গুরুসদয় দত্ত
বাংলাদেশে শ্রীহট্ট জেলার , এখন সিলেট জেলার জাকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী গ্রামে কুশিয়ারা নদীরতীরে ১৮৮২ সালের ১০ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন. পিতা রামকৃষ্ণ দত্ত ও মাতা আনন্দময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি. পাশে প্রবহমান কুশিয়ারা নদী জমিদার পরিবারে সন্তান হলেও শৈশব ও কৈশোর কেটেছে অতি স্বাভাবিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে .বিশেষ করে নদীর তীরে গোচারণভূমি তে ঘুরে বেড়ানো নদীবক্ষে নৌকা নিয়ে এদিক-ওদিক দুরন্তপনা। ছোটদের দলের নেতৃত্ব দেওয়া। ঘোড়ার পিঠে চড়া । সবই তাঁর দুঃসাহসিক পরিচয়। শৈশব থেকে যৌবন মায়ের সান্নিধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সহ নানান বিষয়ে তাঁর মনোযোগ ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে ১৮৯৮ সালে কলকাতা থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন . ১৯০১ সালের এফ এ পরীক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এসময় কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালে তিনি কংগ্রেস ভলেন্টিয়ার ইনচার্জ পদে আসীন হন । পরে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর আর্থিক সহযোগিতায় ১৯০৩ সালে বিলেত যান এবং একই সালে আই.সি.এস ও ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন. উভয় পরীক্ষার ১৯০৫ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগ উত্তীর্ণ হন। বিশেষভাবে আই.সি.এস পরীক্ষায় ঘোড়ায় চড়া বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বর পান। তিনি শেষদিকে দেশে ফিরে আসেন এবং দেশে ফিরেই বিহারের আঢ় জেলার মহকুমা শাসক পদে নিযুক্ত হন । তৎকালীন সময়ে বিলেতে যাওয়ার ফলে সমাজপতিদের কুনজরে পড়েন এবং প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯০৬ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রখ্যাত আইসিএস অফিসার বজেন্দ্রনাথ দত্তের চতুর্থ কন্যা সরোজনলিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী না হলেও ঘোড়ায় চড়া, টেবিল টেনিস, বেহালা বাজানো সংগীতে পারদর্শী ছিলেন এই মহিলা । স্বদেশী গান গাইতে খুব ভালোবাসতেন। ১৯০৯ সালে তাদের একমাত্র সন্তান বীরেন্দ্র সদয়ের জন্ম হয় ।
১৯১১ সালে বিচার বিভাগের দায়িত্বে ফিরে আসেন এই বাংলায়. ১৯১২ সালে থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার একাধিক জেলা - খুলনা- যশোহর - ফরিদপুর -কুমিল্লা- ঢাকা ও বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে বিচার বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন. ১৯১৭ সালে বীরভূম জেলা শাসক পদে নিযুক্ত হন . গঠনমূলক কাজে সামগ্রিকভাবে মনোনিবেশ করেন। জেলার উন্নয়নে আগ্রহী তিনি সর্বত্রই সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। ১৯১৯ সালে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তিনি জাপানে যান, সেখানে উন্নয়নমূলক কাজ কর্ম পর্যবেক্ষণ করে অনুপ্রাণিত হন. ১৯২০ সালে আবার জাপান থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯২১ সালে পুনরায় বাঁকুড়া জেলার জেলাশাসক পদে নিযুক্ত হন . ১৯২২ সালে সমবায় কৃষি চাষ পদ্ধতির প্রচলন করেন তিনি। ১৯২৩ সালে শাসন বিভাগ থেকে বদলি হয়ে কৃষি ও শিল্প বিভাগে কর্মভার গ্রহণ করেন। ১১৯২৫ সালের উনিশে জানুয়ারি প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে মানসিক আচ্ছন্ন হন। দুঃস্থ মহিলাদের কল্যাণার্থেই স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে প্রতিষ্ঠা করেন "নারী মঙ্গল সমিতি". ১৯২৬ সালে আবার জেলাশাসক হয়ে ফিরে আসেন হাওড়া জেলায়. গ্রামোন্নয়ন প্রেক্ষাপটে গ্রামের উন্নতি কল্পে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন" খামারের ডাক". গঠন করেন হাওড়া জেলার কৃষি ও প্রকৃতি- পুকুর- খাল সংস্কারের মধ্য দিয়ে ম্যালেরিয়া প্রকট নিবারণ সহ বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে । ১৯২৮ সালে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বামনগাছিয়া তে বিনা প্ররোচনায় ইংরেজ সরকারের মিলিটারি পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা করেন ইংরেজবিরোধী হন। ঐতিহাসিক এই রায়দান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যার জন্য তিনি সরকারের নজরে পড়ে। নিয়ম ছিল আইসিএস কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায় না তাই শাস্তিস্বরুপ হাওড়া থেকে বদলি করা হলো। ১৯২৯ সালে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন।পরে ময়মনসিংহ জেলার জেলাশাসকের কার্যভার গ্রহণ করেন । ওই বছরই চতুর্থবার লন্ডন যান সেখানে লোকসংস্কৃতি ও লোকগীতি রক্ষা সমিতির উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে লোক সংস্কৃতির উপর ভালোবাসা' প্রকট হয় জেলাশাসকের দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি গঠনমূলক কাজে মনোনিবেশ করতে তিনি আগ্রহী হয়ে বীরভূম জেলায় ফিরে আসেন। গঠন করেন মিউজিক্যাল সোসাইটি। এরপরই আবিষ্কার এর অন্বেষণে খুঁজে বেড়ান বাংলার লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া উপাদান।। ১৯৩০ সালে বীরভূমের লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি আবিষ্কার করেন তিনি এবং ওই বছরই তিনি বহু গান রচনা করেছিলেন । ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গীয় পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি। লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির পুনরুদ্ধার একমাত্র জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করেন । ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি হারিয়ে যাও লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান প্রাচীন ধারা ব্রতচারী প্রবর্তন করেন। । ১৯৩৩ সালে কেন্দ্রীয় বিধানসভার সদস্য থাকাকালীন দিল্লিতে সর্বভারতীয় সঙ্গীত সমিতি গঠন। ১৯৩৪ সালে সম্পদ রক্ষা সমিতি গঠিত হয়। যার পরবর্তী নাম বাংলার ব্রতচারী সমিতি। ১৯৩৫ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক লোকসংস্কৃতি উৎসবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
ব্রতচারী পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি বহুগ্রন্থের রচয়িতা ও।
রচনা কর্ম :
ভজার বাঁশি -১৯২২
গোড়ায় গলদ -১৯২৬
গ্রামের কাজের ক খ গ - ১৯২৮
সরোজনলিনী -১৯২৮
পল্লী সংস্কার ও সংগঠন -১৯২৮
পাগলামির পুঁথি -১৯২৮
গানের সাজি ১৯৩১
পটুয়া ১৯৩২
চাঁদের বুড়ি ১৯৩৩
ব্রতচারী মর্মকথা ১৯৩৭
ব্রতচারী পরিচয় -১৯৪১
শ্রীহট্টের লোকসংগীত ১৯৬৬
বাংলার বীর যোদ্ধা রায়বেঁশে ১৯৯৪
English Books :
1) Agricultural organisation and rural reconstitution in Bengal 1919
2)A Women of India biography of Saroj Nalini Dutt
3)Folk song and folk dance in Indian school
4)The Indian folk dance and folk song movement
5) Bratachari Synopsis
6) Bratachari its aims and meanings
7) The folk dances of Bengal
8) folk Art and crafts of Bengal
9) Art of kantha (album).
মূলত তিনি ব্রতচারী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন. কেউ কেউ তাকে "প্রবর্তকজী" নামেও অভিবাদন করেছেন। বিশেষ করে ব্রতচারীদের ভঙ্গিতে, মাতৃভাষাায় প্রীতি, শাস্ত্রজ্ঞান ও সত্যনিষ্ঠা সংযমের প্রভাবে অধ্যাবসায় এবং আত্মনির্ভরতা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছেন সে দিক থেকে তিনি এই ধারার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ তৎকালীন সময়ের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিগন গুরুসদয় দত্ত কে ব্রতচারী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। বাংলার শক্তি নামে তিনি একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩৪ সালে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করলেও বিশেষ করে শিশুদের উপযোগী ছড়া সংকলন খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল. লোকসংস্কৃতি ও শিল্প সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাাঁর সংগৃহীত লোকসংস্কৃতির অনেক নিদর্শন কলকাতার উপকণ্ঠে ঠাকুরপুকুরে অবস্থিত জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
কবিতা।
তরুণ
বাংলা'মার দুর্নিবার আমরা তরুণ দল
শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন সংকটে অটল।।
গঙ্গা রাঢ় পাল রাজার বীর্য্য গরিমা
চন্ডীদাস জয়দেবের ছন্দ মহিমা
ঢেউ তাদের দেয় মোদের চিত্তে নব বল ।।
নিঃস্বতার দৈন্যভাব করব উৎসাদন
অজ্ঞতার অন্ধকার করব নিবাসন
এযুগের উন্মেষের জ্বালব দ্বীপ উজল।।
সংযমের পৌরুষের পালব প্রেরণা
শ্রমযোগের উদযোগের সাধব সাধনা
বাংলা'মার লাঞ্ছনায় মুছবো আঁখিজল
আমরা তরুণ দল ।।
কবিতা 2
মোদের পণ
মোরা ছুটব মোরা খেলব
বসে কুঁড়ে হয়ে থাকবো না ।
সাথে ফাটাবে। মাথা ভাঙবে
তবু খেলা ছেড়ে উঠলো না ।
মোরা হাসবো ভয় নাশব
বাধা বিপদেতে টলব না ।
প্রাণ খুলবো মান ভুলব
দীন দুঃখীদের ঠেলব না ।
গায়ে খাটবো। বন কাটবো
মাথা গুঁজে বসে থাকব না।
মাটি খুঁড়ব চাষ জুড়ব
কভু শ্রমে হেলা করবো না।
ভাল বাসব। দুঃখ নাশব
কভু ছোট-বড় বাছব না।
পেয়ে লক্ষ হয়ে যক্ষ
তবু গরীবেরে ভুলবো না।
১৯৪৮ সালের ২৫ শে জুন কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -368. Dt -10.5.2021
২৬ বৈশাখ,১৪২৮. সোমবার
================{{=={{{======{{{====
No comments:
Post a Comment