Sunday, 25 April 2021

কাজী আবদুল ওদুদ     

জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন। তিনি পেশায় ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। মাতা খোদেজা খাতুন। তিনি বলেন -" পিতৃকুল ও মাতৃকুল দুই-ই মধ্যবিত্ত। মাতৃকুল কিছু সঙ্গতিসম্পন্ন ।পূর্বপুরুষেরা অসাধারণ কেউ ছিলেন না। প্রায় নিরুদ্বেগে গ্রাম্য জীবনযাপন করেছেন। আমার পিতামহ লেখাপড়া জানতেন না। ভদ্রলোকের ছেলে তাই নিজের হাতে চাষ করতেন না। তবে জীবিকা নির্বাহ করতেন কৃষি সাহায্যেই। চিন্তাভাবনা ধার ধারতেন না। ঋণ করে ইলিশ মাছ খেতে তার বাঁধতো না। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরিশ্রমের ফাঁকে নিরুদ্বেগে নিদ্রা উপভোগ করতেন। আমার পিতামহী ছিলেন অসাধারণ পার্সি জানা মৌলবির মেয়ে, কিন্তু ধর্মভীরু, বুদ্ধিমতী, কর্মকুশলা ও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্না তার চাইতে অনেক বেশি ।”



কাজী আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই-এ এবং ১৯১৭ সালে বি এ পাস করেন। সেই সময় রূপগঞ্জ থানার ছোট দারোগার শ্বশুর মশায়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন ওদুদ সাহেব। সেখানে একদিন তিনি শুনতে পেলেন, যার বাড়িতে তিনি আছেন, সেই ভদ্রলোক এবং তার বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি ‘থেকে গান গাইছেন। গানের কথা আর সুর শুনে ওদুদ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কিনে এনে গান গাওয়ার অভ্যাস শুরু করলেন ওদুদ। গ্রাহক হলেন সবুজপত্র পত্রিকার ।এই সময় কালে সবুজপত্র প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘বিবেচনা ও অবিবেচনা’ প্রবন্ধটি ওদুদ সাহেবের রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর তিনি থাকতে শুরু করলেন সরকারি বেকার হোস্টেলে। সেখানে তখন থাকতেন শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের বড় ছেলে মোহাম্মদ আফজাল উল হক। পরবর্তী সময়ে হক সাহেব মুসলিম পাবলিশিং হাউজ এবং মুসলিম ভারত পত্রিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রকাশ করেছিলেন।হোস্টেলে থাকার সময় হাতে লেখা পত্রিকার ভেতর দিয়ে ওদুদ সাহেবের লেখালেখির হাতে খড়ি। ‘শ্রী দীক্ষিত’ ছদ্মনামে ওই পত্রিকায় ওদুদ সাহেব লিখতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ওদুদ সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু , দিলীপ কুমার রায়, রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখকে। এই সময় বেকার হোস্টেলেই তার সঙ্গে আলাপ হয় মুজাফফর আহমেদের। সেই আলাপের প্রসঙ্গ নিয়ে মুজাফফর আহমেদ পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকায় লিখছেন: “কাজী আবদুল ওদুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯১৩ সালে। তিনি চৌকস ছাত্র ছিলেন কিন্তু সাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল (দেশ- ১২ আষাঢ়, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)।
১৯২৭ ওদুদ সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তার পাঠ্যসূচির অন্যতম বিষয় ছিল সংস্কৃত। স্কুলের বাইরে শিখেছিলেন আরবি-ফারসি। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন ওদুদ।
১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষকের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রীডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করে কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯১৬ সালে তিনি তার চাচার বড় মেয়ে জামিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। জামিলা খাতুন ১৯৫৪ সালে মারা যান।
ভারত বর্ষ’ পত্রিকায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ উপন্যাসের উপরের আলোচনা লেখেন কাজী আবদুল ওদুদ। সম্ভবত ছাপার অক্ষরে সেটি ছিল তার প্রথম লেখা।

কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ মীর পরিবার (১৯১৮) এবং উপন্যাস নদীবক্ষে (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এমএ পাস করার পর তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র শিখার প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় প্রয়াসপ্রযত্ন ছিল। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।

প্রবন্ধ 
শাশ্বত বঙ্গ(১৯৫১)
সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪)
রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪)
হিন্দু-মুসলমান বিরোধ (১৯৩৬)
নব পর্যায় (২খণ্ড)

অন্যান্য বই 
মির পরিবার (গল্প), ১৯১৮
পথ ও বিপথ (নাটক), ১৩৪৬
আজাদ (উপন্যাস), ১৯৪৮
নদীবক্ষে (উপন্যাস), ১৯৫১


তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত জনপ্রিয় বাংলা অভিধান – ব্যবহারিক শব্দকোষ

কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যাল‌য়ের অধ্যাপক হাবিব আর রহমানের সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাজী আবদুল ওদুদের ‘নির্বাচিত রচনা’ প্রথম খণ্ড। ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ৬ খণ্ডে ‘কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী’ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এ বাংলায় সে রকম কিছু ছিল না। একাধারে সাহিত্যবোদ্ধা এবং চিন্তানায়ক ওদুদের নির্বাচিত রচনার সুবৃহৎ এই সংকলন আশা করা যায় এ বঙ্গে সে অভাব কিছুটা দূর করবে। আমাদের এই বিস্মৃতি তো আগ্রহের অভাব থেকেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এ বাংলায় মুসলমান সমাজেও ওদুদকে নিয়ে আগ্রহ প্রায় নেই। অথচ ওদুদের মুসলিম সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টার ঘোর সমালোচক ‘মোস্তাফা চরিত’ রচয়িতা মোহম্মদ আকরাম খাঁকে নিয়ে আগ্রহের অভাব দেখি না।

মুসলমান সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা আর হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় সাধনা করতে গিয়ে ওদুদকে সারাটা জীবন সইতে হয়েছে লাঞ্ছনা— তাঁর নিজের সমাজ থেকে তো বটেই বাইরে থেকেও। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চিনেছিলেন তাঁকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিভীষিকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ওদুদকে দু’কূলের সেতু হিসেবে দেখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে কবির আমন্ত্রণে ওদুদ বিশ্বভারতীতে ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ বিষয়ে তিনটি বক্তৃতা দেন। সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতামালা পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয় বিশ্বভারতী থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সমেত। আজ সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস আর অসম্প্রীতি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, বাংলাও বাদ নেই। এই সংকটের সময়ে তাঁর লেখাগুলো অত্যম্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
" আমার বুদ্ধিমত্তা তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি যে শান্তশিষ্ট এটি খুব পছন্দ করতেন মনে হয় না। আমি যদি আরও অনেক বেশি উপার্জন করতে পারতাম, আত্মীয়-স্বজনকে দিতে পারতাম- তবে তিনি খুশি হতেন। আমার মা ছিলেন অতিশয় দৃঢ় চরিত্রের ও প্রপর বুদ্ধিসম্পন্না, কিন্তু কর্তৃত্ব ও অবিলাসিনী। তার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতা দেখে আমার ঠাকুরমা তাকে সংসারের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন তার বিবাহের অল্পকাল পরেই। আমৃত্যু শাশুড়ি বৌ ভাব ছিল।” (আমার জীবন কথা- কাজী আবদুল ওদুদ )

অন্নদাশংকর লিখছেন, “কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবন দর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহনপন্থী, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থী, অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল। কোনও চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না।”
তিনি চেয়েছিলেন, সামাজিক আদান-প্রদান, বিবাহ ইত্যাদি সব জায়গায় সহজ হবে ধর্ম এবং আইন। এই প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, যেটি সেই সময়ের পক্ষের সংগত এবং যে আইন সকলের পক্ষে মান্য তাই প্রচলিত থাকবে। কাজী আবদুল ওদুদের এই উদার এবং গভীর চিন্তাশীল ভাবনা কেবলমাত্র বিস্ময়ের বিষয় তাই নয়, আজকের দিনেও তা গভীরভাবে ভাবনার দাবি রাখে ।

কাজী আবদুল ওদুদ আচারে নিষ্ঠাবান এবং পোশাকে মুসলমান ছিলেন। অথচ কোনোরকম ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বা অপর ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র বাতরাগ তাঁর চিন্তার জগতে মুহূর্তের জন্যও ঠাঁই পায়নি।‌
মারা গেছেন: ১৯ মে, ১৯৭০, কলকাতা।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -354 /1. Dt -26.04.2021
১২ বৈশাখ,১৪২৮. সোমবার
===============[===============


No comments: