Friday, 14 May 2021

পুরাতন ভৃত্য ও রবীন্দ্রনাথ

"পুরাতন ভৃত্য "  ও রবীন্দ্রনাথ।


   

"ভূতের মতন চেহারা তেমন নির্বোধ অতি ঘোর
যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত শুনেও শোনে না কানে -
যত পায় বেত না পায় বেতন তবু না চেতন মানে।"
      রবীন্দ্র সৃষ্টি সমীক্ষার মর্মমূলে নিভৃত মানবসত্ত্বা আজও নীরবে কাঁদে। বিশেষত মানবদরদী,
মানবতার পূজারী এই মানুষটি আজীবন মানুষের জয়গান গেয়েছেন সৃষ্টির নানা সূত্র ধরে। তাঁর সমগ্র সৃষ্টিতে মানুষ এসেছে নানান পথ ধরে। ব্যক্তিজীবন যে সব মানুষদের দ্বারা প্রভাবিত, তাদের মধ্যে চাকর বা ভৃত্যদের অবদান ও কম নয়। মনে হয় তাদের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন চিত্রা কাব্যগ্রন্থের সেই বিখ্যাত কবিতা পুরাতন ভৃত্য। 
        আলোচ্য কবিতার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয়না তিনি কিভাবে তাদের দেখেছিলেন জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে - বিশেষ করে বাল্যকাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত , তাদের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন কবি ও জমিদার রবীন্দ্রনাথ। জীবনের কোন কোন বৃত্তে তাদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল -তা একবার দেখে নেওয়া যাক। 
  ** শ্যাম চাকর।
      "আমাদের এক চাকর ছিল তার নাম শ্যাম। শ্যাম বর্ণ দোহারা বালক মাথায় লম্বা চুল খুলনা জেলায় তাহার বাড়ি সে আমাকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসাইয়া আমার চারদিকে খড়ি দিয়া গন্ডী কাটিয়া দিত‌। গম্ভীর মুখ করিয়া তর্জনী তুলিয়া বলিয়া যাইতো গন্ডির বাইরে গেলেই বিষম বিপদ। বিপদটা আধিভৌতিক কি আধিদৈবিক তাহার স্পষ্ট করিয়া বুঝতাম না কিন্তু মনে বড় একটা আশঙ্কা হইত গণ্ডি পার হইয়া সীতার কি সর্বনাশ হইয়াছিল তাহা রামায়ণের পড়িয়াছিলাম এইজন্য গণ্ডিটাকে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মত উড়াইয়া দিতে পারতাম না। " জীবনস্মৃতি গ্রন্থ ঘর ও বাহির অংশে তিনি এই চাকরের কথা শুনিয়েছেন। যার অধীনে থাকে  হয়েছিল চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি অবস্থায়। "নিজেদের কর্তব্য কে সরল করিয়া লইবার জন্য তাহারা আমাদের নড়াচড়া একপ্রকার বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। সেদিকে বন্ধন যতই কঠিন থাক অনাদর একটা মস্ত স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতায় আমাদের মন মুক্ত ছিল খাওয়ানো পড়ানো সাজানো-গোছানো দ্বারা আমাদের চিত্তকে চারিদিক হইতে একেবারে ঠাসিয়া ধরা হয় নাই।" অর্থাৎ বাল্যকালের সেই সব স্মৃতি তুলে ধরেছেন নানান প্রসঙ্গে। আমরা এদিক থেকে শ্যামচাকরের  পরিচয় খুঁজে পাই।

     *** উমাচরণ।
             চাকরদের মধ্যে তাাঁর খাস চাকর ছিলেন উমাচরণ। বাড়ি ছিল ওপার বাংলায় লোকটা খুব বুদ্ধিমান ও কর্মঠ। রবীন্দ্রনাথ তাাঁকে খুব ভালোবাসতেন।এমনকি তার কাজকর্মেও তিন যেন অভিভাবক যেমন সুদর্শন তেমনি মিশুকে প্রকৃতির ছিলেন। এমন চাকরের দু-একটিি কাজের উদাহরণ - 
      কমলাপুরের তদারক নবিশ ছিলেন দ্বারি  বিশ্বাস। তিনি যখন জমিদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তখন সেই অঞ্চলের উৎকৃষ্ট ফলফলারি বা খাবার আনতেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ এতে অনুযোগ প্রকাশ করেন কিন্তু তাতেও তিনি অতিশয় বাবু মহাশয়ের জন্য পাচরা মর্তমান কলা ও দুটি অতিকায় কাঁঠাল এনেছিলেন সাহিত্য সাধনায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথ সারা দিন ও রাত্রির মধ্যে একটা সময় গ্রামের পথে বা মাঠে বেড়াতে যেতেন দু-একটি খাওয়ার পরেই একতলার কুঠিবাড়িতে সংরক্ষিত রেখে ছিলেন উমাচরণ। পরে উমাচরণ কে দিয়ে তিনি সকলের জন্য বেশ ফুরফুরে আর ঘন দুধ এনে ভুরিভোজ এর ব্যবস্থা করে দেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ মানুষ রবীন্দ্রনাথের পরিণত হয়েছিলেন এরকম বেশ কিছু সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে। এরকম কাজটির সম্পূর্ণ উৎসাহ যুগিয়েছেন উমাচরণ।

***বিপিন.
   রবীন্দ্রনাথের আরেক পুরাতন ভৃত্য ছিলেন বিপিন। জবরদস্ত চাকর প্রকৃতির। 
তাকে দেখে সবাই ভয় পেত শিলাইদহ সদর কাছারির খাজাঞ্চি বলতেন -" বিপিন ঠগা বগা লেখাপড়া যতোটুকু জানুক আর নাই জানুক সে তদবিরের জোরে সেরেস্তায় বসে একজন পাকা আমলার কাজও করতে পারতো।"
    ভয়ানক হিসেবি অতিরিক্ত সাবধানী এবং খুব বিশ্বস্ত জমিদার বাবুদের ফাইফরমাশ যদি কোন আমলা বা বরকন্দাজ ঠিকঠাক পালন না করলে তার রক্ষে থাকত না। তার বোল চাল কায়দা কানুন দেখে সাধারণের তাক লেগে যেত ।বেশি চেঁচামেচি পছন্দ করত । কুঠিবাড়িতে এলেই হইচই হত এবং সবাই মনে করত বিপিন এসেছে বিপিন রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় তাই তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে না।

"প্রসন্ন মুখ নাই কোন দুখ অতি অকাতর চিত্ত
ছাড়ালে না ছাড়ে কি করিব তারে মোর পুরাতন ভৃত্য।"

***প্রসন্ন.
শিলাইদহের প্রাচীন দের কাছে তিনি আরেক পুরানো ভুতের কথা শুনেছেন যার সঙ্গে এলে খুবই বিপদজনক ঘটনা ঘটতে পারে তিনি হলেন প্রসন্ন ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় তার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন এক জ্যোৎস্না রাতে ভাইপো বলেন্দ্রনাথ কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী অনেক দূরে চলে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন প্রকাণ্ড ঝড়ের মধ্যে জল কমতে থাকায় ঠিক করতে না পেরে ওরা অন্য পথে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল এই প্রশ্ন ও তার সঙ্গী দুজনে গিয়ে উদ্ধার করে এনেছিল প্রসন্ন সে দিক থেকে কবি পত্নী নালিনি দেবীর পছন্দমত চাকর ছিল সে নাকি তার ছোটমার মুখ দেখলেই তার অভিপ্রায় ভুলতে পারত শিলাইদহের সকলেরই প্রিয় পাত্র ছিল এই প্রসন্ন।

"বলি তারে পাজি বেরো তুই আজই দূর করে দিনু তোরে।
ধীরে চলে যায়। ভাবি গেল দায়। বড়দিনে উঠে দেখি
হুঁকাটি বাড়ায় রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি।"

***ভোলানাথ.
  জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের এক পুরানো ভৃত্য ছিলেন ভোলানাথ। চেহারাখানা বেশ সুঠাম। মুখে লম্বা গোঁফ। ঘুম জোড়ার পারিপাট্য বেশ রকমের তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইংল্যান্ড আমেরিকা জাপান ইত্যাদি দেশ ঘুরে এসে সাড়ম্বরে সেইসব গল্প সবাইকে শোনাতন। জার্মানির কোন সাহেব রবিবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল, ইউরোপের বড় বড় রাজধানীতে কোন কোন মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় করে ছিল। বড় বড় সভা সমিতিতে যাওয়াার সময় কিভাবে তিনি যেতেন সেই সব গল্প অসাধারণ গর্বের সঙ্গেই সবাইকে বলতেন আর খুশি হতেন। রবীন্দ্রনাথ তার জীবন সঙ্গী হিসেবে ভোলানাথ কে বেশ পছন্দ করতেন।


 "দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে দেখে জ্বলে যায় পিত্ত
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার বড়ো পুরাতন ভৃত্য।"

*** ঝগড়া বেহারা।
    জোড়াসাঁকোোর বাড়িতে আরেক চাকরির পরিচয় পাই, নাম তার  ঝগড়ূ। তার দায়িত্ব্ব ছিল রবীন্দ্রনাথ যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরদোর পরিষ্কার করা। যখন তিনি আসতেন তার আগে আগে আর না হলে বসে বসে মাইনে নিত তেতালার ঘরখানা ঝাড়পোঁছ করত। যার আসল কাজ ছিল ছাগল পুসা লম্বা দাড়ি শিং ওয়ালা রাম ছাগল যে ছাগল এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতো অনেকেই আবার অনেকে খুব আদর করত। আল্লাদে রামছাগলের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে অনেকটা সময় কেটে যেত। কবি পুত্র পুত্রর বধু তাকে খুব সমীহ করত খুব ভাব হয়েছিল ঠাকুর বংশের অনেক কিছু সেে দেখেছে। অনেককেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। রবিবাবুর বুড়ো বয়সে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা এবং তাকে বিশ্বভারতী রূপ দেওয়া মেনে নিতে পারেনি আবার যখন রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠপুত্রর শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু তখন সে ডুকরে কেঁদেে উঠেছ এমন সোনার চান ছেলে মারা গেলে মানুষ পাগল হয়ে যায় আমি খোকাকে কোলে করতাম আর সেই মুখখানা আমি প্রায়ই রাত্রে স্বপ্নে দেখি সেদিন আমায় খেতে ইচ্ছে হয় না কোনো কাজকর্ম করতে ইচ্ছে হয় নাা। মৃণালিনী দেবীর বিয়ের গল্প তাদের সন্তান-সন্ততির নানান কাহিনী স্নেহপ্রবণ এই ঝগড়ু খুব মনে রেখেছে পুরাতন ভৃত্যয দের মধ্যে অন্যতম সে। রবীন্দ্রর সহিত্যে তার উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি।

"ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীন কেষ্টা আয় রে কাছে 
এত দিন শেষে আসিয়া বিদেশে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে। 
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক সে যেন পরম বিত্ত
নিশি দিন ধরে দাঁড়ায় শিয়রে মোর পুরাতন ভৃত্য।"

** ফটিক সেখ।
    শিলাইদহে বাড়ি । বেশ সুপুরুষ গৌরবর্ণ লম্বা 
মানুষটির মুখের সুন্দর দাড়ি। বাবুমশাই এর বাবুর্চি ছিলেন। কবি পত্নী মৃণালিনীদেবী তাকে খুব সুন্দর রান্না শিখিয়েছিলেন। সকলের মন জয় করার জন্য তার পদবী হল ফরাস ।ফটিক ফরাস। খুব রসিক মানুষ ছিলেন তিনি কিন্তু অসুবিধাটা একটাই তার পরিবারের লোক সংখ্যা ছিলো বেশি একাই উপার্জনের তাই অভাব লেগে থাকত মাঝে মাঝে অনেক কিছুই কম পড়ে যেত তার বিরুদ্ধে যখন নালিশ হত তখন রবীন্দ্রনাথ বলতেন ফটিকের এত বড় সংসার তোমরা তাকে কটাকা মাইনে দিয়ে থাকো তার কাছে জিনিসপত্রের এত কড়াকড়ি হিসেব নেওয়ার দরকার কি?" এই হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ মানুষ রবীন্দ্রনাথ একজন অসহায় অভাবী মানুষের পাশে দাড়িয়ে তার স্বভাব মেনে নিয়েছেন আবার কখনও কখনও প্রজাদের দেখা করিয়ে দেওয়ার নামে কিছু অগ্রিম টাকা পয়সাও নিতেন একথা যখন জমিদার রবীন্দ্রনাথের কানে এলো তিনি অত্যন্ত বেদনা পূর্ণ স্বরে বললেন-" ফটিক তোর হাতে আমি আর খাব না তোর হাতে খেলে আমার পাব হবে তুই যা বাড়ি চলে যা আমার সম্মুখ থেকে চলে যা।" সত্যিই ফটিককে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এই শাস্তির জন্য রবীন্দ্রনাথের মন মানছিলো না। পরে নিজেদের কোনো এক বিবাদে যখন মামলা হয়েছিল সেই মামলায় ফটিকের শাস্তি হয়েছিল তখন রবীন্দ্রনাথ শেষ শাস্তি কমানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ফটিক কেঁদেকেটে বাবুর কাছে সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ফটিকের চরিত্র পাল্টে গেছিল। পরবর্তী সূত্র অনুসারে জানা যায় তার ছেলে নাতি এই জমিদার সরকারের চাকরি করেছিলেন বহুদিন।


"বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।"


    রবীন্দ্র সাহিত্যে এমনতর মানুষের ভিড় আমরা প্রত্যক্ষ করি নানান পর্বে। বিশেষ করে সমাজের সাধারণ মানুষের কথা তাঁর রচনায় ফুটে ওঠে অনবদ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। তিনি যেভাবে তাদের দেখেছেন জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছেন চলার পথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সেইসব মানুষের কথা তার রচনায় ভিড় করে এসেছে। ব্যক্তি জীবনের নানান অনুষঙ্গে এইসব মানুষেরা না থাকলে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে আমরা চিনতে পারতাম না সেভাবে আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম না। তাই পুরাতন ভৃত্য এই কবিতাটি তাঁর ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান বলে আমরা মনে করি। এদিক থেকে তার কবিতাটি যথার্থ শিল্প সুষমা মন্ডিত। সর্বজন স্বীকৃত একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
   দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -372. Dt -14.05.2021
 ৩০ বৈশাখ,১৪২৮. শুক্রবার
=================================

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...