বিশেষ জুরী বোর্ড কর্তৃক সঙ্গীতে অবদানের জন্য সারল্য যশোদাস পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৩ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আলাউদ্দিন খান পুরস্কারে ভূষিত।

২০০৪ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মাননা প্রদান।

২০০৪ কেরালা সরকার গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৫ ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ খেতাব প্রদান।

২০০৫ মহারাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক আজীবনকাল সম্মান প্রদান।

২০০৭ ওড়িষ্যা সরকার “প্রথম অক্ষয়” পুরস্কার প্রদান।

২০০৮ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মান প্রদান।

২০১১- ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মান প্রদান ২০১১- পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ প্রদান। ২০১২- তার কৃতিত্বের জন্য ২৪ ঘণ্টা টিভি চ্যানেল আজীবন অনন্যা সম্মান প্রদান করে।

২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। মান্নাদে'র জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্নাদে সঙ্গীত একাডেমী মান্নাদে’র সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষন করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা সঙ্গীত ভবনে মান্নাদে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

১৯১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর এই অসামান্য প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয়।। অমরলোকে যাত্রা করেন। রেখে যান তাঁর অসামান্য গানগুলি। এখন প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে সুরেলা হয়ে ওঠে নির্জনে দুজনে  বাড়িতে রাস্তায় সর্বত্র‌ই। 

সুস্থ থাকার বা প্রকৃত মনোভাব কে সুস্থ রাখার উপায় যদি জনপ্রিয় গান শোনা হয় । তাহলে মান্নাদের অনেক বেশি জনপ্রিয় গায়ক সঙ্গীত মুখর শ্রোতা ও বিশ্ববাসীর কাছে।  বিশ্ববাসীর কাছে তিনি যথার্থ গায়ক হয়ে উঠতে পেরেছেন।

আজ শুভ জন্মদিন ওনার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik sabder methopath

Vol - 359. Dt -01.05.2021

১৫ বৈশাখ,১৪২৮. শনিবার

=================================





No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ।‌ একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। Dt -26.11.2024. Vol -1059. Tuesday. The blogger post in literary e magazine.

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়   (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ — ২৯ মে ১৯৭৭)  একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ.  মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্...