মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৫ মে ১৮১৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের। পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও মাতা দিগম্বরী দেবী। পরিবারের পাঁচ সন্তান। পিতার উনিশ শতকের এদেশীয় সেবামূলক কাজের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে বাংলার্শিক্ষা শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক জগৎ , যেভাবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল-সেই বিষয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ আমরা লক্ষ্য করি.
তিনি ১৮২৩-২৫ সাল পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। ১৮২৭ সালে তিনি রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি পিতার বিষয়সম্পত্তি ও ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি দর্শন ও ধর্মচর্চা শুরু করেন। ১৮৩৪ সালে দক্ষিণডিহি রামনারায়ন রায়চৌধুরীর কন্যা শাকন্তরী বা সারদাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে ৯ পুত্র ও ৬ কন্যা। শৈশবে ২ পুত্র ও ১ কন্যা মারা যান। চতুর্দশ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্রাহ্ম ধর্মের বিশ্বাসী তিনি পিতার মৃত্যুর পর চিরাচরিত প্রথা মেনে সাবধান করেননি সমাজটাকে ঠিক করতে দিয়েছে কিন্তু নিজের বিশ্বাসের প্রতি আজীবন অটল থেকে তিনি বিপুল ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঋণশোধের দায়িত্ব পালন করেছেন জমিদারি দেখার পাশাপাশি দেশ ভ্রমণে ও জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছেন ।
১৮৩৮ সালে পিতামহীর মৃত্যুকালে তাঁর মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ধর্মবিষয়ে আগ্রহী হয়ে মহাভারত, উপনিষদ ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন শুরু করেন। এর ফলে পার্থিব বিষয়ের প্রতি তাঁর বীতস্পৃহ জন্মে এবং তাঁর মধ্যে ঈশ্বরলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। তত্ত্বালোচনার উদ্দেশ্যে তিনি ‘তত্ত্বরঞ্জনী সভা’ (১৮৩৯) স্থাপন করেন, পরে যার নাম হয় তত্ত্ববোধিনী সভা নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। ঔপনিষদিক ভক্তিবাদে ঘনিষ্ঠভাবে অনুপ্রবিষ্ট ভক্ত দেবেন্দ্রনাথ সংযত ভক্তির আবেগ তাড়িত নানান প্রসঙ্গ বর্জন করে, গ্রহণ করেছিলেন সহজ-সরল পন্থা। ব্যক্তিগতভাবে ব্রম্ভ উপলব্ধির সংরাগ মিশ্রিত জীবনযাপন, যা তিনি বাল্যকাল থেকে করে এসেছেন - সেই মতাদর্শকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবন যাপনে সাধনার মূল মন্ত্র করেছিলেন। চরম পরাধীনতার সময়েও তিনি শিক্ষা প্রচার, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ বিস্তার, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রবর্তন শুুধু নয় স্বাদেশিকতার বিষয়ে ও সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন।
১৮৪২ সালে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরের বছর তাঁরই অর্থে এবং অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।
১৮৪৪ সালে দেবেন্দ্রনাথ প্রথম ব্রহ্মোপাসনা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন এবং পরের বছর থেকে তা ব্রাহ্মসমাজে ব্যবহৃত হতে থাকে।
রচনা কর্ম:
ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থ (১৮৫১),আত্মতত্ত্ব বিদ্যা (১৮৫২),ব্রাহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস(১৮৬০), কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা(১৮৬২), জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি(১৮৯৩) পরলোক ও মুক্তি(১৯৯৫).
শ্রেষ্ঠ রচনা -
"আত্মজীবনী (১৮৯৪).
বাংলা সাহিত্যে ধর্ম বা তথ্য মূলক প্রবন্ধ এর আগে রামমোহন রায় কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করলেও দেবেন্দ্রনাথের মত নিছক তথ্য ধর্মী না হয় সাহিত্য গুণসমৃদ্ধ রচনাগুলি বিশেষ অবদান রেখেছিল। বিশেষ করে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনেক বেশি অন্তরের স্বরূপকে নিবিষ্ট করে এছাড়া তার প্রবন্ধ গুলিতে শান্ত সমাহিত ভাব ও সহজ সাবলীল প্রকাশ সহজাত কবিমন তার আধ্যাত্বিক অনুভূতিকে সবসময় সক্রিয় রসসিক্ত করে রাখত তাই তিনি আত্মেন্দ্রিয় জগতের বিহার না করে মর্তলোকের সৌন্দর্য সাগরে অবগাহন করেছেন। সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন -"সৌন্দর্যবোধ হইতেই তাঁহার আধ্যাত্মিক বোধের প্রেরণা আসিয়াছিল বলিয়া তাঁহার আধ্যাত্বিক বিষয়ে আলোচনাও এমনভাবে রস শিল্পের নিপুণ স্পর্শে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছে."
আত্মকথা" প্রবন্ধের ভাষায় তিনি ঘরোয়া সুর মেলালেন। প্রতিদিনের সহজ-সরল ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করলেন একান্ত ঘরোয়া যাপান চিত্রের মধ্য দিয়ে। এইসব সাবলীল সহজ-সরলতা পরবর্তীতে পুত্র রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্র ভাষার মধ্য দিয়ে আমরা ভাষার কোমলতা খুঁজে পাই। "দিদিমা আমাকে বড় ভালবাসিতেন। শৈশবে তাহাকে ব্যতীত আমিও আর কাহাকেও জানিতাম না আমার শয়ন উপবেশন ভজন সকলেই তাহার নিকট হইত তিনি কালীঘাট যাইতেন আমি তাহার সহিত যাইতাম তিনি যখন আমাকে ফেলে জগন্নাথ ক্ষেত্রে ও বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন তখন আমি বড়ই কাঁদিতাম।"
এমনতর সহজ ভাষায় নিজের শৈশব উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন। তাই সমালোচক অধীর দে যথার্থ মূল্যায়নের বলেছেন -"দেবেন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ প্রখর ব্যক্তিত্বের ন্যায় তাঁহার ভাষারও একটি রাজকীয় আভিজাত্য ছিল । ...প্রবন্ধ রচনা বিষয় ও ভাবের বলিষ্ঠতার সহিত ভাষার স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা ও সরসতা প্রভৃতি গুণগুলির প্রত্যেকটি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।"
রবীন্দ্রনাথ পিতা দেবেন্দ্রনাথের ভাষা ও রচনা শক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি ও সুসামঞ্জস্য লক্ষ করে লিখলেন -"নতুন ইংরেজি শিক্ষার ঔদ্ধত্যের দিনে শিশু বঙ্গভাষাকে বহু যত্নে কৈশোরে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন. " (চরিত্রপূূজা, বিশ্বভারতী(১৩০১), পৃৃ -৮৭.)
তাঁর জীবনের একটি অমর কীর্তি , বীরভূমে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করা। কথিত আছে বন্ধু বাড়ির একটি অনুষ্ঠানে পালকিতে চড়ে যাওয়ার সময় একটি গাছের তলায়়় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ছায়াশীতল শান্তির নীড় পরিবেষ্টিত এই জায়গাটি তাাঁর ভাল লেগে যায়। তিনি মনে মনে স্থির করেন -পরমাপ্রকৃতি শোভিত এই মনোরম পরিবেশে ব্রাহ্ম ধর্ম চর্চার জন্য একটি আশ্রমিক বিদ্যালয়় গড়ে তুললে কেমন হয়। কথাটি তিনি তার বন্ধুকে গিয়ে জানিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন যতদূর চোখ যায় সে জমি আপনার। ছাতিম তলায় শুভ দিন দেখে প্রতিষ্ঠা হলো শান্তিনিকেতনের। আজ বিশ্বভারতী।
আজীবন ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসক ও সাধক মানুষটির সংসার জীবন সুখের ও আনন্দ গৌরবের। প্রতিটি পুত্র-কন্যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। একদা লোকে বলতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের লক্ষ্মী ও সরস্বতী সহাবস্থান। জীবনের সবকিছু ফেলে অবশেষে১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol - 373. Dt -15.05.2021
৩১ বৈশাখ,১৪২৮. শনিবার
------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment