Sunday, 16 May 2021

ছোটগল্প সংখ্যা । ১৬ ই মে, ২০২১. Vol -374 The blogger.in litarature। emagazine. .......…….........……..................…..............…......….



শ্রাবণী বসু

১.
আশ্রয়

নিষ্পাপ চোখে শিশুটি তাকিয়ে রয়েছে মায়ের মুখের দিকে। বাম হাত মায়ের ঠোঁটের ওপর। বয়স মাত্র কয়েকমাস। নরম কাপড়ে মা তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছে।

ঘটনাটা খুলে বলি। বাচ্চাটির মায়ের কোরোনা রিপোর্ট পিসিটিভ এসেছিল। বাচ্চাটিকে স্নান করাতে গিয়ে প্রায় অচৈতন্য হয়ে গেছিল সে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বাচ্চাটাকে জল থেকে তুলে খাটের উপর রেখেছিল।
ব্যাস ওই পর্যন্ত তার মনে আছে। এরপর তার জ্ঞান ছিলো না।
জ্ঞান ফিরে সে দেখলো, সরকারী হাসপাতালের বেডে সে শুয়ে রয়েছে। কে বা কারা তাকে এখানে ভর্তি করেছে ।
নার্স ওষুধ খাওয়াতে এসে বলেছিল,
এই যে, তোমার বাচ্চা আছে তো?
মা মাথা নেড়ে জানিয়েছিল,হ্যাঁ।
নার্স বলেছিলো, চিন্তা কোরোনা ।তোমার বস্তির লোকজন বাচ্চাটার থাকার ব্যবস্থা করেছে।
তোমার তো কোরোনা রিপোর্ট পসিটিভ এসেছে। ভ্যাকসিন নিয়েছিলে?
মাথা নেড়ে মা জানালো , না। চোখ থেকে জল পড়ছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
অভিজ্ঞ নার্সটি অক্সিজেন চালাতে চালাতে বললো, তোমার স্বামী আছে?
এই কথাগুলোর সে উত্তর দেয়নি। হয়তো শুনতে পেয়েছিল।কিংবা হয়তো পায়নি।
বেশ কয়েকদিন পর রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরে সে তার ঘরে ফিরেছে।
                 তার প্রতিবেশী একজন বয়স্ক লোক,তার ঘরে চাবি লাগিয়ে দিয়েছিল। লোকটি বলল, তোর তো কোভিড হয়েছিল, আমরা তো তোকে এখানে থাকতে দোবো না। আর কটা দিন কারো কাছে থেকে আয় গে যা।
অন্যসময় হলে,ঝগড়া করতো।সহজে তার নিদান মানতো না। কিন্তু এখন শরীর খুব দুর্বল। তাছাড়া তার ছোট বাচ্চাটির ব্যাপারে তারাই সব জানে।
এ অবস্থায় তাদের কথা না মেনে কোনো উপায় নেই।
অগত্যা শহরের একটি বিখ্যাত মন্দিরের চত্ত্বরে অনেক ভিখারিদের মাঝখানে শরীরটাকে কোনোমতে গিয়ে ফেলে দিল।
সারাদিন এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখে ভিখারিদের মধ্যে একজন তার কাছে এসে ভাব পাতালো। নিজের ভাগের খাবার থেকে তাকে কিছু কিছু খাওয়ালো।
এইভাবে আরো কিছুদিন এখানে থাকতে থাকতে মেয়েটির মনে হলো, শরীরে একটু বল পাচ্ছে।
যেভাবে এসেছিল,সেভাবেই সে মন্দির থেকে নিজের ডেরায় এসে উঠলো। সেই বুড়ো লোকটিকে ডেকে নিজের ঘরের চাবি চেয়ে নিল।
লোক মারফত বুড়ো লোকটি খবর পাঠিয়ে মেয়েটির শিশু সন্তানটিকে আনার ব্যবস্থা করলো।
যে অটোওয়ালাটি বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছিল, সে বাচ্চাটিকে ফেরত দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মেয়েটিকে বললো, আমি যদি না নিয়ে যেতাম,বাঁচিয়ে রাখতাম,তুমি কি তোমার বাচ্চাকে ফিরে পেতে?
মেয়েটি এ কথার কোনো মানে বুঝতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাচ্চাটিকে বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

লোকটি বলল, তোমার স্বামী তো তোমাকে ফেলে পালিয়েছে শুনলাম।
মেয়েটি কথার উত্তর দিলোনা।ওভাবেই তাকিয়ে আছে।
লোকটি বললো, আমি অটো চালাই। আমার বাড়িতে চলো। মামা-ভাগ্নে মিলে থাকবো। তুমি আমাদের রেঁধে খাওয়াবে।
মেয়েটি পিছু ফিরতে গিয়ে টান পড়লো।          
লোকটির শার্টের বোতামে আটকে আছে তার ছেলেকে মুড়ে রাখা কাপড়ের একটা প্রান্ত। বাচ্চাটা মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মনে হলো,সে বলে উঠলো,চলো না মা! মামার বাড়ি গিয়ে থাকি!

মেয়েটি কোনো কথা বললো না।বাচ্চাটিকে বুকে বেঁধে নিয়ে অটোতে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসলো। চোখে মুখে সীমাহীন উৎকণ্ঠা। দুর্বল শরীরখানা এলিয়ে রাখলো সিটে।
অটো ছুটতে লাগলো পিচ রাস্তা ধরে....। 

২.
আপনজন

কে ? বিশাখা এলি?
খুলছি বাবা ,দাঁড়া। আস্তে আস্তে খাট থেকে নামতে নামতে নমিতা কথাগুলো বলছে দরজার ওপ্রান্তে থাকা বিশাখার উদ্দেশ্যে।

বিশাখা রান্নাঘরে ঢুকে ,তড়বড় করে গ্যাস জ্বেলে দুজনার চায়ের জল বসিয়ে রাতের এঁটো কাঁচের বাসন ধুয়ে ফেললো।

ইসমাইল বিছানায় বসে বসে খালি পেটে খানিকটা জল খাচ্ছে। সকালে প্রায় এক বোতল জল পান করে তারপর বিছানায় একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে রাখলো।
দু- কাপ কাগজের ওপরে রেখে বিশাখা ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। মেশিনের মতো কাজ করে নিলো।তারপর ,আসছি বলে- দরজা টেনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল।

নমিতা বললো, সামনের মাসে তোকে আর কাজ করতে আসতে হবেনা।আমি অন্য লোক রাখবো।তোর কাজে মন নেই। দায়সারা কাজ আমার চলবেনা।

বিশাখা হাত নেড়ে বললো, হ্যাঁ, ভালোই তো অন্য লোক রাখো গে। আমার কাজের অভাব হবেনা।ভারি তো মাইনে দাও তার ওপরে আবার এতো কথা। ওসব আমারও পোষাবেনা।
সশব্দে সদর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিশাখা বেরিয়ে গেল।
নমিতা ইসমাইলকে উদ্দেশ্য করে বললো, দেখলে ,কেমন মুখে মুখে চোপা করলো?
ইসমাইলের কানে কথাগুলো ঢুকলো কী ঢুকলোনা ,বোঝাই গেলো না।

                     ২
ঠিক তার পরদিনের ঘটনা।
দরজার সামনে অনেকের ভিড় দেখে , ঠেলেঠুলে বিশাখা ঘরে ঢুকে দেখলো,মেঝেতে ইসমাইল পড়ে আছে অচেতনভাবে। নমিতার ক্ষমতা নেই তাকে তোলার। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নমিতা।

প্রতিবেশীরা ভাবছে,কী করবে।কিছু হলে আবার থানা পুলিশের ঝামেলা।কাজেই তারা.....
বিশাখা এক ঝটকায় ইসমাইলকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সিতে তুলে সোজা একটা সরকারী হাসপাতালে গিয়ে,নিজেই বন্ডে সই করে ভর্তি করে দিল।

ডাক্তার তাকে ভেবে দেখতে।কারণ পেসেন্টের কোনো ক্ষতি হলে সব দায় তার ওপরেই বর্তাবে।
বিশাখা সাড়া দেয়নি। খসখস করে বন্ডে সই করে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
                      ৩
ইসমাইল ভেন্টিলেশন পেরিয়ে মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় সপ্তা তিনেক পরে ঘরে ফিরল।বিশাখা সেই যে ভর্তি করে দিয়েছে ,আর হাসপাতালমুখো হয়নি।
                   ইসমাইল সেরে উঠছিল। নমিতা আজকাল প্রায়ই বলতো ,ওরা কাজের লোক।ওদের আবার কোনো টান থাকে নাকি? নেহাত সেদিন এসে পড়েছিল তাই হাসপাতালে তোমাকে ফেলে দিয়ে গেছে।
ইসমাইল সাড়া দিতো না। শুনতো। নমিতা কদিন হাসপাতাল আর ঘর করে করে ক্লান্ত।
যাইহোক। ইসমাইল সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরলো। সে তার ভগবান বা আল্লাহ যাঁরই বলো তাঁরই কৃপা।

           ৪

ভিন্ন ধর্মের এই দুটি মানুষের ঘরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি কোনোদিন আসেনি।না বন্ধু, না আত্মীয়।
তাদের প্রেম করেই বিয়ে। দুই বাড়ির অমতে। তারা নিঃসন্তান দম্পতি। দুজনে ভালোয় মন্দয় কাটিয়ে দিলো কয়েকটা যুগ।

তাদের প্রতিবেশীরা তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট কৌতূহলী তবে শিক্ষিত মানুষরা তাদের কৌতূহল দমন করতে পারে । তাই সে সব কৌতূহল অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।কেবল তাদের মুখের রেখা অথবা চোখের চাহনিতে সেসব ধরা পড়ে।
ইসমাইল আর নমিতা কোনোদিন সেসবে পাত্তা দেয়নি।

               ৫

মাসের শেষ দিন বিশাখা ঘরে এসে বললো, আন্টি,কাল থেকে আমি আসবোনা কাজে। আজকে আমার মাইনেটা দিয়ে দেবে? কাল থেকে আমি অন্য একটা বাড়িতে কাজে যাবো।এদিকে আর আসবো না।

নমিতা ভুলে গেছিল ঘটনাটা।বিশাখার কথায় মনে পড়ে গেল।আসলে মাঝখানে এতো কান্ড ঘটে গেল, মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো ,বিশাখাকে বলা কথাগুলো।
সে বিষয়টা গোপনই রাখলো নমিতা। 
       
বিশাখাকে বললো, হ্যাঁ, অন্য লোক একজন ঠিক করেছি। ভেবেছি বাইরের কাউকে দিয়ে আর কাজ করাবো না। ঘরের লোকই ঘরের কাজ করবে।
                   বিশাখা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
নমিতা বললো,কিরে কী ভাবছিস?
--না , হ্যাঁ, না ...মানে , তোমাদের তো...
---কী- না ,হ্যাঁ, না...

আমার মেয়ে আমাদের সব কাজ করবে কাল থেকে। কি রে ,বুঝলি ?
---ততোধিক অবাক হয়ে বিশাখা জিজ্ঞেস করলো,তোমার মেয়ে?

এই দ্যাখ ,আমাদের মেয়ের ছবি। বলে, বিশাখার সাথে তাদের দুজনের একখানা ছবি মোবাইলে বার করে দেখালো।

বিশাখা চুপ।কী বলবে,কী উত্তর দেবে ভাবছে।ঠোঁট কাঁপছে তার তিরতির করে!

ইসমাইল এসে বললো,বিশাখা তুই তো আমার মা রে। আমাকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আমাকে বাঁচালি।তুই আমার আম্মু।

বিশাখার একপাশে নমিতা আরেকপাশে ইসমাইল দাঁড়িয়েছে।
বিশাখা বললো, কই, সরো দেখি, কাজ সারি.....নমিতা আর ইসমাইল বিশাখার হাত দুটো ধরে রাখল।
            ৬
দরজায় কেউ বেল বাজালো। ভিতর থেকে নমিতা বললো, ভিতরে এসো।
একজন মাঝ বয়সী,স্থূল চেহারার মহিলা।
ইসমাইল বললো,তোর আন্টি একে আজ থেকে কাজে রেখেছে।
তুই ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নে। আমাদের আর জ্বালাস না।
বিশাখা বললো,দাঁড়াও খুব জ্বালাবো তোমাদের। খুব...খুব..খুব... 

###₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹##₹₹####₹₹₹₹₹₹₹####

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...